বৈদেশিক মুদ্রা-লেনদেন-পরিস্থিতিতে বিপৎসংকেত by ফারুক মঈনউদ্দীন
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের প্রধানতম চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি দূর করা। বিষয়টি আচমকা আলোচনার পাদপ্রদীপের নিচে চলে আসার মূল কারণ, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের আচমকা ঊর্ধ্বগতি। এই ঊর্ধ্বাভিমুখী যাত্রা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে সেটা এখনই ঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।
তবে স্বভাবতই ধারণা করা যায়, বিদেশি মুদ্রার অন্তর্মুখী ধারা বাড়াতে না পারলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। অবশ্য টাকা ডলারের বিনিময় হারের এই ধারা ভারতের মতো দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির দেশেও শুরু হয়েছে এবং তার মূল কারণ ইউরোপীয় সংকট।
বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) বলতে আমরা বুঝি একটি দেশের সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং ব্যয়ের বাৎসরিক হিসাব। এই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয়, এবং ব্যয়ের ক্ষেত্র হচ্ছে আমদানি ব্যয়। আমদানি ব্যয় এবং রপ্তানি আয়ের পার্থক্যকে বলা হয় বাণিজ্য ভারসাম্য (ব্যালান্স অব ট্রেড)। রপ্তানি আয়ের চাইতে আমদানি ব্যয় বেশি হলে সেই অবস্থাকে বলে বাণিজ্য ঘাটতি এবং বিপরীত অবস্থা হচ্ছে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত। এসব ব্যয় এবং আয়ের সঙ্গে যদি যথাক্রমে অন্যান্য সেবা খরচ, যেমন বিদেশে চিকিৎসা, ভ্রমণ, শিক্ষা, বিদেশি বিশেষজ্ঞ ভাতা ও অদৃশ্য অন্যান্য খরচ এবং অনিবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ ও অন্যান্য কমিশন, ডিসকাউন্ট ইত্যাদি আয় যোগ করা হয়, তার সবগুলো একসঙ্গে মিলে হয় চলতি হিসাব (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট)। চলতি হিসাবের আয়-ব্যয়ের মধ্যকার পার্থক্য হচ্ছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য। একইভাবে চলতি হিসাবে বৈদেশিক আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে সেটা হয় ঘাটতি। আরেকটি খাত হচ্ছে বিদেশিদের সরাসরি বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের অন্তর্মুখী প্রবাহ এবং বাংলাদেশিদের বিদেশে যদি কোনো বৈধ বিনিয়োগ থাকে তার বহির্মুখী প্রবাহ—যা অন্তর্ভুক্ত হয় ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে। কারেন্ট ও ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের এই দুটি হিসাবের সমস্ত লেনদেন মিলেই হয় লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট)। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাণিজ্য ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়েও কিন্তু লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হওয়া যায়, যদি রপ্তানি ছাড়া অন্যান্য সব খাতে অন্তর্মুখী প্রবাহ বহির্মুখী প্রবাহের চেয়ে বেশি থাকে এবং তা বাণিজ্য ঘাটতির চেয়েও বেশি হয়।
হিসাববিজ্ঞানের স্থিতিপত্রের (ব্যালান্স শিট) মতো লেনদেন ভারসাম্যেও আয়-ব্যয় হিসাবে সব সময় সমতা রক্ষা করা হয়। রপ্তানি আয়, বিদেশি রেমিট্যান্স এবং বিদেশি বিনিয়োগ মিলিয়ে অন্তর্মুখী প্রবাহ যদি মোট বহির্মুখী প্রবাহের চেয়ে কম অর্থাৎ ঋণাত্মক হয়, তাহলে সেই ঘাটতি মিটিয়ে সমতা রক্ষা করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত বিদেশি মুদ্রার মজুদ থেকে। এই ঘাটতি যদি ক্রমাগত চলতে থাকে, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ফুরিয়ে যায় এবং সরকারকে যেকোনো মূল্যে গ্রহণ করতে হয় বৈদেশিক ঋণ। অতএব, একটা দেশের ব্যলান্স অব পেমেন্ট সে দেশের অর্থনৈতিক সংগতি এবং অর্থনীতির বিভিন্ন দিক দিয়ে গুরুত্ববহ। চলতি হিসাবে লেনদেনের পরিমাণ সে দেশের উন্মুক্ত অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাঞ্চল্য নির্দেশ করে। ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের লেনদেনের পরিমাণ দিয়ে বোঝা যায়, একটি দেশের সুসংগঠিত পুঁজিবাজারের অস্তিত্ব। কোনো দেশের লেনদেন ভারসাম্য যদি উদ্বৃত্ত হয় তার অর্থ হচ্ছে সে দেশে অন্তর্মুখী বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ বহির্মুখী প্রবাহের চেয়ে বেশি, ফলে স্থানীয় মুদ্রার তুলনায় বিদেশি মুদ্রার দাম হবে কম, আর বিপরীত অবস্থায় বিদেশি মুদ্রা হবে মহার্ঘ্য। ফলে একটা সুগঠিত ব্যালান্স অব পেমেন্ট তথা উদ্বৃত্ত ভারসাম্য কিংবা স্থিতিশীল বিদেশি মুদ্রার মজুদ দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির মূল উৎস, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে। সাধারণত ধরা হয়, কোনো দেশের বিদেশি মুদ্রার মজুদ যদি কমপক্ষে সে দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারে সেটি হয় কাঙ্ক্ষিত মজুদ। তবে ব্যালান্স অব পেমেন্টের উপাদানসমূহের কাঙ্ক্ষিত অনুপাত দেশ ও অর্থনীতিভেদে ভিন্ন হতে পারে। একটা শিল্পোন্নত দেশে উদ্বৃত্ত ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের চেয়েও বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেশি কাম্য। কারণ, সেসব দেশে বিদেশি পুঁজির প্রয়োজন থাকে না। আবার অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল পুঁজি-বিরল দেশে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের অন্তর্মুখী প্রবাহের প্রয়োজন বেশি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা বদলে যাওয়ার আগে ব্যালান্স অব পেমেন্টের মূল মাপকাঠি ছিল উদ্বৃত্ত বাণিজ্য। কিন্তু কালক্রমে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা এবং অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একটি দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যে চলতি হিসাবের চেয়ে ক্যাপিটাল হিসাবের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। সে কারণে দেশের মুদ্রা বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা স্থিতিশীল পরিবেশ সেই দেশ এবং সে দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে খুবই গুরুত্ববহ। অবশ্য কেবল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছেই নয়, দেশীয় নীতি-নির্ধারকদের জন্যও উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে বৈদেশিক মুদ্রার অন্তর্মুখী প্রবাহ এবং মজুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে সুদূর পরাহত, তবে লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত রক্ষা সম্ভব হতো যদি বাণিজ্যবহির্ভূত অন্যান্য আয়, যথা—বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বিদেশি বিনিয়োগ এবং বিদেশি সাহায্যের অন্তর্মুখী প্রবাহ পর্যাপ্ত হতো। এই পরিস্থিতি একসময় আমাদের অর্থনীতিতে ছিল, মূলত ২০০০ সালের পর থেকে আমাদের চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত শুরু হয়, ফলে বিদেশি মুদ্রার একটা মজুদ গড়ে উঠে ১১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এই স্বস্তি দীর্ঘদিন বজায় থাকলেও গত বছর শেষ দিক থেকে সেই স্বস্তি কমে আসছিল। বর্তমান বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং গত তিন বছরের মধ্যে আমাদের রিজার্ভ নেমে এসেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অথচ সদ্যসমাপ্ত বছরে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বিদেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে, যার পরিমাণ এক হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এই বিশাল পরিমাণের রেমিট্যান্স প্রবাহও রিজার্ভের অধোগতি রোধ করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালের রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল গত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। অথচ এই বাড়তি রেমিট্যান্স প্রবাহের সব সুফল খেয়ে নিচ্ছে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি তথা চলতি হিসাবের ঘাটতি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময় থেকে ৮৯ কোটি ডলার বেশি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ ও সাহায্যের ক্ষীয়মাণ ধারা। ফলে বিদেশে কর্মরত পৌনে এক কোটি জনশক্তির প্রত্যাবাসিত রেকর্ড পরিমাণ আয় লেনদেন ভারসাম্যের নিম্নাভিমুখী গতিকে ঠেকাতে পারছে না। এমনকি চলতি হিসাবে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান বৃদ্ধি পেলেও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতির কোনো সুরাহা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো টান পড়েছে বিদেশি সাহায্যে, এমনকি ঋণেও। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো বিভিন্ন শর্তারোপ করে যে সহায়তা ও ঋণ মঞ্জুর করে তার প্রতিশ্রুতি ও প্রবাহ কমে যাওয়া এবং বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্তমান বিনিময় হারের এই দুরবস্থা। বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতির কারণে রিজার্ভ যদি আরও কমে যায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে আসবে। শুধু বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কিংবা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশের কারণে নয়, নতুন করে শুরু হওয়া ইউরোপীয় সংকট বিদেশি বিনিয়োগ, সহায়তা এবং ঋণ প্রাপ্তির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের বর্তমান অবদান ধরে রাখা সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। গত অর্থবছরের শেষে পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪০ শতাংশেরও বেশি, বর্তমান অর্থবছরের অর্ধেক পেরিয়ে গেলে দেখা যায়, এই প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে প্রায় অর্ধেক।
বর্তমান ডলার সংকটের কারণ হিসেবে অবৈধ পথে বিদেশি মুদ্রার ব্যাপক উড্ডয়ন কিংবা বিশাল অঙ্কের রপ্তানি আয়ের অপ্রত্যাবাসনকে দায়ী করলেও সেটি বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। কারণ অপ্রত্যাবাসিত কিংবা বিলম্বিত রপ্তানি আয় অথবা বিদেশি মুদ্রার পাচার আমাদের মতো দেশের জন্য একটা ঐতিহাসিক সত্য, এই বিষয়টি আচমকা বেড়ে গেছে এমন কোনো সংগত কারণ নেই। বরং জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই বাণিজ্য ভারসাম্যে বড় ধরনের একটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটিকে রোধ করার তাৎক্ষণিক কোনো পন্থা নেই, যদি বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং সহায়তার পরিমাণ না বাড়ে। তার ওপর, টাকা ডলার বিনিময় হারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে তাকে রোধ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি আরও তীব্রতর হবে, বিপন্ন হবে সাধারণ মানুষ। অথচ তৈরি পোশাকশিল্প এবং প্রবাসী রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা যাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে বিদেশে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারলে কিংবা রপ্তানিযোগ্য পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো গেলে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমানো সম্ভব হতে পারে। যেমন রপ্তানি বাণিজ্যে জাহাজ নির্মাণশিল্প একটি নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের আয় দেশে প্রেরণ সহজতর করাও একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এনজিওর সহযোগে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এ পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার সুফল আজ অনেকেই ভোগ করছেন। এ ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে শ্রমবাজার বাড়ানো গেলে ব্যাংকগুলোর তৎপরতাও বৃদ্ধি পাবে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসদ্রব্যের আমদানি হ্রাস করতে আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু আমাদের মতো নৈতিকতার দেশে কেবল আহ্বান জানানো যথেষ্ট নয়। এসব আমদানি নিষিদ্ধ করা যাবে না, তবে নিরুৎসাহিত করা যায়। বিশেষ বিশেষ পণ্যের জন্য আমদানি ঋণ বন্ধ করা কিংবা সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া, শতভাগ মার্জিন আদায়ের বিধান করা, উচ্চহারে আমদানি শুল্ক আরোপ করার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কিছুটা সুফল হয়তো পাওয়া যেতে পারে। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় সমস্যা হচ্ছে রাজস্বনীতি এবং মুদ্রানীতির মধ্যে অসামঞ্জস্যতা। এটি দূর করতে না পারলে বহু ভালো কাজের সুফল ঘরে তোলা যাবে না।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) বলতে আমরা বুঝি একটি দেশের সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং ব্যয়ের বাৎসরিক হিসাব। এই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয়, এবং ব্যয়ের ক্ষেত্র হচ্ছে আমদানি ব্যয়। আমদানি ব্যয় এবং রপ্তানি আয়ের পার্থক্যকে বলা হয় বাণিজ্য ভারসাম্য (ব্যালান্স অব ট্রেড)। রপ্তানি আয়ের চাইতে আমদানি ব্যয় বেশি হলে সেই অবস্থাকে বলে বাণিজ্য ঘাটতি এবং বিপরীত অবস্থা হচ্ছে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত। এসব ব্যয় এবং আয়ের সঙ্গে যদি যথাক্রমে অন্যান্য সেবা খরচ, যেমন বিদেশে চিকিৎসা, ভ্রমণ, শিক্ষা, বিদেশি বিশেষজ্ঞ ভাতা ও অদৃশ্য অন্যান্য খরচ এবং অনিবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ ও অন্যান্য কমিশন, ডিসকাউন্ট ইত্যাদি আয় যোগ করা হয়, তার সবগুলো একসঙ্গে মিলে হয় চলতি হিসাব (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট)। চলতি হিসাবের আয়-ব্যয়ের মধ্যকার পার্থক্য হচ্ছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য। একইভাবে চলতি হিসাবে বৈদেশিক আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে সেটা হয় ঘাটতি। আরেকটি খাত হচ্ছে বিদেশিদের সরাসরি বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের অন্তর্মুখী প্রবাহ এবং বাংলাদেশিদের বিদেশে যদি কোনো বৈধ বিনিয়োগ থাকে তার বহির্মুখী প্রবাহ—যা অন্তর্ভুক্ত হয় ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টে। কারেন্ট ও ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের এই দুটি হিসাবের সমস্ত লেনদেন মিলেই হয় লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট)। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাণিজ্য ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়েও কিন্তু লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত হওয়া যায়, যদি রপ্তানি ছাড়া অন্যান্য সব খাতে অন্তর্মুখী প্রবাহ বহির্মুখী প্রবাহের চেয়ে বেশি থাকে এবং তা বাণিজ্য ঘাটতির চেয়েও বেশি হয়।
হিসাববিজ্ঞানের স্থিতিপত্রের (ব্যালান্স শিট) মতো লেনদেন ভারসাম্যেও আয়-ব্যয় হিসাবে সব সময় সমতা রক্ষা করা হয়। রপ্তানি আয়, বিদেশি রেমিট্যান্স এবং বিদেশি বিনিয়োগ মিলিয়ে অন্তর্মুখী প্রবাহ যদি মোট বহির্মুখী প্রবাহের চেয়ে কম অর্থাৎ ঋণাত্মক হয়, তাহলে সেই ঘাটতি মিটিয়ে সমতা রক্ষা করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত বিদেশি মুদ্রার মজুদ থেকে। এই ঘাটতি যদি ক্রমাগত চলতে থাকে, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ফুরিয়ে যায় এবং সরকারকে যেকোনো মূল্যে গ্রহণ করতে হয় বৈদেশিক ঋণ। অতএব, একটা দেশের ব্যলান্স অব পেমেন্ট সে দেশের অর্থনৈতিক সংগতি এবং অর্থনীতির বিভিন্ন দিক দিয়ে গুরুত্ববহ। চলতি হিসাবে লেনদেনের পরিমাণ সে দেশের উন্মুক্ত অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চাঞ্চল্য নির্দেশ করে। ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের লেনদেনের পরিমাণ দিয়ে বোঝা যায়, একটি দেশের সুসংগঠিত পুঁজিবাজারের অস্তিত্ব। কোনো দেশের লেনদেন ভারসাম্য যদি উদ্বৃত্ত হয় তার অর্থ হচ্ছে সে দেশে অন্তর্মুখী বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ বহির্মুখী প্রবাহের চেয়ে বেশি, ফলে স্থানীয় মুদ্রার তুলনায় বিদেশি মুদ্রার দাম হবে কম, আর বিপরীত অবস্থায় বিদেশি মুদ্রা হবে মহার্ঘ্য। ফলে একটা সুগঠিত ব্যালান্স অব পেমেন্ট তথা উদ্বৃত্ত ভারসাম্য কিংবা স্থিতিশীল বিদেশি মুদ্রার মজুদ দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির মূল উৎস, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে। সাধারণত ধরা হয়, কোনো দেশের বিদেশি মুদ্রার মজুদ যদি কমপক্ষে সে দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারে সেটি হয় কাঙ্ক্ষিত মজুদ। তবে ব্যালান্স অব পেমেন্টের উপাদানসমূহের কাঙ্ক্ষিত অনুপাত দেশ ও অর্থনীতিভেদে ভিন্ন হতে পারে। একটা শিল্পোন্নত দেশে উদ্বৃত্ত ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের চেয়েও বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেশি কাম্য। কারণ, সেসব দেশে বিদেশি পুঁজির প্রয়োজন থাকে না। আবার অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল পুঁজি-বিরল দেশে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের অন্তর্মুখী প্রবাহের প্রয়োজন বেশি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা বদলে যাওয়ার আগে ব্যালান্স অব পেমেন্টের মূল মাপকাঠি ছিল উদ্বৃত্ত বাণিজ্য। কিন্তু কালক্রমে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা এবং অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একটি দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যে চলতি হিসাবের চেয়ে ক্যাপিটাল হিসাবের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। সে কারণে দেশের মুদ্রা বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা স্থিতিশীল পরিবেশ সেই দেশ এবং সে দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে খুবই গুরুত্ববহ। অবশ্য কেবল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছেই নয়, দেশীয় নীতি-নির্ধারকদের জন্যও উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে বৈদেশিক মুদ্রার অন্তর্মুখী প্রবাহ এবং মজুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে সুদূর পরাহত, তবে লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত রক্ষা সম্ভব হতো যদি বাণিজ্যবহির্ভূত অন্যান্য আয়, যথা—বাংলাদেশি শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বিদেশি বিনিয়োগ এবং বিদেশি সাহায্যের অন্তর্মুখী প্রবাহ পর্যাপ্ত হতো। এই পরিস্থিতি একসময় আমাদের অর্থনীতিতে ছিল, মূলত ২০০০ সালের পর থেকে আমাদের চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্ত শুরু হয়, ফলে বিদেশি মুদ্রার একটা মজুদ গড়ে উঠে ১১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এই স্বস্তি দীর্ঘদিন বজায় থাকলেও গত বছর শেষ দিক থেকে সেই স্বস্তি কমে আসছিল। বর্তমান বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং গত তিন বছরের মধ্যে আমাদের রিজার্ভ নেমে এসেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অথচ সদ্যসমাপ্ত বছরে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বিদেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে, যার পরিমাণ এক হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এই বিশাল পরিমাণের রেমিট্যান্স প্রবাহও রিজার্ভের অধোগতি রোধ করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালের রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল গত বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। অথচ এই বাড়তি রেমিট্যান্স প্রবাহের সব সুফল খেয়ে নিচ্ছে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি তথা চলতি হিসাবের ঘাটতি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময় থেকে ৮৯ কোটি ডলার বেশি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ ও সাহায্যের ক্ষীয়মাণ ধারা। ফলে বিদেশে কর্মরত পৌনে এক কোটি জনশক্তির প্রত্যাবাসিত রেকর্ড পরিমাণ আয় লেনদেন ভারসাম্যের নিম্নাভিমুখী গতিকে ঠেকাতে পারছে না। এমনকি চলতি হিসাবে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান বৃদ্ধি পেলেও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতির কোনো সুরাহা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো টান পড়েছে বিদেশি সাহায্যে, এমনকি ঋণেও। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো বিভিন্ন শর্তারোপ করে যে সহায়তা ও ঋণ মঞ্জুর করে তার প্রতিশ্রুতি ও প্রবাহ কমে যাওয়া এবং বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্তমান বিনিময় হারের এই দুরবস্থা। বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতির কারণে রিজার্ভ যদি আরও কমে যায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে আসবে। শুধু বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কিংবা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশের কারণে নয়, নতুন করে শুরু হওয়া ইউরোপীয় সংকট বিদেশি বিনিয়োগ, সহায়তা এবং ঋণ প্রাপ্তির ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তৈরি পোশাকশিল্পের বর্তমান অবদান ধরে রাখা সম্ভব হবে কি না তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। গত অর্থবছরের শেষে পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪০ শতাংশেরও বেশি, বর্তমান অর্থবছরের অর্ধেক পেরিয়ে গেলে দেখা যায়, এই প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে প্রায় অর্ধেক।
বর্তমান ডলার সংকটের কারণ হিসেবে অবৈধ পথে বিদেশি মুদ্রার ব্যাপক উড্ডয়ন কিংবা বিশাল অঙ্কের রপ্তানি আয়ের অপ্রত্যাবাসনকে দায়ী করলেও সেটি বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। কারণ অপ্রত্যাবাসিত কিংবা বিলম্বিত রপ্তানি আয় অথবা বিদেশি মুদ্রার পাচার আমাদের মতো দেশের জন্য একটা ঐতিহাসিক সত্য, এই বিষয়টি আচমকা বেড়ে গেছে এমন কোনো সংগত কারণ নেই। বরং জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই বাণিজ্য ভারসাম্যে বড় ধরনের একটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটিকে রোধ করার তাৎক্ষণিক কোনো পন্থা নেই, যদি বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং সহায়তার পরিমাণ না বাড়ে। তার ওপর, টাকা ডলার বিনিময় হারে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে তাকে রোধ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতি আরও তীব্রতর হবে, বিপন্ন হবে সাধারণ মানুষ। অথচ তৈরি পোশাকশিল্প এবং প্রবাসী রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা যাবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে বিদেশে নতুন বাজার সৃষ্টি করতে পারলে কিংবা রপ্তানিযোগ্য পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো গেলে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমানো সম্ভব হতে পারে। যেমন রপ্তানি বাণিজ্যে জাহাজ নির্মাণশিল্প একটি নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের আয় দেশে প্রেরণ সহজতর করাও একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এনজিওর সহযোগে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এ পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার সুফল আজ অনেকেই ভোগ করছেন। এ ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে শ্রমবাজার বাড়ানো গেলে ব্যাংকগুলোর তৎপরতাও বৃদ্ধি পাবে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসদ্রব্যের আমদানি হ্রাস করতে আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু আমাদের মতো নৈতিকতার দেশে কেবল আহ্বান জানানো যথেষ্ট নয়। এসব আমদানি নিষিদ্ধ করা যাবে না, তবে নিরুৎসাহিত করা যায়। বিশেষ বিশেষ পণ্যের জন্য আমদানি ঋণ বন্ধ করা কিংবা সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া, শতভাগ মার্জিন আদায়ের বিধান করা, উচ্চহারে আমদানি শুল্ক আরোপ করার মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কিছুটা সুফল হয়তো পাওয়া যেতে পারে। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় সমস্যা হচ্ছে রাজস্বনীতি এবং মুদ্রানীতির মধ্যে অসামঞ্জস্যতা। এটি দূর করতে না পারলে বহু ভালো কাজের সুফল ঘরে তোলা যাবে না।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments