খাল তো খোলা হলো, বিলের কী হবে?-চিংড়ি চাষ by ফ্রান্সিস হালদার
মংলা বন্দরের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম নাব্যতা সংকট। নদীর স্রোত হারিয়ে পলি জমে চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বড় জাহাজ এখন বন্দরে আসতে পারে না। এ নাব্যতা সংকটের একটি বড় কারণ চিংড়ি ঘের। দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার একর জমি খালের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে যুক্ত। ঘের মালিকরা এসব খালে বাঁধ দিয়ে জমিতে লবণ পানি আবদ্ধ করে চিংড়ি চাষ করেন।
ফলে জমি-বিলের পানি নিয়মিত নদীতে যাওয়া-আসা করতে পারে না ৬ জানুয়ারি শুক্রবার 'মংলায় ৩৩ সরকারি খাল উন্মুক্ত করা হলো' শিরোনামে সমকাল পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকেই এ লেখার উদ্যোগ। ১২ মাস বাঁধ দিয়ে লবণ পানি আটকে চিংড়ি চাষ করার ফলে সৃষ্ট কৃষি ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে এবং পশুর চ্যানেলসহ অন্যান্য খাল-বিল-নদী-নালার নাব্যতা রক্ষার্থে সব সরকারি খালকে অবৈধ বাঁধ থেকে মুক্ত করে নদীর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এ উদ্যোগ সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট হবে কি-না এ বিষয়ে মংলাবাসী হিসেবে আমরা সন্দিহান। আর আমাদের সব উৎকণ্ঠার বিপরীতে রয়েছে একটি শক্তিশালী পক্ষ যারা অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত বৈধ-অবৈধ সব উপায়ে সমগ্র অঞ্চলে চিংড়ি ঘেরের প্রসার ঘটাচ্ছে।
সরেজমিন ওইসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক চিংড়ি ঘেরের মালিক অবমুক্ত খালগুলোর পাশের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যে বাঁধের মতো ঘিরে ফেলতে শুরু করেছেন। ফলে লোনা পানি যা বহু বছর ধরে চিংড়ি চাষের জন্য জমিতে আটকে রাখা হয়েছিল তা সেখানেই থেকে যাচ্ছে। ফলে দুটি আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, অন্যান্য চিংড়ি ঘেরের মালিক যাদের অবৈধ বাঁধ খালগুলোর ওপর ছিল এবং আশপাশের কৃষি জমির মালিক সবার মধ্যে নিজ জমিতে ঘের দিয়ে লোনা পানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষ করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কেননা নিজ জমিতে ঘের দেওয়া অবৈধ নয় বিধায় চিংড়ি চাষে সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। ফলে লোনা পানিজনিত সমস্যা সমস্যাই থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, খালের দু'পাশকে এভাবে ঘিরে ফেলায় বর্ষাকালে যখন খালে পানির পরিমাণ বেড়ে যাবে, তখন এই অতিরিক্ত পানি আশপাশের জমিতে ঢুকতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে পানির প্রবল চাপে ঘের ভেঙে মারাত্মক বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা চারপাশের বসতবাড়ির জন্য হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
আমরা শুনে থাকি, চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে প্রতিবছর ২%-এর কিছু বেশি অর্থ যোগ করছে। বর্তমানে মংলা এলাকায় যারা বসবাস করেন তাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সুশীল সমাজের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন চিংড়ি চাষের ফলে পরিবেশের যে বিপর্যয়ে ফসল উৎপাদন যে হারে বিঘি্নত হচ্ছে তার আর্থিক মূল্য এই খাত থেকে যে অর্থ উপার্জন হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। চিংড়ি ঘেরের মাধ্যমে মালিক পক্ষ অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশেষত যারা জমির মালিক তারা হয়েছেন সর্বস্বান্ত। কেননা চিংড়ি চাষের জন্য বছরের পর বছর ধরে জমিতে লোনা পানি জমিয়ে রাখা হয় বিধায় জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এর উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে আশপাশের জমি যেখানে চিংড়ি চাষ হয় না সেগুলোতেও লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে, উৎপাদন কমছে। পানির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ায় ওই পানিতে ভালো মাছ চাষও হয় না। ফলে এক পর্যায়ে দরিদ্র কৃষকরা বছরের পর বছর জমিতে উৎপাদন নেই দেখে বাধ্য হয়েই ঘের মালিকদের কাছে কম মূল্যে জমি বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। চিংড়ি ঘেরের মালিকরা এখন একতরফাভাবে মাছের বাজারও নিয়ন্ত্রণ করছেন। অথচ দুই যুগ আগে এই শীতে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে মাঠজুড়ে চোখে পড়ত সোনালি ফসল। নদী-নালা, খাল-বিলে ছিল প্রচুর মাছ, যা ছিল গ্রামের হতদরিদ্র জনসাধারণের আওতার মধ্যে। আর এখন গোলাভরা ধান সে তো স্বপ্নেরও অতীত। বিলজুড়ে গলাপানি। দরিদ্র জনগণের মাছ ধরার মতো এক রত্তি জায়গাও নেই, সব চিংড়ি ঘেরের মধ্যে ঢুকে গেছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে মংলা এবং এর আশপাশের এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার ক্রমাবনতি হয়েছে। এখন আর নবান্ন উৎসব জমে না। কৃষক পরিবারে মানসিক চাপ বাড়ছে। ধান উৎপাদন না হওয়ায় খড় হয় না। ফলে অসংখ্য কৃষক গরু-মহিষ পালন করা থেকে বিরত থাকছেন। পরিবারের সদস্যরা দুধ ও মাংসজাত প্রটিনের অভাবে ভুগছেন। অন্যদিকে গরু না থাকায় দেখা দিচ্ছে জৈবসারের অভাব। গ্রামের দরিদ্র মানুষের সার কেনার ক্ষমতাও সীমিত। ভিটাবাড়িতে যে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল বা সবজি চাষ করা সম্ভব হতো, জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা আর হয় না। দরিদ্র মানুষের পক্ষে বাজার থেকে আঙ্গুর, আপেল, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি কেনা সম্ভব হয় না। ফলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। পুরো এলাকা লবণ পানিতে আবদ্ধ থাকার কারণে এসব এলাকায় একদিকে যেমন জন্মাচ্ছে না নতুন গাছপালা, অন্যদিকে পুরাতন গাছগুলো নিস্তেজ হয়ে মারা যাচ্ছে। ফলে সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ক্ষতি করতে পারছে সহজেই। আবার বাস্তুতন্ত্র (ঊপড়ংুংঃবস) নষ্ট হওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে।
চিংড়ি ঘেরের রেণু পোনা হ্যাচারিতে উৎপন্ন হয়। সে সঙ্গে নদী থেকেও সংগ্রহ করা হয়। যারা নদীতে রেণু পোনা সংগ্রহ করে তারা সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ অন্য মাছের পোনা ধ্বংস করে_ সেসব পোনা বড় হলে আমাদের মাছের চাহিদা অনেকখানি পূরণ করত। আর ঘের যদি না থাকত তাহলে চিংড়ি পোনাগুলো সেখানেই বড় হতো, সেগুলো আমাদের গরিব চাষিরাই আবার ধরত। ফলে তাদের প্রোটিনের চাহিদাও পূরণ করে আর্থিকভাবে লাভবানও হতো এবং মাঠে ধানও উৎপাদন হতো।
আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জানি, এখানে নদীতে ২৪ ঘণ্টায় দু'বার জোয়ার ও দু'বার ভাটা হয়। ফলে দিনে দু'বার জোয়ারের পানিতে নদী-নালা, খাল-বিল ভরে যায় এবং ওই পানিই হাজার হাজার একর জমি থেকে খালের মাধ্যমে নদীতে নেমে যায়। ফলে নদীতে স্রোত থাকে প্রতিনিয়ত যা নদীকে নাব্য রাখে। অথচ বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামুদ্রিক বন্দর মংলা বন্দরের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম নাব্যতা সংকট। নদীর স্রোত হারিয়ে পলি জমে চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বড় জাহাজ এখন বন্দরে আসতে পারে না। এ নাব্যতা সংকটের একটি বড় কারণ চিংড়ি ঘের। দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার একর জমি খালের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে যুক্ত। ঘের মালিকরা এসব খালে বাঁধ দিয়ে জমিতে লবণ পানি আবদ্ধ করে চিংড়ি চাষ করেন। ফলে জমি-বিলের পানি নিয়মিত নদীতে যাওয়া-আসা করতে পারে না।
