কল্পকথার গল্প-সাপ রেখে শাপমোচন হয় না by আলী হাবিব

সাপের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। সেই যে কৃষক, মাঠে একটা ছোট সাপের বাচ্চা পেয়ে সেটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর যাকে বলে 'দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা'_তেমনটিই ঘটল। সাপটা কৃষকের বাড়িতে বড় হতে থাকল। কৃষকের ছিল একটা ছোট ছেলে। ছেলেটি সাপটিকে নিয়ে খেলত। সেই সাপ এভাবে কৃষকের বাড়িতে বড় হচ্ছিল। একদিন সকালে মাঠে যাওয়ার সময় কৃষক দেখেন, তাঁর ছেলে সাপটিকে নিয়ে খেলছে।


সাপটি তত দিনে বেশ বড় হয়ে গেছে। ছেলেটি তো নেহাতই শিশু। সাপ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। খেলার একপর্যায়ে সাপটা ফণা তুলে ছেলেটিকে ছোবল দিতে উদ্যত হতেই কৃষক ছুটে গিয়ে হাতের লাঠি দিয়ে সাপটিকে আঘাত করে মেরে ফেলেন। এই গল্পের মর্মার্থ কী? সাপকে বিশ্বাস করতে নেই। ফণা তোলার আগেই মেরে ফেলতে হয়। সাপুড়েরা যে সাপ নিয়ে খেলা দেখায়, সেই সাপেরও বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হয়। কথায় আছে, 'সাপের মাথায় মণি থাকলেও সে ভয়ংকর।'
পুরাণে সাপ নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। আগে মনসার গল্পটা জানা যাক। মনসা সাপের দেবী। নাগরাজ বাসুকির বোন। ব্রহ্মার উপদেশে কশ্যপ সর্পমন্ত্র সৃষ্টি করে তপোবলে মন দিয়ে মনসাকে মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে সৃষ্টি করেন। সে জন্য এঁর নাম মনসা। সে আমলে মানুষ সব সময় সাপের ভয়ে ভীত থাকত। সাপ কাউকে দংশন করলে মৃত্যু ছিল অনিবার্য। মনসা কুমারী অবস্থায় মহাদেবের কাছে যান। তাঁর কাছ থেকে স্তব, পুজো, মন্ত্র ইত্যাদি সব শিখে সিদ্ধি লাভ করেন। পরে তো সবাই মনসারই পুজো করে।
এবার বাসুকির গল্পটা। বাসুকি নাগরাজ। তাঁকে বলা হয় শেষ নাগ বা অনন্ত নাগ। সমুদ্র-মন্থনকালে দেবতারা নাগরাজ বাসুকিকে মন্থন-রজ্জু হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সমুদ্র-মন্থনে। হাজার বছর চলে গেলেও সমুদ্র থেকে কিছুই আর উত্থিত হয় না। তখন বাসুকি হলাহল উদ্গিরণ করতে শুরু করলে সারা পৃথিবী বিষে ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলো। দেবতাদের অনুরোধে মহাদেব সব বিষ পান করে ফেলেন। তো এই নাগরাজ বাসুকিও একবার তাঁর ভাইদের সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন। সেই গল্পটা বলা যাক। রাজা কশ্যপের দুই স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের একজনের নাম কদ্রু, অন্যজনের নাম বিনতা। কদ্রু একসময় বিনতাকে তাঁর দাসী হিসেবে পেতে চাইলেন। আশ্রয় নিলেন কপটতার। কদ্রু বললেন, ঘোড়ার লেজ কালো। অন্যদিকে বিনতা বললেন, ঘোড়ার লেজ সাদা। এ নিয়ে বিতর্ক। ঠিক করা হলো, পরদিন উচ্চৈঃশ্রবা নামের ঘোড়াটিকে মাঠে আনা হবে। সেটিকে দূর থেকে দেখা হবে। কদ্রু তাঁর ছেলেদের বললেন ঘোড়ার লেজের সঙ্গে লেগে থাকতে। পরদিন সকালে মায়ের কথা অনুযায়ী কদ্রুর সাপ পুত্ররা উচ্চৈঃশ্রবার পুচ্ছলগ্ন হয়ে থাকল। দূর থেকে সেটা দেখে বিনতা কদ্রুর দাসত্ব গ্রহণ করলেন। তবে কদ্রুর সব সন্তান কিন্তু তাঁদের মায়ের এই কপটতায় অংশ নেয়নি। কদ্রু তাঁর এই সন্তানদের অভিশাপ দিয়েছিলেন। এই গল্পে আমাদের দেশের মিল খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আমরা আনতে পারি একাত্তর সালকে। একাত্তর সালে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল দেশের স্বাধীনতার জন্য। সেখানে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হয়নি এ দেশের মানুষ। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের দেশেরই কিছু মানুষ একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। এই মানুষগুলো অন্যদের বিভ্রান্ত করতে কপটতার আশ্রয় নেয়। নিজেরা রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী গঠন করে দেশকে পাকিস্তানের দাসত্ব বরণ করে থাকতে বাধ্য করতে চাওয়া মানুষগুলো কপটতার আশ্রয় নিতেও পিছপা হয়নি। কপট প্রলোভনে অনেককে রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। এই বাংলাদেশবিরোধী মানুষদেরই একজন গোলাম আযম। একাত্তরে তিনি এবং তাঁর দল জামায়াত পাকিস্তান ও ইসলামকে এক ও অভিন্ন বলে প্রচার করেছেন। এটা এক ধরনের কপটতা। মানুষকে মিথ্যে ছলনায় ভুলিয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চালিত করার অপপ্রয়াস। একটা উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করা যাক। ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামে গোলাম আযমের একটি ভাষণ উদ্ধৃত করা আছে। ওই ভাষণে তিনি বলেছেন, 'পাকিস্তান সারা বিশ্ব মুসলিমের জন্য ইসলামের ঘর। কাজেই পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলে জামায়াতের কর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনো সার্থকতা মনে করে না। জামায়াতের কর্মীরা জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য কাজ করছে। দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শান্তি কমিটির মাধ্যমে ও অন্যান্য উপায়ে জনসাধারণের মনে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করেছে। এবং একই উদ্দেশ্যে জামায়াত দুজন সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধ্য করেছে।' কপটতা আর কাকে বলে! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তখন বাংলাদেশে চালাচ্ছে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। এই ঘৃণ্য কাজে সহযোগিতার জন্য তারা এ দেশে তৈরি করেছিল কিছু দালাল বাহিনী। বিদেশি দৈত্যের এ দেশীয় দালাল। ইতিহাসে এদের পরিচিতি রাজাকার নামে। এ দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য তৈরি হয়েছিল রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী, আল-শামস বাহিনী। কিন্তু এখন এরা সবাই এক নামে রাজাকার হিসেবেই পরিচিত। যেমন_মীর জাফর শব্দের আভিধানিক অর্থ আর যা-ই হোক, এ নামের ব্যবহারিক অর্থ বিশ্বাসঘাতক। তেমনি রাজাকার শব্দের আভিধানিক অর্থ আর যা-ই হোক না কেন, এ শব্দের ব্যবহারিক অর্থ বাংলাদেশবিরোধী। না, একটি বা দুটি মাত্র শব্দে রাজাকার শব্দের অর্থ বোঝানো সম্ভব নয়। রাজাকার অর্থ একাত্তরের ঘাতক। রাজাকার অর্থ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর। রাজাকার তারাই, যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না।
এখন জানতে হবে সেই রাজাকার কারা। এ ছোট লেখায় সব রাজাকারের পরিচিতি তুলে ধরা যাবে না। পালের গোদা এমন কয়েকজনের নাম ও কার্যকলাপ এখানে আলোচনা করা যেতে পারে। সে সময়ের এক রাজাকারের নাম গোলাম আযম। গোলাম আযম তখন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ১৩ এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তার জন্য গঠিত নাগরিক শান্তি কমিটির বায়তুল মোকাররম মসজিদে এক সমাবেশ হয়। এ সমাবেশে পাকিস্তান আর্মি জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছিলেন এই পালের গোদা রাজাকার। সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোলাম আযম সারা দেশ ঘুরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সংগঠিত করার কাজ করেন। ওই প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, এই গোলাম আযম একাত্তরের ৪ আগস্ট খুলনা জেলা জামায়াতের এক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আখ্যা দেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে। একই সঙ্গে তিনি পাকিস্তান রক্ষায় জামায়াতকর্মীদের কাজ করার আহ্বান জানান।
আরো কয়েকজন যুদ্ধাপরাধী রাজাকার ও আলবদরের নাম জানা যাক। মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, এ টি এম আজহারুল ইসলাম_একাত্তরের তিন চেনা আলবদর। এরা সবাই যুক্ত ছিলেন আলবদর বাহিনীর সঙ্গে। একাত্তরের ১৪ জুন জামালপুরে ইসলামী ছাত্রসংঘের এক সভায় পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী বলেন, 'পাকিস্তান সেনাবাহিনী সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেনাবাহিনী যেভাবে কাজ করছে, তাতে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা সম্ভব।' এদের তুলনা করা চলে সাপের সঙ্গে। বাসুকি যেমন তাঁর মায়ের কথা শোনেননি, তেমনি রাজাকারদের অনুগামী হয়নি সব বাঙালি। কদ্রু অভিশাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাসুকি নানা তীর্থে কঠোর তপস্যা করেন। তাঁর তপস্যায় প্রীত হয়ে ব্রহ্মা জানতে চেয়েছিলেন তাঁর বাসনার কথা। বাসুকি বলেছিলেন, তিনি পরলোকেও তাঁর দুর্মতিসম্পন্ন ভ্রাতাদের সংসর্গ চান না। ব্রহ্মা তাঁকে পাতালে গিয়ে এই চঞ্চলা পৃথিবীকে ধারণ করতে বলেন। সেখানে নাগরা তাঁকে নাগরাজপদে অভিষিক্ত করেন। তেমনি বাঙালিরা একাত্তরে দেশজুড়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকারদের সঙ্গে বাঙালিদের একটা ফারাক আজো রয়ে গেছে। এই ফারাক কোনো দিন পূরণ হবে না। বাংলাদেশবিরোধী রাজাকার চিরকাল রাজাকারই থেকে যাবে।
পুরাণের সাপের আরেকটি গল্প বলা যাক। বিনতার সন্তান গরুড়। অমৃত নিয়ে এলেন। সেই অমৃত রাখলেন এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে অমৃত পান করতে গিয়ে সাপদের জিহ্বা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। একাত্তরে পরাজয়ের পর লুকিয়ে ছিল আমাদের দেশের রাজাকাররা। ফিরে আসার পর তাদের মুখেও শোনা গেল অন্য রকম কথা। তাঁরা এখন অতীতের ইতিহাস ভুলে যেতে চায়। কিন্তু কৃতকর্মের জন্য একটুও অনুশোচনা তাদের আছে কি? গরুড় তাঁর মায়ের দাসত্ব মোচনের জন্য সাপদের শায়েস্তা করেছিল। দেশ ও জাতির কলঙ্কমোচনের জন্য একাত্তরের চিহ্নিত সাপগুলোকে শায়েস্তা করা দরকার। তা না হলে দেশ ও জাতি শাপমুক্ত হবে না।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.