বাঘা তেঁতুল-তুই by সৈয়দ আবুল মকসুদ
তুই সর্বনামটি কখনো বড়ই মধুর, কখনো বিষাক্ত তিরের মতো অসহনীয়। বাংলা ভাষায় সবকিছুই বেশি বেশি। সম্বোধন তিন রকম: তুই, তুমি, আপনি। অতি আদরের আপনজনকে বাঙালি ডাকে তুই। যেমন, নিজের ছেলেমেয়ে অথবা সন্তানতুল্য যারা। বউয়ের সবচেয়ে সুন্দর চঞ্চলা ছোট বোনটিকেও অনেক দুলাভাই তুই সম্বোধন করে অতি ঘনিষ্ঠতা থেকে। অতি প্রিয় বন্ধুকে মানুষ তুই ডাকে, সব বন্ধুকে নয়।
তবে তুই তুচ্ছার্থেই ব্যাপক ব্যবহূত। বাড়ির চাকর-বাকর, রাস্তার টোকাই, কানা-নুলো-খোঁড়া ভিখেরিকে কেউ বলে, যা, ভাগ এখান থেকে। শালীকে বললেও শ্বশুর-শাশুড়িকে কেউ তুই বলে না। অফিসের বড় কর্তাকে নয়। সহকর্মীকেও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে প্রকাশ্য সভায় তুই বলাটা বড়ই অস্বাভাবিক। জুনিয়র শিক্ষক সিনিয়র শিক্ষকদের, সিনিয়র জুনিয়রদের সঙ্গে সভা-সমাবেশে তুই-তোকারি করলে কানে আঙুল দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
এবার রবীন্দ্র মৌসুম। কেউ লাঠি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এসে বলতে পারেন, তুই নিয়ে তোমার/তোর এত আপত্তি কেন? তুই সর্বনামটি গুরুদেব কি কিছু কম ব্যবহার করেছেন? রবীন্দ্রনাথ যাকে-তাকে তুই বলেছেন। তিনি তা পারেন, কারণ তিনি দেবতুল্য। সহকর্মী তো বটেই, তিনি তাঁর জীবনদেবতাকেও তুই বলতে দ্বিধাহীন। তিনি বসন্তের বাতাসকেও তুই বলেন: ‘তুই রে বসন্ত সমীরণ/ তোর নহে সুখের জীবন।’ আগেই বলেছি, সবচেয়ে আপনকে মানুষ তুই ডাকে। নিজের চেয়ে আপন কেউ নেই। তিনি বলেন: ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মনরে আমার।’ কতজনকে তিনি তুই বলেছেন, তার শেষ নেই। যেমন, ‘পথিক পরান, চল্ চল্ সে পথে তুই/যে পথ দিয়ে গেল রে তোর বিকেলবেলার জুঁই\’ দেশের লোকজনকে তুমি করেই বলতে পারতেন, কিন্তু তিনি বলেছেন তুই: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ অথবা ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।’
তবে কবিতা-গানেই তুই-তোর চলে, সামাজিক জীবনে নয়। কর্মজীবনে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র তাঁরই দলের কয়েকজন বন্ধুর হাতে নিহত হলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের মাস খানেক শোকে পাথর হয়ে থাকার কথা। অবশ্য পৃথিবীর সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। বার্কলে, শিকাগো, ক্যালিফোর্নিয়া, টরন্টো বা মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি ঘটে না। জামিয়া মিলিয়া বা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রনেতা ও তাঁদের ক্যাডারদের সার্বভৌমত্ব নেই। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রোক্টর প্রভৃতি ছাত্রনেতাদের কথায় উঠবস করেন না।
ছাত্র নিহত হলেন। তাঁর মা-বাবার জীবন শূন্য হলো। একটি পরিবারের স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। তাতে কোনো করুণার উদ্বেগ হলো না তাঁর শিক্ষকদের, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধারদের। অপরাধীদের বাঁচাতে উপাচার্যের অক্লান্ত চেষ্টা। অভিযুক্তদের বছর খানেক ক্যাম্পাসের বাইরে সরিয়ে রাখলেই সর্বোচ্চ শাস্তি হয়ে গেল। যেমন, ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে একজন পুলিশকে ‘ক্লোজ’ করা হয়। ব্যস।