৮ জানুয়ারি সমকালে পশুর নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হবে এ সংক্রান্ত আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সমীক্ষা আছে, পরিকল্পনাহীনভাবে বৈধ-অবৈধ অসংখ্য বাঁধ স্থ্াপনের ফলে সমগ্র অঞ্চলের পানিপ্রবাহ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে। এখানকার নদীগুলোতে ড্রেজিং করলে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার পলি জমে ভরাট হয়ে যায়, ফলে অর্থের অপচয় হয়। তাই পশুর নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য এবং ড্রেজিংকে ফলপ্রসূ করার জন্য নদীর সঙ্গে সংযুক্ত সব খাল উন্মুক্ত করতে হবে। শুধু তাই নয়, সব বিলের পানি যাতে প্রতিনিয়ত খালের মাধ্যমে নদীতে প্রবাহিত হয় তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার ১৬তম কংগ্রেসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ বন্যা ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, নদীর তীর সংরক্ষণ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ভূমি উদ্ধার ও সড়ক উঁচুকরণের মতো বিভিন্ন খাতে এক হাজার কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে (প্রথম আলো, ১৭ মে ২০১১)। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পেছনে কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগই নয় বরং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ অন্যতম কারণ। চিংড়ি চাষ আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদনে যে পরিমাণ অর্থ সংযোগ করছে তার চেয়েও এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব মোকাবেলায় রাষ্ট্রের ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশি। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের অর্থনীতির ওপর। ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়নের গতি। অথচ পৃথিবীতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের লাভজনক খাত থেকে সরে এসে পরিবেশবান্ধব খাতকে উৎসাহিত করেছে এ ধরনের দেশের সংখ্যাও কম নয়। কেননা সাময়িকভাবে এসব খাত লাভজনক হলেও দীর্ঘমেয়াদে এগুলো ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূচনা ঘটায়। তাই দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ও কৃষককে রক্ষায় চিংড়ি চাষ খাতের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এখন এ দেশের সচেতন মানুষের অন্যতম দাবি।
ফ্রান্সিস হালদার :কৃষিবিদ ও উন্নয়ন কর্মী
সরেজমিন ওইসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক চিংড়ি ঘেরের মালিক অবমুক্ত খালগুলোর পাশের বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যে বাঁধের মতো ঘিরে ফেলতে শুরু করেছেন। ফলে লোনা পানি যা বহু বছর ধরে চিংড়ি চাষের জন্য জমিতে আটকে রাখা হয়েছিল তা সেখানেই থেকে যাচ্ছে। ফলে দুটি আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, অন্যান্য চিংড়ি ঘেরের মালিক যাদের অবৈধ বাঁধ খালগুলোর ওপর ছিল এবং আশপাশের কৃষি জমির মালিক সবার মধ্যে নিজ জমিতে ঘের দিয়ে লোনা পানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষ করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কেননা নিজ জমিতে ঘের দেওয়া অবৈধ নয় বিধায় চিংড়ি চাষে সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। ফলে লোনা পানিজনিত সমস্যা সমস্যাই থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, খালের দু'পাশকে এভাবে ঘিরে ফেলায় বর্ষাকালে যখন খালে পানির পরিমাণ বেড়ে যাবে, তখন এই অতিরিক্ত পানি আশপাশের জমিতে ঢুকতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে পানির প্রবল চাপে ঘের ভেঙে মারাত্মক বন্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা চারপাশের বসতবাড়ির জন্য হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
