সাম্প্রতিক-অস্তিত্ব রক্ষার রাজনীতিতে বেপরোয়া জামায়াত-শিবির!-জোট সরকারের ব্যর্থতা_বিএনপির অদূরদর্শিতা by শাকিল ফারুক
ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপন করতে গিয়েছিলাম নেত্রকোনার বিরিশিরিতে। সঙ্গে আরো কয়েকজন সংবাদকর্মী সহকর্মী। বিরিশিরি এবং এর আশপাশের অঞ্চলে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী আদিবাসীদের বসতি। নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন তাই এলাহি। আমাদের রেস্ট হাউসের পাশে এক আদিবাসী বাড়িতে কীর্তনের সুরে সুরে নাচ। জুটেছে অনেক লোক। বিরাট হল্লা। হৈ-হল্লার মধ্যে হঠাৎ হাজির হলেন মোস্তাক আহমেদ রুহী। স্থানীয় সংসদ সদস্য (নেত্রকোনা-১)।
মফস্বল এলাকাগুলোতে সংসদ সদস্যের আগমন নিয়ে বরাবরই যেমন উৎসব উৎসব আমেজ দেখেছি, কিন্তু এখানে তেমন কিছু নেই। রুহীর আগমন নিয়ে কাউকে বিচলিত বা ব্যস্ত হতে দেখলাম না। সবাই ব্যস্ত নিজের কাজে। এমপি সাহেব নিজেই আসন টেনে বসলেন। কেউ পান বা পানিটা এগিয়ে দিল বটে, কিন্তু তাতেও সংসদ সদস্যকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের লেশ নেই। ঘটনা কী?
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে! আমার সহকর্মীরা বেড়াতে গিয়েও এই রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যস্ত হলেন। জানা গেল আশান্বিত হওয়ার মতো তথ্য_নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচনী এলাকায় খুব একটা যাওয়ার দরকার থাকে না অধিকাংশ সংসদ সদস্যের। কিন্তু মোস্তাক রুহী এলাকার লোকজনের পাশে আছেন সব সময়। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিয়মিত খোঁজ নেন। এলাকায় ঘুরে বেড়ান বলতে গেলে একা একাই। অন্যদের মতো নিরাপত্তার বালাই দেখিয়ে চারপাশে ভীতিকর মানুষের দেয়াল নেই। তাই যে কেউ যেকোনো সমস্যা, অসুবিধা কিংবা প্রয়োজনের কথাগুলোও তাঁকে বলতে পারে সরাসরি। সংসদ সদস্যকে তাই দূরের কেউ নন, ঘরের লোক মনে করে সবাই। আর ঘরের লোককে নিয়ে আলাদা করে ভাবার কী আছে? হুটহাট নানা রকম অনুষ্ঠানে-আয়োজনে-প্রয়োজনে মোস্তাক আহমেদ রুহীর হাজির হয়ে যাওয়াটা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। কে কেমন অবস্থায় আছে বা কে কী, এগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কীর্তনবাড়িতে উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে রুহী কোলাকুলি করলেন, হাত মেলালেন। কোনো সংশয় নেই, নির্দ্বিধায় সবাইকে টেনে নিলেন বুকে। মহাজোটের অন্যতম তরুণ সংসদ সদস্য রুহী। এবারই প্রথম নির্বাচন করেছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন। নিজ এলাকার মানুষের 'আপন লোক' হয়ে গেছেন। একজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে জনগণের এমন সম্পর্কই থাকার কথা। এমন নিবেদিতপ্রাণ নেতা থাকবে যে দলে, সে দল অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
কিন্তু আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ দেওয়ার আগেই চোখে ভেসে ওঠে কামাল আহমেদ মজুমদারের মুখ। কামাল মজুমদার আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা। রুহীদের মতো তরুণ প্রজন্মের নেতার চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কর্মকাণ্ড বিবেচনা হবে বেশি। কামাল মজুমদারদের সম্পর্কে নানা কথাই আমরা শুনেছি, শুনছি। হয়তো আরো শুনব। এসব জানাশোনার কোনোটাই যে আশাজাগানিয়া বা ভালো কিছু নয়, তা বলাই বাহুল্য। কামাল মজুমদারের সর্বশেষ কৃতিত্ব_নারী সাংবাদিক লাঞ্ছনা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে মনিপুর স্কুলে বেশি টাকা আদায় করা হয়। এই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি কামাল মজুমদার। বেশি টাকা আদায়ের কাহিনী সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ায় তিনি সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেছেন নিজ হাতে। টিভি ফুটেজে সেই ঘটনার প্রমাণ বাঁধা আছে। কিন্তু সাংবাদিকরা তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন যখন, তখন কামাল মজুমদারকে বাঁচাতে তাঁর নির্বাচনী এলাকার লোকজন এগিয়ে আসেনি। উল্টো কামাল মজুমদারকে তাঁর নিজেরই এলাকাবাসী অবরুদ্ধ করে। পুলিশ এবং তাঁর পোষ্য সন্ত্রাসীরা উদ্ধার করেছে তাঁকে। কামাল মজুমদার সাংবাদিক লাঞ্ছনার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তিনি কি এই দাবি করার আগে টিভি দেখেননি?