যা-ই হোক ছাত্র হত্যার পরবর্তী পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে ডাকা হলো শিক্ষক সমিতির সভা। তাতে পরস্পরের বক্তব্য নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। ‘উপাচার্যপন্থী জুনিয়র শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে বলেন, “তুই বস।” তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে আরেক সহযোগী শিক্ষক জুনিয়রদের “তুই” বলে সম্বোধন করেন।’ ‘হট্টগোল চলাকালে প্রোক্টর শিক্ষক সমিতির সভাপতির দিকে তেড়ে আসেন’ এবং বলেন, ‘কই যাস্, দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে বের হয়ে যা।’ তারপরই শুরু হয় অসৌজন্যমূলক সম্বোধন থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ: বলিষ্ঠ হাতের সদ্ব্যবহার। ঘটনার বিস্তারিত সচিত্র প্রতিবেদন শুক্রবারের সমকাল-এ প্রকাশিত হয়েছে।
কেউ বলবেন, কিল-ঘুষি-লাথির চেয়ে তুই-তোকারি ভালো। তাতে হাড়গোড় ভাঙে না, শরীরটা অক্ষত থাকে, মনটা ভাঙে। তুই শুধু তুচ্ছার্থে নয়, বাঙালির অপমানেরও অস্ত্র।
কোনো দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি অতি উঁচু প্রতিষ্ঠান। তার মর্যাদা সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের চেয়ে বেশি। কোনো প্রকাণ্ড মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি। সেখানে উচ্চতর বিদ্যার চর্চা হয়। নতুনতর ও উন্নততর জ্ঞানের অন্বেষণ হয়। গভীর গবেষণামূলক কাজ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শিক্ষাগত যোগ্যতায় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিতদের অন্তর্ভুক্ত। কোনো মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গবেষণা করেন না, মুক্তবুদ্ধির চর্চা তো নয়ই।
তাঁরাই হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যাঁরা সবচেয়ে মেধাবী। শিক্ষাজীবন শেষ করে একদিন তাঁরাই সমাজের ও রাষ্ট্রের যেকোনো পদে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের অকালমৃত্যু, শুধু তাঁর পরিবারের ক্ষতি নয়, জাতি ও রাষ্ট্রের ক্ষতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের আচরণ শুধু তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে নয়, সমস্ত যুবসমাজের কাছে অনুকরণীয় হওয়ার কথা। আজ যে অবস্থা দেখছি, তাতে প্রকাশ্যে কাউকে ‘তুই’ বলা কেন অবৈধ নয়—সেই রুল চেয়ে রিটও হতে পারে।
অভিভাবকেরা বড় আশা নিয়ে তাঁদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। তাঁরা একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েকে বলবেন, ‘শিক্ষার মান নেমে গেছে, দুঃখ নাই, আগে তোরা মানুষ হ।’
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
এবার রবীন্দ্র মৌসুম। কেউ লাঠি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এসে বলতে পারেন, তুই নিয়ে তোমার/তোর এত আপত্তি কেন? তুই সর্বনামটি গুরুদেব কি কিছু কম ব্যবহার করেছেন? রবীন্দ্রনাথ যাকে-তাকে তুই বলেছেন। তিনি তা পারেন, কারণ তিনি দেবতুল্য। সহকর্মী তো বটেই, তিনি তাঁর জীবনদেবতাকেও তুই বলতে দ্বিধাহীন। তিনি বসন্তের বাতাসকেও তুই বলেন: ‘তুই রে বসন্ত সমীরণ/ তোর নহে সুখের জীবন।’ আগেই বলেছি, সবচেয়ে আপনকে মানুষ তুই ডাকে। নিজের চেয়ে আপন কেউ নেই। তিনি বলেন: ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মনরে আমার।’ কতজনকে তিনি তুই বলেছেন, তার শেষ নেই। যেমন, ‘পথিক পরান, চল্ চল্ সে পথে তুই/যে পথ দিয়ে গেল রে তোর বিকেলবেলার জুঁই\’ দেশের লোকজনকে তুমি করেই বলতে পারতেন, কিন্তু তিনি বলেছেন তুই: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ অথবা ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।’