আমরা শুনে থাকি, চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে প্রতিবছর ২%-এর কিছু বেশি অর্থ যোগ করছে। বর্তমানে মংলা এলাকায় যারা বসবাস করেন তাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সুশীল সমাজের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন চিংড়ি চাষের ফলে পরিবেশের যে বিপর্যয়ে ফসল উৎপাদন যে হারে বিঘি্নত হচ্ছে তার আর্থিক মূল্য এই খাত থেকে যে অর্থ উপার্জন হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। চিংড়ি ঘেরের মাধ্যমে মালিক পক্ষ অর্থবিত্তের অধিকারী হয়েছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশেষত যারা জমির মালিক তারা হয়েছেন সর্বস্বান্ত। কেননা চিংড়ি চাষের জন্য বছরের পর বছর ধরে জমিতে লোনা পানি জমিয়ে রাখা হয় বিধায় জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এর উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে আশপাশের জমি যেখানে চিংড়ি চাষ হয় না সেগুলোতেও লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে, উৎপাদন কমছে। পানির গুণাগুণ নষ্ট হওয়ায় ওই পানিতে ভালো মাছ চাষও হয় না। ফলে এক পর্যায়ে দরিদ্র কৃষকরা বছরের পর বছর জমিতে উৎপাদন নেই দেখে বাধ্য হয়েই ঘের মালিকদের কাছে কম মূল্যে জমি বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। চিংড়ি ঘেরের মালিকরা এখন একতরফাভাবে মাছের বাজারও নিয়ন্ত্রণ করছেন। অথচ দুই যুগ আগে এই শীতে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে মাঠজুড়ে চোখে পড়ত সোনালি ফসল। নদী-নালা, খাল-বিলে ছিল প্রচুর মাছ, যা ছিল গ্রামের হতদরিদ্র জনসাধারণের আওতার মধ্যে। আর এখন গোলাভরা ধান সে তো স্বপ্নেরও অতীত। বিলজুড়ে গলাপানি। দরিদ্র জনগণের মাছ ধরার মতো এক রত্তি জায়গাও নেই, সব চিংড়ি ঘেরের মধ্যে ঢুকে গেছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে মংলা এবং এর আশপাশের এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার ক্রমাবনতি হয়েছে। এখন আর নবান্ন উৎসব জমে না। কৃষক পরিবারে মানসিক চাপ বাড়ছে। ধান উৎপাদন না হওয়ায় খড় হয় না। ফলে অসংখ্য কৃষক গরু-মহিষ পালন করা থেকে বিরত থাকছেন। পরিবারের সদস্যরা দুধ ও মাংসজাত প্রটিনের অভাবে ভুগছেন। অন্যদিকে গরু না থাকায় দেখা দিচ্ছে জৈবসারের অভাব। গ্রামের দরিদ্র মানুষের সার কেনার ক্ষমতাও সীমিত। ভিটাবাড়িতে যে বিভিন্ন ধরনের ফলমূল বা সবজি চাষ করা সম্ভব হতো, জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় তা আর হয় না। দরিদ্র মানুষের পক্ষে বাজার থেকে আঙ্গুর, আপেল, পেঁপে, পেয়ারা ইত্যাদি কেনা সম্ভব হয় না। ফলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। পুরো এলাকা লবণ পানিতে আবদ্ধ থাকার কারণে এসব এলাকায় একদিকে যেমন জন্মাচ্ছে না নতুন গাছপালা, অন্যদিকে পুরাতন গাছগুলো নিস্তেজ হয়ে মারা যাচ্ছে। ফলে সিডর, আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ক্ষতি করতে পারছে সহজেই। আবার বাস্তুতন্ত্র (ঊপড়ংুংঃবস) নষ্ট হওয়ার ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে।
চিংড়ি ঘেরের রেণু পোনা হ্যাচারিতে উৎপন্ন হয়। সে সঙ্গে নদী থেকেও সংগ্রহ করা হয়। যারা নদীতে রেণু পোনা সংগ্রহ করে তারা সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ অন্য মাছের পোনা ধ্বংস করে_ সেসব পোনা বড় হলে আমাদের মাছের চাহিদা অনেকখানি পূরণ করত। আর ঘের যদি না থাকত তাহলে চিংড়ি পোনাগুলো সেখানেই বড় হতো, সেগুলো আমাদের গরিব চাষিরাই আবার ধরত। ফলে তাদের প্রোটিনের চাহিদাও পূরণ করে আর্থিকভাবে লাভবানও হতো এবং মাঠে ধানও উৎপাদন হতো।
আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জানি, এখানে নদীতে ২৪ ঘণ্টায় দু'বার জোয়ার ও দু'বার ভাটা হয়। ফলে দিনে দু'বার জোয়ারের পানিতে নদী-নালা, খাল-বিল ভরে যায় এবং ওই পানিই হাজার হাজার একর জমি থেকে খালের মাধ্যমে নদীতে নেমে যায়। ফলে নদীতে স্রোত থাকে প্রতিনিয়ত যা নদীকে নাব্য রাখে। অথচ বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামুদ্রিক বন্দর মংলা বন্দরের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম নাব্যতা সংকট। নদীর স্রোত হারিয়ে পলি জমে চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বড় জাহাজ এখন বন্দরে আসতে পারে না। এ নাব্যতা সংকটের একটি বড় কারণ চিংড়ি ঘের। দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার একর জমি খালের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে যুক্ত। ঘের মালিকরা এসব খালে বাঁধ দিয়ে জমিতে লবণ পানি আবদ্ধ করে চিংড়ি চাষ করেন। ফলে জমি-বিলের পানি নিয়মিত নদীতে যাওয়া-আসা করতে পারে না।
৮ জানুয়ারি সমকালে পশুর নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হবে এ সংক্রান্ত আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সমীক্ষা আছে, পরিকল্পনাহীনভাবে বৈধ-অবৈধ অসংখ্য বাঁধ স্থ্াপনের ফলে সমগ্র অঞ্চলের পানিপ্রবাহ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে। এখানকার নদীগুলোতে ড্রেজিং করলে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার পলি জমে ভরাট হয়ে যায়, ফলে অর্থের অপচয় হয়। তাই পশুর নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য এবং ড্রেজিংকে ফলপ্রসূ করার জন্য নদীর সঙ্গে সংযুক্ত সব খাল উন্মুক্ত করতে হবে। শুধু তাই নয়, সব বিলের পানি যাতে প্রতিনিয়ত খালের মাধ্যমে নদীতে প্রবাহিত হয় তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার ১৬তম কংগ্রেসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ বন্যা ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, নদীর তীর সংরক্ষণ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, ভূমি উদ্ধার ও সড়ক উঁচুকরণের মতো বিভিন্ন খাতে এক হাজার কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে (প্রথম আলো, ১৭ মে ২০১১)। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পেছনে কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগই নয় বরং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ অন্যতম কারণ। চিংড়ি চাষ আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদনে যে পরিমাণ অর্থ সংযোগ করছে তার চেয়েও এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব মোকাবেলায় রাষ্ট্রের ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশি। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের অর্থনীতির ওপর। ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়নের গতি। অথচ পৃথিবীতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের লাভজনক খাত থেকে সরে এসে পরিবেশবান্ধব খাতকে উৎসাহিত করেছে এ ধরনের দেশের সংখ্যাও কম নয়। কেননা সাময়িকভাবে এসব খাত লাভজনক হলেও দীর্ঘমেয়াদে এগুলো ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূচনা ঘটায়। তাই দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ও কৃষককে রক্ষায় চিংড়ি চাষ খাতের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এখন এ দেশের সচেতন মানুষের অন্যতম দাবি।
ফ্রান্সিস হালদার :কৃষিবিদ ও উন্নয়ন কর্মী
No comments