মিথ্যাচার এখানেই শেষ হয় না। ঘটনার দিন দুয়েক বাদেই দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিভাবকদের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বিরোধিতা এবং কামাল মজুমদারের গুণগান গেয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়, যদিও অভিভাবক মহল নিজেরাই কামাল মজুমদারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পথে নেমেছেন। সেহেতু বিজ্ঞাপনের ভাষ্য কার, তা বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম উপেক্ষা করে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বেশি টাকায় আদায় হবে বলেও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কামাল মজুমদার। তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত। তবু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নিজের এই সংসদ সদস্যকে শাস্তির আওতায় না এনে তাঁর সমালোচিত এবং নিন্দনীয় কাজকর্মে একধরনের সম্মতি জানাল যেন সরকার। জনপ্রতিনিধিত্বের নামে সন্ত্রাস বা স্বেচ্ছাচারিতায় মত্ত নেতাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা না নিলে আওয়ামী লীগও বিএনপির মতো মানুষের আস্থা হারাবে। মোস্তাক আহমেদ রুহীদের মতো তরুণ নেতাদের প্রশংসনীয় রাজনীতি চর্চার খবর পড়ে থাকবে আড়ালে। প্রবীণদের হতাশার অন্ধকার তরুণের আশার আলোকে ঢেকে দেবে_সেটা কাম্য নয়।
জামায়াত যখন বেপরোয়া
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে গেল। যাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি, রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী, সেই গোলাম আজম এখন কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা, ছয়টি ষড়যন্ত্র, তিনটি পরিকল্পনা, ২৮টি উসকানি এবং ২৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। বাংলাদেশের জামায়াতের গুরু হিসেবে খ্যাত এই নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদীসহ শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতারা।
শীর্ষস্থানীয় নেতাদের রক্ষা এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচালে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে জামায়াত। সঙ্গে আছে ইসলামী ছাত্রশিবির। দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলতে মাঠে নেমেছে তারা। পুলিশের ওপর আক্রমণ এবং অস্ত্র ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, জামায়াত-শিবির দেশে ব্যাপক নাশকতার পরিকল্পনা করছে। পরিকল্পনা মোতাবেক জামায়াত নেতারা বেছে বেছে দলের এবং ছাত্র সংগঠনের তরুণ কর্মীদের নাশকতার স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন। গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নোয়াখালী থেকে কয়েক হাজার কর্মী ঢাকায় পেঁৗছেছে। তারা গুপ্তহত্যার মতো ঘটনাও ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের নেতারা এখন প্রচণ্ড বেপরোয়া এবং আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে বলে দাবি করলেও পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাঙালির প্রাণের দাবি। এই দাবি অবশ্যই পূরণ করতে হবে। সে জন্য সরকারকে আরো সতর্ক এবং কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি জামায়াত-শিবিরের সব অপকৌশল দমন করতে সোচ্চার হতে হবে সাধারণ মানুষকেও।
তত্ত্বাবধায়ক জটিলতা কাটবে তো!
