শিক্ষাবাণিজ্য বনাম জনপ্রত্যাশা by সারওয়াত জাহান উর্মি
গত ৩ ডিসেম্বর রাজধানীর মনিপুর স্কুলে অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায় করা সংক্রান্ত অভিযোগের ভিত্তিতে আরটিভির স্টাফ রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান ও মিরপুর অঞ্চলের প্রতিনিধি ওই স্কুলে গেলে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কর্তৃক ওই সাংবাদিকরা যেভাবে নাজেহাল হয়েছেন, তা টিভির পর্দায় দেখে বিস্মিত ও বাকরুদ্ধ হতে হয়। মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজকে রাজধানীর প্রথম সারির স্কুল হিসেবে গণ্য করা হয়।
যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তা সেটি প্রথম সারির হোক বা না হোক, সমাজের পবিত্র এবং স্পর্শকাতর স্থান বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন, মেধার সুষ্ঠু বিকাশ ও মানসিক উৎকর্ষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া, শৃঙ্খলাবোধ, নৈতিকতা, আদব-কায়দা প্রভৃতি শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা, একের সঙ্গে অন্যের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক, শিক্ষা-সংস্কৃতির আদান-প্রদানসহ বহুবিধ কর্মপরায়ণতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। মনিপুর স্কুলে ঘটে যাওয়া অঘটনের মধ্য দিয়ে সমাজের যে চিত্র দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হয়েছে, তা সমগ্র জাতির জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। ওখানে ভর্তি-বাণিজ্য, সন্ত্রাস, ক্ষমতার অপব্যবহার, সর্বোপরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সাংবাদিকদের প্রতি আক্রোশমূলক আচরণ কী প্রমাণ করে? কেউ যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো পবিত্রতম জায়গায় ন্যক্কারজনক কাজ করেন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদকর্মীরা তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাঁদের ক্যাডারবাহিনীর হাতে নাজেহাল হতে হবে? গণতন্ত্রের শর্তে যদি থাকে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা, তবে রাজনীতিবিদদের এ কোন ধরনের গণতান্ত্রিক আচরণ? এর চেয়ে লজ্জাকর, ধিক্কৃত, জঘন্য বিষয় আর কী হতে পারে? শিক্ষাই যদি হয় একটি জাতির মেরুদণ্ড, তবে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কেন এত দুর্নীতি আর অরাজকতা? আমাদের সন্তানরা তাদের বিদ্যাপীঠ থেকে কী শিক্ষা গ্রহণ করবে? একটি সুস্থ সমাজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো স্পর্শকাতর স্থানে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলতে পারে না। বস্তুত সুস্থ রাজনৈতিক চিন্তা করা, সুস্থ মতামত প্রদান করা প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক অধিকার। কিন্তু আমাদের দেশের কোনো কোনো রাজনীতিবিদকে দেখে মনে হয়, 'রাজনীতি' শুধু একটি অসৎ ব্যবসাই নয়, সন্ত্রাস চালানোর একটি যথোপযুক্ত ক্ষেত্রও বটে_যা একটি রাজনৈতিক দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য যথেষ্ট। এসব নেতার লালিত কিছু দুর্নীতিবাজ আর দুর্বৃত্তদের মধ্যে 'রাজনীতি'কে শেকল পরানোর পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ, তা মনিপুর স্কুলের ন্যক্কারজনক ঘটনা দেখার পর বলার অপেক্ষা রাখে না। জনগণ যখন কাউকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে।
স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো সমস্যায় তাঁদের ধৈর্য, সহ্য, উদারতা এবং সহৃদয়তার মধ্য দিয়ে সমাধান বা প্রতিকার জনগণের ঐকান্তিক দাবি। কিন্তু আমরা দেখছি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত কোনো কোনো প্রতিনিধি জনগণের জন্য রীতিমতো হুমকি। যেকোনো বিষয়ে দেশবাসীর কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরার অধিকার সাংবাদিকদের অবশ্যই আছে। জনগণেরও আছে জানার অধিকার। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? সাংবাদিকদের দেখা মাত্রই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও তার সহযোগীরা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করলেন, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। প্রশ্ন জাগে, কোন সমাজে বাস করছি আমরা? আমাদের নৈতিক অবক্ষয় কোথায় গিয়ে পেঁৗছেছে? আমরা কি আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণের হাত থেকে আদৌ মুক্ত করতে পারব?
লেখক : চাকরিজীবী
No comments