তবে কবিতা-গানেই তুই-তোর চলে, সামাজিক জীবনে নয়। কর্মজীবনে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র তাঁরই দলের কয়েকজন বন্ধুর হাতে নিহত হলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের মাস খানেক শোকে পাথর হয়ে থাকার কথা। অবশ্য পৃথিবীর সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। বার্কলে, শিকাগো, ক্যালিফোর্নিয়া, টরন্টো বা মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি ঘটে না। জামিয়া মিলিয়া বা বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রনেতা ও তাঁদের ক্যাডারদের সার্বভৌমত্ব নেই। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রোক্টর প্রভৃতি ছাত্রনেতাদের কথায় উঠবস করেন না।
ছাত্র নিহত হলেন। তাঁর মা-বাবার জীবন শূন্য হলো। একটি পরিবারের স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। তাতে কোনো করুণার উদ্বেগ হলো না তাঁর শিক্ষকদের, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধারদের। অপরাধীদের বাঁচাতে উপাচার্যের অক্লান্ত চেষ্টা। অভিযুক্তদের বছর খানেক ক্যাম্পাসের বাইরে সরিয়ে রাখলেই সর্বোচ্চ শাস্তি হয়ে গেল। যেমন, ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে একজন পুলিশকে ‘ক্লোজ’ করা হয়। ব্যস।
যা-ই হোক ছাত্র হত্যার পরবর্তী পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে ডাকা হলো শিক্ষক সমিতির সভা। তাতে পরস্পরের বক্তব্য নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। ‘উপাচার্যপন্থী জুনিয়র শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে বলেন, “তুই বস।” তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে আরেক সহযোগী শিক্ষক জুনিয়রদের “তুই” বলে সম্বোধন করেন।’ ‘হট্টগোল চলাকালে প্রোক্টর শিক্ষক সমিতির সভাপতির দিকে তেড়ে আসেন’ এবং বলেন, ‘কই যাস্, দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে বের হয়ে যা।’ তারপরই শুরু হয় অসৌজন্যমূলক সম্বোধন থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ: বলিষ্ঠ হাতের সদ্ব্যবহার। ঘটনার বিস্তারিত সচিত্র প্রতিবেদন শুক্রবারের সমকাল-এ প্রকাশিত হয়েছে।
কেউ বলবেন, কিল-ঘুষি-লাথির চেয়ে তুই-তোকারি ভালো। তাতে হাড়গোড় ভাঙে না, শরীরটা অক্ষত থাকে, মনটা ভাঙে। তুই শুধু তুচ্ছার্থে নয়, বাঙালির অপমানেরও অস্ত্র।
কোনো দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি অতি উঁচু প্রতিষ্ঠান। তার মর্যাদা সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের চেয়ে বেশি। কোনো প্রকাণ্ড মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি। সেখানে উচ্চতর বিদ্যার চর্চা হয়। নতুনতর ও উন্নততর জ্ঞানের অন্বেষণ হয়। গভীর গবেষণামূলক কাজ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শিক্ষাগত যোগ্যতায় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিতদের অন্তর্ভুক্ত। কোনো মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গবেষণা করেন না, মুক্তবুদ্ধির চর্চা তো নয়ই।
তাঁরাই হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যাঁরা সবচেয়ে মেধাবী। শিক্ষাজীবন শেষ করে একদিন তাঁরাই সমাজের ও রাষ্ট্রের যেকোনো পদে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের অকালমৃত্যু, শুধু তাঁর পরিবারের ক্ষতি নয়, জাতি ও রাষ্ট্রের ক্ষতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের আচরণ শুধু তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে নয়, সমস্ত যুবসমাজের কাছে অনুকরণীয় হওয়ার কথা। আজ যে অবস্থা দেখছি, তাতে প্রকাশ্যে কাউকে ‘তুই’ বলা কেন অবৈধ নয়—সেই রুল চেয়ে রিটও হতে পারে।
অভিভাবকেরা বড় আশা নিয়ে তাঁদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। তাঁরা একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েকে বলবেন, ‘শিক্ষার মান নেমে গেছে, দুঃখ নাই, আগে তোরা মানুষ হ।’
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments