নির্বাচন কমিশনের দায়মুক্তি কেন? by মোহাম্মদ নুরাল হক্
দায়মুক্তি (Indemnity) চায় নির্বাচন কমিশন। গত ২ ডিসেম্বর ’০৯ আমার দেশ পত্রিকার শিরোনাম এটি। খবরে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের কোনো সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না—এমন আইন করার প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।’
আর, এই ‘ইনডেমনিটি’ প্রস্তাব সাধারণ আইনে নয়, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে করার অভিমত ব্যক্ত করেছে ইসি। ভালো-মন্দ যে সিদ্ধান্তই কমিশন নিক না কেন, সেটা বাংলাদেশের কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারা ‘ইনডেমনিটির’ পর্যায়েই পড়ে। নির্বাচন কমিশন মনে করছে, এ বিধান করা হলেই নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী হবে; নিশ্চিত হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
আসলে, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের নীতিনির্ধারক ও সমাজপতিদের ঘাড়ে অহমিকা, ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদের যে ভূত সমূহ জেঁকে বসেছে, তা থেকে দূরে থাকা কি আমাদের এই সমাজেরই একটি অংশ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব? উত্তর খুবই সহজ, না। তবুও, নির্দিষ্ট খবরটি পড়ে আমি বেশ কয়েকদিন হলো যারপরনাই অস্থির সময় অতিবাহিত করছি। কারণ, যে কোনো মানদণ্ডে, আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বলতে যা বোঝায় তার শেষ ভরসা হিসেবে এতকিছুর পরে আজও এবড়ো থেবড়ো বাংলাদেশে হাতে গোনা দুই-একটি প্রতিষ্ঠানের মতো আমরা নির্বাচন কমিশনের দিকেই তাকিয়ে থাকি। আর, সেই প্রতিষ্ঠানই যদি ক্ষমতা কম না বেশি তা নিয়ে টানা-হেঁচড়ায় জড়িয়ে পড়ে তাহলে বাকি থাকে কি? তাই, উল্লিখিত খবরটি আমাদের জন্য সর্বৈব হতাশাব্যাঞ্জক ও নিতান্তই বেদনাদায়ক।
আমরা কি ভুলে গেলাম, প্রশ্নাতীত সর্বময় ক্ষমতাই দুরাচার-দুর্নীতির একমাত্র কারণ? সীমাহীন সর্বময় ক্ষমতাই যে কারও জন্য সবচেয়ে বড় পশ্চাত্পদতা-দুর্বলতা? প্রশ্নাতীত সর্বময় ক্ষমতাই যে কারও জন্য সবচেয়ে অসৌন্দর্য-অমর্যাদার? সীমাহীন সর্বময় ক্ষমতাই যে কোনো সমাজে হিংসা-বিবাদসহ অনাসৃষ্টির একমাত্র কারণ? আমি নিশ্চিত যে, আমাদের সবারই স্মরণশক্তি এত দুর্বল নয়। আর এসব ঘটন-অঘটনের সময়ের ব্যবধানও খুবই কম। কাজেই, এসবের কোনো কিছুই এত তাড়াতাড়ি সবার ভোলার কথা নয়। এতদসত্ত্বেও, নির্বাচন কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের এহেন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ কেন?
আসলে, আজকাল যেসব পর্যায়ে ক্ষমতার দাপট অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রদর্শিত হয়ে চলেছে তার জন্য এই মুহূর্তে সাধারণভাবেও যুক্তিভিত্তিক সন্তোষজনক কোনো কারণ আমার জানা নেই। তবে, পক্ষপাতিত্বের বাইরে এসে নিতান্তই সাদা-মাঠাভাবে বলা যায় এসবই হলো আমাদের সমাজে এক ধরনের ‘চেইন রিঅ্যাকশন’। আর, ‘চেইন রিঅ্যাকশনের’ সহজে বোধগম্য উদাহরণ বোধকরি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই তার কবিতায় দিয়ে গেছেন এই বলে, ‘বাবু যাহা বলেন, পারিষদগণ বলে তার শতগুণ।’
পৃথিবীতে কোনোকিছু বা কারও গ্রহণযোগ্যতা যে ক্ষমতার দাপটে নির্দিষ্ট হয় না বা স্থায়ী হয় না তা কি একবিংশ শতাব্দীতে এখনও আলোচিত হতে হবে? পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি যে সত্যটি সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত তা হলো, যে কোনো মানুষের গ্রহণযোগ্যতা তার কর্মতত্পরতার উদাহরণ দ্বারা, কখনই তার ক্ষমতার পরিধির দ্বারা নয়। এই তো সেদিন নভেম্বর ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া জাগানো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট দলের জাঁকজমকপূর্ণ নির্বাচনী কনভেনশনে সে দলের ডাকসাঁইটে নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার বক্তৃতায় বললেন, ''In today's world, United States of America should no more show examples of 'power', it should show power of 'examples' rather''. অর্থাত্, ‘আজকের পৃথিবীতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতার উদাহরণ না দেখিয়ে উদাহরণের ক্ষমতাই প্রদর্শন করা উচিত।’ একটু ভাবুন তো পাঠকবৃন্দ, এতকিছুর পর কী ধরনের আপরাধবোধ থেকে কী অদ্ভুত আত্মসমালোচনা ওদের। ভাবতে অবাক লাগে, তাই না? তবে, উল্লিখিত বক্তব্যটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সমাজপতি, ধর্তব্যের মধ্যের জ্ঞানী-গুণী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ও বোদ্ধা ব্যক্তিত্বদের জন্য কদাচিত্ কোনো বার্তা বহন করে কি?