কারো ঘরে সিঁদ কেটে চোর ঢুকে গেল। সেই চোর কিছু একটা চুরি করে নিয়ে যাওয়ার পর বা চুরির আগেই গৃহস্থ জেগে উঠলেন, চোর পালিয়ে গেল। তারপর যদি সেই গৃহস্থের বিন্দুমাত্র বোধবুদ্ধি থাকে, তাহলে তিনি প্রথমেই কী করবেন? অবশ্যই সিঁদ কেটে যে গর্তপথে চোর ঢুকেছিল, সেই গর্ত বন্ধের ব্যবস্থা করবেন। কোনোভাবেই চোরের সুবিধার্থে গর্ত খোলা রাখবেন না। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক সর্বশেষ অভিজ্ঞতার পর আর কোনো ওয়ান-ইলেভেন যেন না ঘটে, সেই লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশংসনীয় হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি লোপাটের সাহস করে উঠতে পারছে না বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। কারণ, প্রতিটি দলীয় সরকার ফের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বারবার নানা আয়োজনের চেষ্টা করেছে। তাই কেউ দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারছে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে এ ইস্যুতে যে যুদ্ধের দামামা বাজছে, তা শেষ পর্যন্ত কোন পরিণতি ডেকে আনে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না বটে, তবে পরিণতি যে সুখকর হবে না, তা বোঝা যাচ্ছে সহজেই।
এই সংকট উত্তরণে রাষ্ট্রপতি সংলাপের আয়োজন করেছেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সেই সংলাপে অংশ নিয়েছে, নিজেদের দাবি উত্থাপন করেছে। এই দাবি কেবল বিএনপির নয়, আরো অনেক রাজনৈতিক দলের। নাগরিক সমাজও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পক্ষে কথা বলেছে। উচ্চ আদালতের যে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে, সেই সিদ্ধান্তেও আদালত কমপক্ষে আরো দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু তা নিয়ে সরকারি দল মাথা ঘামাচ্ছে না। বরং একরোখাভাবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাদ দেওয়ার পক্ষে। আর সরকারের দায়িত্বশীল নেতা-কর্মীদের উসকানিমূলক কথাবার্তা পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে।
এর পেছনে বিএনপিরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। রোডমার্চ করে তারা পথে-ঘাটে আন্দোলন করছে, কিন্তু সংসদে গিয়ে দাবির কথা বলছে না। যদি দলটি দেশ এবং মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে থাকে, তাহলে সংসদ কার্যকর করার বিরাট দায়িত্ব তাদের কাঁধে। সংসদে তারা হাজির থাকলে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে মাত্র চার মিনিটে সরকারি দল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারত না। সেই হিসাবে বিএনপি এই সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে সুবিধা করে দিয়েছে বললে ভুল হবে না। এখন নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য বিএনপিকে ছাড় দিতে হবে। দেশকে আবারও বিশৃঙ্খলার চরম পথ থেকে উদ্ধারের জন্য তাদেরও সচেষ্ট হতে হবে। সে জন্য রাজপথের চেয়ে সংসদ হতে পারে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য উপযোগী স্থান।
বিএনপি সংসদে গেলে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে জনসমর্থন বাড়বে তাদের। তখন আওয়ামী লীগকেও অবশ্যই একগুঁয়েমির পথ পরিহার করতে হবে। জেদ নয়, আলোচনা এবং পরিকল্পনা বিনিময়ের মাধ্যমেই দেশকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। দেশ এবং মানুষকে ভালো রাখার দায় সরকার এবং প্রধান বিরোধী দলেরই সবচেয়ে বেশি।
ভুল সবই ভুল
আরো একটি নির্বাচন এবং আবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরাজয়। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিএনপির সাক্কু নির্বাচিত হলেন মেয়র। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে ভোট পেয়েছেন দ্বিগুণ। তাহলে কি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমছে? সরকার তিন বছরে নিজেদের কৃতিত্বের যতই দাবি তুলুক, মূলত প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। আর এখন প্রার্থী নির্বাচনেও একের পর এক ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে তারা। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন।
এসব পরাজয়ের কারণে কিছু পদ হাতছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগের। তাই নিয়ে কথা বলছেন অনেকে। কিন্তু পদ হাতছাড়া হওয়ার চেয়েও বড় কিছু ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে দলটির। আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা নিয়ে নানা রকম খেলাধুলা চলছে। সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, যার মাধ্যমে আওয়ামী সমর্থনও বিভক্ত হয়েছে। এবং সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সমর্থন বেশি যাঁর প্রতি, তাঁকেই অবহেলা করা হয়েছে। প্রার্থিতা বাছাইয়ের এই ভুলের কারণে সাংগঠনিক পর্যায়ে আওয়ামী সমর্থনে ফাটল দেখা দিচ্ছে। বছর দুয়েক বাদে যে সংসদ নির্বাচন, তাতে এই সমর্থনের বিভক্তির কারণে চড়া মূল্য গুনতে হতে পারে আওয়ামী লীগকে। এ সম্পর্কে দলের নীতিনির্ধারকদের মাথা ঘামানো উচিত।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে! আমার সহকর্মীরা বেড়াতে গিয়েও এই রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যস্ত হলেন। জানা গেল আশান্বিত হওয়ার মতো তথ্য_নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচনী এলাকায় খুব একটা যাওয়ার দরকার থাকে না অধিকাংশ সংসদ সদস্যের। কিন্তু মোস্তাক রুহী এলাকার লোকজনের পাশে আছেন সব সময়। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিয়মিত খোঁজ নেন। এলাকায় ঘুরে বেড়ান বলতে গেলে একা একাই। অন্যদের মতো নিরাপত্তার বালাই দেখিয়ে চারপাশে ভীতিকর মানুষের দেয়াল নেই। তাই যে কেউ যেকোনো সমস্যা, অসুবিধা কিংবা প্রয়োজনের কথাগুলোও তাঁকে বলতে পারে সরাসরি। সংসদ সদস্যকে তাই দূরের কেউ নন, ঘরের লোক মনে করে সবাই। আর ঘরের লোককে নিয়ে আলাদা করে ভাবার কী আছে? হুটহাট নানা রকম অনুষ্ঠানে-আয়োজনে-প্রয়োজনে মোস্তাক আহমেদ রুহীর হাজির হয়ে যাওয়াটা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। কে কেমন অবস্থায় আছে বা কে কী, এগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কীর্তনবাড়িতে উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে রুহী কোলাকুলি করলেন, হাত মেলালেন। কোনো সংশয় নেই, নির্দ্বিধায় সবাইকে টেনে নিলেন বুকে। মহাজোটের অন্যতম তরুণ সংসদ সদস্য রুহী। এবারই প্রথম নির্বাচন করেছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন। নিজ এলাকার মানুষের 'আপন লোক' হয়ে গেছেন। একজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে জনগণের এমন সম্পর্কই থাকার কথা। এমন নিবেদিতপ্রাণ নেতা থাকবে যে দলে, সে দল অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
কিন্তু আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ দেওয়ার আগেই চোখে ভেসে ওঠে কামাল আহমেদ মজুমদারের মুখ। কামাল মজুমদার আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা। রুহীদের মতো তরুণ প্রজন্মের নেতার চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কর্মকাণ্ড বিবেচনা হবে বেশি। কামাল মজুমদারদের সম্পর্কে নানা কথাই আমরা শুনেছি, শুনছি। হয়তো আরো শুনব। এসব জানাশোনার কোনোটাই যে আশাজাগানিয়া বা ভালো কিছু নয়, তা বলাই বাহুল্য। কামাল মজুমদারের সর্বশেষ কৃতিত্ব_নারী সাংবাদিক লাঞ্ছনা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে মনিপুর স্কুলে বেশি টাকা আদায় করা হয়। এই স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি কামাল মজুমদার। বেশি টাকা আদায়ের কাহিনী সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ায় তিনি সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেছেন নিজ হাতে। টিভি ফুটেজে সেই ঘটনার প্রমাণ বাঁধা আছে। কিন্তু সাংবাদিকরা তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন যখন, তখন কামাল মজুমদারকে বাঁচাতে তাঁর নির্বাচনী এলাকার লোকজন এগিয়ে আসেনি। উল্টো কামাল মজুমদারকে তাঁর নিজেরই এলাকাবাসী অবরুদ্ধ করে। পুলিশ এবং তাঁর পোষ্য সন্ত্রাসীরা উদ্ধার করেছে তাঁকে। কামাল মজুমদার সাংবাদিক লাঞ্ছনার কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। তিনি কি এই দাবি করার আগে টিভি দেখেননি?
মিথ্যাচার এখানেই শেষ হয় না। ঘটনার দিন দুয়েক বাদেই দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিভাবকদের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বিরোধিতা এবং কামাল মজুমদারের গুণগান গেয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়, যদিও অভিভাবক মহল নিজেরাই কামাল মজুমদারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পথে নেমেছেন। সেহেতু বিজ্ঞাপনের ভাষ্য কার, তা বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম উপেক্ষা করে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বেশি টাকায় আদায় হবে বলেও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কামাল মজুমদার। তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত। তবু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নিজের এই সংসদ সদস্যকে শাস্তির আওতায় না এনে তাঁর সমালোচিত এবং নিন্দনীয় কাজকর্মে একধরনের সম্মতি জানাল যেন সরকার। জনপ্রতিনিধিত্বের নামে সন্ত্রাস বা স্বেচ্ছাচারিতায় মত্ত নেতাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা না নিলে আওয়ামী লীগও বিএনপির মতো মানুষের আস্থা হারাবে। মোস্তাক আহমেদ রুহীদের মতো তরুণ নেতাদের প্রশংসনীয় রাজনীতি চর্চার খবর পড়ে থাকবে আড়ালে। প্রবীণদের হতাশার অন্ধকার তরুণের আশার আলোকে ঢেকে দেবে_সেটা কাম্য নয়।
জামায়াত যখন বেপরোয়া
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে গেল। যাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি, রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী, সেই গোলাম আজম এখন কারাগারে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি হত্যা, ছয়টি ষড়যন্ত্র, তিনটি পরিকল্পনা, ২৮টি উসকানি এবং ২৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। বাংলাদেশের জামায়াতের গুরু হিসেবে খ্যাত এই নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদীসহ শীর্ষস্থানীয় জামায়াত নেতারা।
শীর্ষস্থানীয় নেতাদের রক্ষা এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচালে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে জামায়াত। সঙ্গে আছে ইসলামী ছাত্রশিবির। দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলতে মাঠে নেমেছে তারা। পুলিশের ওপর আক্রমণ এবং অস্ত্র ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, জামায়াত-শিবির দেশে ব্যাপক নাশকতার পরিকল্পনা করছে। পরিকল্পনা মোতাবেক জামায়াত নেতারা বেছে বেছে দলের এবং ছাত্র সংগঠনের তরুণ কর্মীদের নাশকতার স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন। গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নোয়াখালী থেকে কয়েক হাজার কর্মী ঢাকায় পেঁৗছেছে। তারা গুপ্তহত্যার মতো ঘটনাও ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের নেতারা এখন প্রচণ্ড বেপরোয়া এবং আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে বলে দাবি করলেও পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাঙালির প্রাণের দাবি। এই দাবি অবশ্যই পূরণ করতে হবে। সে জন্য সরকারকে আরো সতর্ক এবং কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি জামায়াত-শিবিরের সব অপকৌশল দমন করতে সোচ্চার হতে হবে সাধারণ মানুষকেও।
তত্ত্বাবধায়ক জটিলতা কাটবে তো!
কারো ঘরে সিঁদ কেটে চোর ঢুকে গেল। সেই চোর কিছু একটা চুরি করে নিয়ে যাওয়ার পর বা চুরির আগেই গৃহস্থ জেগে উঠলেন, চোর পালিয়ে গেল। তারপর যদি সেই গৃহস্থের বিন্দুমাত্র বোধবুদ্ধি থাকে, তাহলে তিনি প্রথমেই কী করবেন? অবশ্যই সিঁদ কেটে যে গর্তপথে চোর ঢুকেছিল, সেই গর্ত বন্ধের ব্যবস্থা করবেন। কোনোভাবেই চোরের সুবিধার্থে গর্ত খোলা রাখবেন না। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিষয়ক সর্বশেষ অভিজ্ঞতার পর আর কোনো ওয়ান-ইলেভেন যেন না ঘটে, সেই লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশংসনীয় হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি লোপাটের সাহস করে উঠতে পারছে না বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। কারণ, প্রতিটি দলীয় সরকার ফের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বারবার নানা আয়োজনের চেষ্টা করেছে। তাই কেউ দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারছে না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে এ ইস্যুতে যে যুদ্ধের দামামা বাজছে, তা শেষ পর্যন্ত কোন পরিণতি ডেকে আনে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না বটে, তবে পরিণতি যে সুখকর হবে না, তা বোঝা যাচ্ছে সহজেই।
এই সংকট উত্তরণে রাষ্ট্রপতি সংলাপের আয়োজন করেছেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সেই সংলাপে অংশ নিয়েছে, নিজেদের দাবি উত্থাপন করেছে। এই দাবি কেবল বিএনপির নয়, আরো অনেক রাজনৈতিক দলের। নাগরিক সমাজও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পক্ষে কথা বলেছে। উচ্চ আদালতের যে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে, সেই সিদ্ধান্তেও আদালত কমপক্ষে আরো দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু তা নিয়ে সরকারি দল মাথা ঘামাচ্ছে না। বরং একরোখাভাবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাদ দেওয়ার পক্ষে। আর সরকারের দায়িত্বশীল নেতা-কর্মীদের উসকানিমূলক কথাবার্তা পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে।
এর পেছনে বিএনপিরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। রোডমার্চ করে তারা পথে-ঘাটে আন্দোলন করছে, কিন্তু সংসদে গিয়ে দাবির কথা বলছে না। যদি দলটি দেশ এবং মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে থাকে, তাহলে সংসদ কার্যকর করার বিরাট দায়িত্ব তাদের কাঁধে। সংসদে তারা হাজির থাকলে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে মাত্র চার মিনিটে সরকারি দল কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারত না। সেই হিসাবে বিএনপি এই সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে সুবিধা করে দিয়েছে বললে ভুল হবে না। এখন নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য বিএনপিকে ছাড় দিতে হবে। দেশকে আবারও বিশৃঙ্খলার চরম পথ থেকে উদ্ধারের জন্য তাদেরও সচেষ্ট হতে হবে। সে জন্য রাজপথের চেয়ে সংসদ হতে পারে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য উপযোগী স্থান।
বিএনপি সংসদে গেলে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে জনসমর্থন বাড়বে তাদের। তখন আওয়ামী লীগকেও অবশ্যই একগুঁয়েমির পথ পরিহার করতে হবে। জেদ নয়, আলোচনা এবং পরিকল্পনা বিনিময়ের মাধ্যমেই দেশকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। দেশ এবং মানুষকে ভালো রাখার দায় সরকার এবং প্রধান বিরোধী দলেরই সবচেয়ে বেশি।
ভুল সবই ভুল
আরো একটি নির্বাচন এবং আবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরাজয়। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিএনপির সাক্কু নির্বাচিত হলেন মেয়র। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে ভোট পেয়েছেন দ্বিগুণ। তাহলে কি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমছে? সরকার তিন বছরে নিজেদের কৃতিত্বের যতই দাবি তুলুক, মূলত প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। আর এখন প্রার্থী নির্বাচনেও একের পর এক ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে তারা। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন।
এসব পরাজয়ের কারণে কিছু পদ হাতছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগের। তাই নিয়ে কথা বলছেন অনেকে। কিন্তু পদ হাতছাড়া হওয়ার চেয়েও বড় কিছু ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে দলটির। আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা নিয়ে নানা রকম খেলাধুলা চলছে। সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, যার মাধ্যমে আওয়ামী সমর্থনও বিভক্ত হয়েছে। এবং সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সমর্থন বেশি যাঁর প্রতি, তাঁকেই অবহেলা করা হয়েছে। প্রার্থিতা বাছাইয়ের এই ভুলের কারণে সাংগঠনিক পর্যায়ে আওয়ামী সমর্থনে ফাটল দেখা দিচ্ছে। বছর দুয়েক বাদে যে সংসদ নির্বাচন, তাতে এই সমর্থনের বিভক্তির কারণে চড়া মূল্য গুনতে হতে পারে আওয়ামী লীগকে। এ সম্পর্কে দলের নীতিনির্ধারকদের মাথা ঘামানো উচিত।
No comments