প্রতিবেশী-মমতার নাম রাজনীতিতে 'ইন্দিরা' আর 'নজরুল'!-লিপ্ত মমতা বন্দোপাধ্যায়! by শামস্ বিশ্বাস
এই কনকনে শীতেও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উত্তপ্ত 'নামকরণ' নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, বিধাননগরে 'ইন্দিরা ভবন'-এর নাম পরিবর্তন করে কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে রাখা হবে। ওখানে কবিকে নিয়ে একটি গবেষণাকেন্দ্র ও সংগ্রহশালাও হবে। এ ভবনেই ১৯৯০ সাল থেকে আমৃত্যু কাটিয়েছেন জ্যোতি বসু। কয়েক দিন আগেই তাঁর স্মৃতিবিজড়িত সব কিছু সরিয়ে নিয়ে ভবনটি রাজ্য সরকারকে প্রত্যর্পণ করে সিপিআই (এম)।
তার পরই এই ঘোষণা, যা আদৌ মেনে নিতে পারছে না রাজ্য কংগ্রেস। ১৯৭২ সালে সল্টলেকে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনের প্রাক্কালে গড়া হয়েছিল বাড়িটি। তখন সেটির ছিল খড়ের চাল। নাম ছিল 'পর্ণকুটির'। ওই বাড়িতে ইন্দিরা গান্ধীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়িটিতে এসি মেশিন বসানো নিয়ে সে সময় বিতর্ক হয়েছিল। পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলেই বাড়িটি পুরোপুরি গড়ে ওঠে। মুখে মুখে প্রচলিত নাম ছিল 'ইন্দিরা ভবন'। কিন্তু সরকারিভাবে 'ইন্দিরা ভবন' নামকরণ হয় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে, ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর। রাজ্য নগরোন্নয়ন দপ্তরের অধীনে ওই বাড়িটি অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সিপিএমের রাজ্য নেতা সেলিমের বক্তব্য, 'মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর জ্যোতিবাবুর থাকার জন্য ওই বাড়ির ভাড়া বরাবরই দিয়েছে দল। কিন্তু তিনি থাকতেন বলেই আমরা দাবি তুলিনি যে ওই বাড়ির নাম জ্যোতি বসুর নামে করতে হবে! বা ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকারে থাকার সময়ও বাড়ির নাম থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে ছেঁটে ফেলা হয়নি!' প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নানের মতে, 'যা করা হচ্ছে, তাতে নজরুল ও ইন্দিরা দুজনেরই অপমান হচ্ছে!'
নাম পরিবর্তনের ঘোষণা নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূলের শরিকি কাজিয়ার সুযোগ নিতে ছাড়ছে না সিপিএম। কেন ইন্দিরা ভবনেই নজরুল সংগ্রহশালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে তারা। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের কথায়, 'কবি নজরুলের নামে একাডেমী হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাজ্যের সব মানুষের জন্যই সেটা হতে পারে। কিন্তু নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত অনেক জায়গা এ রাজ্যে আছে। উদাহরণ হিসেবে কলকাতাতেই সিআইটি রোড এবং ক্রিস্টোফার রোড আছে। সল্টলেকের এই বাড়িটির নাম নজরুল ভবন করার মধ্যে কী নীতি আছে জানি না!' সিপিএম নেতৃত্ব একসময় ওই বাড়িতে জ্যোতি বসুর স্মরণে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল। তৃণমূল তখন আপত্তি জানায়।
'বিতর্ক' তাই নাম বদলেই! রাজ্য সরকারের বক্তব্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি একাডেমী গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য, ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতির প্রতি অবমাননা নয়। তাদের যুক্তি, ওই বাড়িতে 'ইন্দিরা ভবন' নামে কোনো ফলক নেই। সল্টলেকের ভবনটি সরকারি নথিতে 'অতিথিশালা'। সেই বাড়ি ভেঙে 'নজরুল ভবন' গড়ার কথা বিবেচনায় রয়েছে। উদ্ভূত রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সরাসরি কংগ্রেস ও বামদের গোপন আঁতাতের অভিযোগ এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জোট শরিকের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযোগ, রাজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বামদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কংগ্রেস।
অন্যদিকে কংগ্রেসের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভিও পাল্টা বলেছেন, 'কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল। কংগ্রেস কোনো ব্যক্তি বা দলের হুমকিতে ভয় পেয়ে চলে না।' অভিষেকের এমন মন্তব্যের পর কংগ্রেস-তৃণমূলের সম্পর্ক নিয়ে নতুন জল্পনা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, এবার হয়তো জোট ভাঙতে চলেছে। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত একবারে আলাদা। তাঁদের মতে, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী কখনোই চান না ইউপিএ থেকে তৃণমূল বেরিয়ে যাক। সংখ্যার বিচারে ইউপিএর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল তৃণমূল। তাই 'সামান্য' কারণে তৃণমূল জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাক, তা চান না সোনিয়া। তা হলে কেন্দ্রীয় সরকার টিকিয়ে রাখতে না পেরে বড় বিপদে পড়ে যাবে কংগ্রেস। প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও তৃণমূলের বক্তব্য, যেভাবে মমতা রাজ্যের স্বার্থে মুখর হয়েছেন, তাতে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব প্রমাদ গুনছে। সে জন্যই সিপিএমের সুরে সুর মিলিয়ে এসব আন্দোলন।
তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় রাজ্যসভায় পাস হয়নি লোকপাল বিল। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, পেট্রল, রান্নার গ্যাস ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধি, খুচরায় বিদেশি বিনিয়োগ থেকে লোকপাল, বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রের বিরোধিতা করেছে তৃণমূল। শরিক তৃণমূল কংগ্রেসের এই আচরণে যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে কংগ্রেসকে।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে রেলমন্ত্রী হিসেবে জেলায় জেলায় রেলের যে ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছিলেন মমতা, তা তুলে দিয়ে ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে রাজ্য সরকারের জোট শরিক কংগ্রেস। ইন্দিরা ভবনের সামনে বিক্ষোভের সময় কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ বলেন, 'ইন্দিরা গান্ধী যখন এসেছিলেন এই বাড়িতে, তাঁকে স্বাগত জানানোর দলে কংগ্রেস কর্মী হিসেবে সেদিন ছিলেন সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত মুখার্জিরাও। আজ তাঁদেরই নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন সেই ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতিকে মুছে দেওয়ার জন্য নেমেছেন, তখন এই নেতাদের উচিত এক দিনের জন্য হলেও কোনো প্রতীকী প্রতিবাদ করা।' আরেক বক্তা নির্বেদ রায় বলেন, '১৯৮৪ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর লোকসভার ভোটে প্রথম ও নতুন প্রার্থী হিসেবে কংগ্রেসের অনেকে জিতেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী। ভুলে গেলেন সেই কথা তিনি?'
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ইন্দিরা ভবনে নজরুল একাডেমী তৈরি করার প্রয়াস নিয়ে যে বিতর্ক ও টানাপড়েন চলছে, তাতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ কবির পরিবার। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলের বিতর্ক বন্ধ করার উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন কবির নাতনি মিষ্টি কাজী। ইন্দিরা ভবনে নজরুল একাডেমী গড়ার উদ্যোগকে সাধুবাদই জানিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, নজরুল একাডেমী হলে ইন্দিরা ভবনের নাম পাল্টাবে কেন? ওই ভবনে নজরুল একাডেমী নামক অফিসটি হবে_এই তো? তাহলে আপত্তিটা কোথায়? মিষ্টি কাজী এর মধ্যে কোনো অসংগতি দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, 'আমার দাদুকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন একটা ভালো কাজ করতে যাচ্ছেন, তখন এই বিতর্কে আমরা ব্যথিত। দাদুকে রাজনীতির মধ্যে টেনে আনা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির কবি ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক স্তরে পড়েন না। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সব সময় চাইতেন দুই বাংলাকে কাছাকাছি আনতে। আমি মনে করি, এই একাডেমী সেই কাজ করতে উদ্যোগী হবে।'
এদিকে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্যে মুসলিম সমাজের একাংশ ক্ষুব্ধ। নজরুল একাডেমী গড়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর একটি বক্তব্য ছিল, 'সংখ্যালঘুদের জন্য নজরুল একাডেমী করে দিলাম।' আবার পশ্চিমবঙ্গের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম নজরুল এবং সংখ্যালঘু নিয়ে 'আবেগ' সঞ্চারের চেষ্টা করেছেন, 'গত ৩৪ বছর বা তার আগে নজরুলকে সম্মান দিতে কোনো সরকারই উদ্যোগী হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের উদ্যোগে যখন সে চেষ্টা হচ্ছে, তখন কংগ্রেসের একাংশ বিরোধিতা করছে!' পুরমন্ত্রীর মন্তব্য, 'ভোটের আগে কংগ্রেসসহ সব দলেরই সংখ্যালঘুদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ভোটের পর নজরুলকেও ভুলে যায়, সংখ্যালঘুদেরও!' এমন মন্তব্যেই চটেছে মুসলিম সমাজ। তাদের বক্তব্য হলো, কাজী নজরুল ইসলাম বিশেষভাবে কোনো সম্প্রদায়ের কবি নন, তিনি বাঙালির কবি। দুই বাংলায়ই তিনি সমান গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়। নজরুল নিজেই বলে গেছেন, 'একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।' তিনি নিজেকে কখনো হিন্দু বা মুসলমান বলে আলাদা করে ভাবতেন না। তাহলে রাজ্য সরকারের কেন এই মুসলিম তোষণ? আর মুখ্যমন্ত্রীর কথামতো নজরুল একাডেমী যদি সংখ্যালঘুদের জন্যই হয়, তাহলে তার চেয়ারম্যান কেন জয় গোস্বামী? তাদের বক্তব্য, ইন্দিরা ভবনে নজরুল একাডেমী গড়া হোক, তারা সেটা চায় না। তাদের মতে, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমীর মতো পশ্চিমবঙ্গ নজরুল একাডেমী গড়ে তোলা হোক। রাজ্য সরকারের কাছে তারা সে বার্তাই পেঁৗছে দিতে চায়। আর এ জন্য যদি টাকার প্রয়োজন হয়, তাহলে তারা পথে নেমে চাঁদা তুলে সেই টাকা জোগাড় করে দেবে।
নাম বদলের অশুভ বদলা যদি বলা যায় মমতার এই সিদ্ধান্তকে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গবাসী তা দেখেছে এর আগেই এই সরকারের আমলে, যা শুরু হয়েছিল রাজ্যের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নামে রাজারহাটে নতুন নগরীর 'জ্যোতি বসু নগর' নামটি বাতিল করার সরকারি উদ্যোগের মধ্যে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বিধি মেনেই নিউ টাউনের নাম জ্যোতি বসু স্মরণে রাখা হয়েছিল। তখন কংগ্রেস টুঁ শব্দটিও করেনি। হয়তো ভেবেছিল, আক্রান্ত তো জ্যোতি বসু! কংগ্রেসের কী? কিন্তু নিজেদের জোট সরকারের হাতে এবার আক্রান্ত তাদের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী! এদিন কংগ্রেসের বিক্ষোভ সভা থেকে, বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও এমনভাবে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে অপমানিত করেনি বামরা, যা তৃণমূলের সরকার দেখাচ্ছে সাত মাসেই। উল্লেখ্য, রেলমন্ত্রী হিসেবেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় মেট্রো রেলের অনেক স্টেশনের নাম কোনো আলোচনা ছাড়াই, তৎকালীন রাজ্য সরকারের মতামত ছাড়াই বদলে দিয়েছিলেন। তবে ব্যক্তিত্বদের স্মরণে রাখা নামগুলো বদল হয়নি তখন। এবার তাও শুরু হলো। প্রশ্ন উঠবেই, কবি নজরুলের নামে সংগ্রহশালা করতে গেলে ভবনের নাম পরিবর্তন করা আদৌ কি জরুরি? রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নামটি কি পরিবর্তন করতে হয়েছিল?
সমলোচকদের মতে, এমন বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণ হয়তো সংখ্যালঘু মুসলিম আর অসাম্প্রদায়িক ভোটারদের কাছে থেকে কংগ্রেস আর বামদের দূরে সরিয়ে তৃণমূলের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখা। আর তৃণমূলের কাছে কোণঠাসা জোটসঙ্গী কংগ্রেস আর বিরোধী বামদের এই ইস্যুতে পিছে না হটার কারণ, মমতা পশ্চিমবঙ্গের নানা স্পর্শকাতর ও আবেগী স্বার্থের বিষয়ের পক্ষে যেভাবে আপসহীন ভূমিকা দেখিয়ে পাবলিক সেন্টিমেন্ট নিজের পক্ষে টানছেন, তাতে তাঁকে এখনই আটকাতে না পারলে ক্ষমতায় ফিরে আসার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। রাজনীতির নানা সমীকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিতর্ক থেকে লাভবান হবেন ঠিকই; কিন্তু এর মাধ্যমে এ বাংলার মতো ওই বাংলাও নাম পরিবর্তনের রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে।
নাম পরিবর্তনের ঘোষণা নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূলের শরিকি কাজিয়ার সুযোগ নিতে ছাড়ছে না সিপিএম। কেন ইন্দিরা ভবনেই নজরুল সংগ্রহশালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে তারা। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের কথায়, 'কবি নজরুলের নামে একাডেমী হওয়া বাঞ্ছনীয়। রাজ্যের সব মানুষের জন্যই সেটা হতে পারে। কিন্তু নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত অনেক জায়গা এ রাজ্যে আছে। উদাহরণ হিসেবে কলকাতাতেই সিআইটি রোড এবং ক্রিস্টোফার রোড আছে। সল্টলেকের এই বাড়িটির নাম নজরুল ভবন করার মধ্যে কী নীতি আছে জানি না!' সিপিএম নেতৃত্ব একসময় ওই বাড়িতে জ্যোতি বসুর স্মরণে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল। তৃণমূল তখন আপত্তি জানায়।
'বিতর্ক' তাই নাম বদলেই! রাজ্য সরকারের বক্তব্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি একাডেমী গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য, ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতির প্রতি অবমাননা নয়। তাদের যুক্তি, ওই বাড়িতে 'ইন্দিরা ভবন' নামে কোনো ফলক নেই। সল্টলেকের ভবনটি সরকারি নথিতে 'অতিথিশালা'। সেই বাড়ি ভেঙে 'নজরুল ভবন' গড়ার কথা বিবেচনায় রয়েছে। উদ্ভূত রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সরাসরি কংগ্রেস ও বামদের গোপন আঁতাতের অভিযোগ এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জোট শরিকের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযোগ, রাজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বামদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কংগ্রেস।
অন্যদিকে কংগ্রেসের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভিও পাল্টা বলেছেন, 'কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল। কংগ্রেস কোনো ব্যক্তি বা দলের হুমকিতে ভয় পেয়ে চলে না।' অভিষেকের এমন মন্তব্যের পর কংগ্রেস-তৃণমূলের সম্পর্ক নিয়ে নতুন জল্পনা শুরু হয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, এবার হয়তো জোট ভাঙতে চলেছে। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত একবারে আলাদা। তাঁদের মতে, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী কখনোই চান না ইউপিএ থেকে তৃণমূল বেরিয়ে যাক। সংখ্যার বিচারে ইউপিএর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল তৃণমূল। তাই 'সামান্য' কারণে তৃণমূল জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাক, তা চান না সোনিয়া। তা হলে কেন্দ্রীয় সরকার টিকিয়ে রাখতে না পেরে বড় বিপদে পড়ে যাবে কংগ্রেস। প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও তৃণমূলের বক্তব্য, যেভাবে মমতা রাজ্যের স্বার্থে মুখর হয়েছেন, তাতে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব প্রমাদ গুনছে। সে জন্যই সিপিএমের সুরে সুর মিলিয়ে এসব আন্দোলন।
তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় রাজ্যসভায় পাস হয়নি লোকপাল বিল। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, পেট্রল, রান্নার গ্যাস ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধি, খুচরায় বিদেশি বিনিয়োগ থেকে লোকপাল, বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রের বিরোধিতা করেছে তৃণমূল। শরিক তৃণমূল কংগ্রেসের এই আচরণে যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে কংগ্রেসকে।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে রেলমন্ত্রী হিসেবে জেলায় জেলায় রেলের যে ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছিলেন মমতা, তা তুলে দিয়ে ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে রাজ্য সরকারের জোট শরিক কংগ্রেস। ইন্দিরা ভবনের সামনে বিক্ষোভের সময় কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ বলেন, 'ইন্দিরা গান্ধী যখন এসেছিলেন এই বাড়িতে, তাঁকে স্বাগত জানানোর দলে কংগ্রেস কর্মী হিসেবে সেদিন ছিলেন সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত মুখার্জিরাও। আজ তাঁদেরই নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন সেই ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতিকে মুছে দেওয়ার জন্য নেমেছেন, তখন এই নেতাদের উচিত এক দিনের জন্য হলেও কোনো প্রতীকী প্রতিবাদ করা।' আরেক বক্তা নির্বেদ রায় বলেন, '১৯৮৪ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর লোকসভার ভোটে প্রথম ও নতুন প্রার্থী হিসেবে কংগ্রেসের অনেকে জিতেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী। ভুলে গেলেন সেই কথা তিনি?'
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ইন্দিরা ভবনে নজরুল একাডেমী তৈরি করার প্রয়াস নিয়ে যে বিতর্ক ও টানাপড়েন চলছে, তাতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ কবির পরিবার। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলের বিতর্ক বন্ধ করার উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন কবির নাতনি মিষ্টি কাজী। ইন্দিরা ভবনে নজরুল একাডেমী গড়ার উদ্যোগকে সাধুবাদই জানিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, নজরুল একাডেমী হলে ইন্দিরা ভবনের নাম পাল্টাবে কেন? ওই ভবনে নজরুল একাডেমী নামক অফিসটি হবে_এই তো? তাহলে আপত্তিটা কোথায়? মিষ্টি কাজী এর মধ্যে কোনো অসংগতি দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, 'আমার দাদুকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন একটা ভালো কাজ করতে যাচ্ছেন, তখন এই বিতর্কে আমরা ব্যথিত। দাদুকে রাজনীতির মধ্যে টেনে আনা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির কবি ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক স্তরে পড়েন না। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সব সময় চাইতেন দুই বাংলাকে কাছাকাছি আনতে। আমি মনে করি, এই একাডেমী সেই কাজ করতে উদ্যোগী হবে।'
এদিকে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্যে মুসলিম সমাজের একাংশ ক্ষুব্ধ। নজরুল একাডেমী গড়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর একটি বক্তব্য ছিল, 'সংখ্যালঘুদের জন্য নজরুল একাডেমী করে দিলাম।' আবার পশ্চিমবঙ্গের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম নজরুল এবং সংখ্যালঘু নিয়ে 'আবেগ' সঞ্চারের চেষ্টা করেছেন, 'গত ৩৪ বছর বা তার আগে নজরুলকে সম্মান দিতে কোনো সরকারই উদ্যোগী হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের উদ্যোগে যখন সে চেষ্টা হচ্ছে, তখন কংগ্রেসের একাংশ বিরোধিতা করছে!' পুরমন্ত্রীর মন্তব্য, 'ভোটের আগে কংগ্রেসসহ সব দলেরই সংখ্যালঘুদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ভোটের পর নজরুলকেও ভুলে যায়, সংখ্যালঘুদেরও!' এমন মন্তব্যেই চটেছে মুসলিম সমাজ। তাদের বক্তব্য হলো, কাজী নজরুল ইসলাম বিশেষভাবে কোনো সম্প্রদায়ের কবি নন, তিনি বাঙালির কবি। দুই বাংলায়ই তিনি সমান গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়। নজরুল নিজেই বলে গেছেন, 'একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।' তিনি নিজেকে কখনো হিন্দু বা মুসলমান বলে আলাদা করে ভাবতেন না। তাহলে রাজ্য সরকারের কেন এই মুসলিম তোষণ? আর মুখ্যমন্ত্রীর কথামতো নজরুল একাডেমী যদি সংখ্যালঘুদের জন্যই হয়, তাহলে তার চেয়ারম্যান কেন জয় গোস্বামী? তাদের বক্তব্য, ইন্দিরা ভবনে নজরুল একাডেমী গড়া হোক, তারা সেটা চায় না। তাদের মতে, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমীর মতো পশ্চিমবঙ্গ নজরুল একাডেমী গড়ে তোলা হোক। রাজ্য সরকারের কাছে তারা সে বার্তাই পেঁৗছে দিতে চায়। আর এ জন্য যদি টাকার প্রয়োজন হয়, তাহলে তারা পথে নেমে চাঁদা তুলে সেই টাকা জোগাড় করে দেবে।
নাম বদলের অশুভ বদলা যদি বলা যায় মমতার এই সিদ্ধান্তকে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গবাসী তা দেখেছে এর আগেই এই সরকারের আমলে, যা শুরু হয়েছিল রাজ্যের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নামে রাজারহাটে নতুন নগরীর 'জ্যোতি বসু নগর' নামটি বাতিল করার সরকারি উদ্যোগের মধ্যে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বিধি মেনেই নিউ টাউনের নাম জ্যোতি বসু স্মরণে রাখা হয়েছিল। তখন কংগ্রেস টুঁ শব্দটিও করেনি। হয়তো ভেবেছিল, আক্রান্ত তো জ্যোতি বসু! কংগ্রেসের কী? কিন্তু নিজেদের জোট সরকারের হাতে এবার আক্রান্ত তাদের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী! এদিন কংগ্রেসের বিক্ষোভ সভা থেকে, বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও এমনভাবে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে অপমানিত করেনি বামরা, যা তৃণমূলের সরকার দেখাচ্ছে সাত মাসেই। উল্লেখ্য, রেলমন্ত্রী হিসেবেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় মেট্রো রেলের অনেক স্টেশনের নাম কোনো আলোচনা ছাড়াই, তৎকালীন রাজ্য সরকারের মতামত ছাড়াই বদলে দিয়েছিলেন। তবে ব্যক্তিত্বদের স্মরণে রাখা নামগুলো বদল হয়নি তখন। এবার তাও শুরু হলো। প্রশ্ন উঠবেই, কবি নজরুলের নামে সংগ্রহশালা করতে গেলে ভবনের নাম পরিবর্তন করা আদৌ কি জরুরি? রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নামটি কি পরিবর্তন করতে হয়েছিল?
সমলোচকদের মতে, এমন বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণ হয়তো সংখ্যালঘু মুসলিম আর অসাম্প্রদায়িক ভোটারদের কাছে থেকে কংগ্রেস আর বামদের দূরে সরিয়ে তৃণমূলের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখা। আর তৃণমূলের কাছে কোণঠাসা জোটসঙ্গী কংগ্রেস আর বিরোধী বামদের এই ইস্যুতে পিছে না হটার কারণ, মমতা পশ্চিমবঙ্গের নানা স্পর্শকাতর ও আবেগী স্বার্থের বিষয়ের পক্ষে যেভাবে আপসহীন ভূমিকা দেখিয়ে পাবলিক সেন্টিমেন্ট নিজের পক্ষে টানছেন, তাতে তাঁকে এখনই আটকাতে না পারলে ক্ষমতায় ফিরে আসার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। রাজনীতির নানা সমীকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিতর্ক থেকে লাভবান হবেন ঠিকই; কিন্তু এর মাধ্যমে এ বাংলার মতো ওই বাংলাও নাম পরিবর্তনের রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়বে।
No comments