আসলে সীমাহীন ক্ষমতা মানুষকে কখনোই উজ্জীবিত করতে পারে না। অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা মানুষের জ্ঞানের ও বিবেকের পরিধিকে সঙ্কুচিত করে। দায়বদ্ধহীন ক্ষমতা সাধারণভাবে মনুষ্যত্বতে দ্রুত অবদমিত করে। বিচার-বুদ্ধিহীন ক্ষমতার হাতছানি আর দশটা জীবের ন্যায় মানুষকে উদ্দেশ্যবিহীন জীবন-যাপনে উত্সাহিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতার কোন্দল-লড়াইয়ে আমাদের প্রাপ্তি কি ও কতটুকু? সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অহেতুক ক্ষমতার লড়াইয়ে বাংলাদেশের নামি-দামি, প্রতিভাবান, সম্ভাবনাময় ও প্রায় প্রতিষ্ঠিত নেতারা হয় নিহত হয়েছেন আর না হয় সময়ের ব্যবধানে নাজেহাল হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। আর, এর ফলে নানাবিধ দুর্ভোগ ও দুর্দশা বেড়েছে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশীদের, যারা কোনো অবস্থায় এবং কোনোভাবেই ক্ষমতার লড়াইয়ে সম্পৃক্ত নয়।
এখন ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে ইদানীং সবাই বিশেষ করে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শুধুই আরও আরও ক্ষমতার মরীচিকার পেছনে ছুটছে তো ছুটছেই। এ ছোটাছুটির বোধ করি কোনো শেষ নেই। সবাই চান একের উপরে অন্যের সীমাহীন অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা (endless unchallenging power)। কিন্তু কেন, কিসের জন্য, কার পক্ষে এবং কার বিরুদ্ধে তার কোনো নির্দিষ্ট উত্তর আছে কি?
আজ রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে ল্যাম্পপোস্টে সাঁটা পোস্টারে স্লোগানের মতো একটি লেখা লক্ষ্য করলাম, তাতে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষা।’ অথচ, আমাদের নির্বাচন কমিশন তাদের দাফতরিক হাত আরও শক্তিশালী করার জন্য বাড়তি ক্ষমতা চাইছে। এমন কি তাদের ক্ষমতা যেন কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তার জন্য প্রায় দায়মুক্তি পর্যন্তও। পরিতাপের বিষয় হলো, নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠরা যাদের অথবা যে দফতর/প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কিছু একটা শিখবেন তাদেরই বোধ হয় যথাযথ শিক্ষার অভাব রয়ে গেছে। কাজেই, যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলেই ভবিষ্যতে ক্ষমতা আর বাড়তি ক্ষমতার নেশা এদের পেয়ে বসবে না বলে মন্তব্য করলে কিছু ভুল হবে কি?
নির্বাচন কমিশনকে অধিক ক্ষমতা প্রদানের সুবাদে বাংলাদেশের নির্বাচন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে, বিষয়টি একেবারেই স্থূল চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। বস্তুত যে কোনো কাজে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা আসে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুস্থ চিন্তা-চেতনা, সার্বিক মনন আর কর্মতত্পরতার বহিঃপ্রকাশ থেকে। এখানে কম-বেশি ক্ষমতার কোনো স্থানই নেই। ক্ষমতার ফল ক্ষণস্থায়ী ও সময়ের ব্যবধানে অগ্রহণযোগ্য বলে বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। আর ‘ইনডেমনিটি’ প্রদান যে কোনো সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই না।
ক্ষমতা কখন আসে কখন যায়, কখন কোন মানুষ/প্রতিষ্ঠান/সংস্থা ক্ষমতাধর বনে যায় অথবা আবার কখন ক্ষমতা হারায়, ইদানীং সময়ে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বোধকরি আমাদের শত আলোচিত দুর্নীতি দমন কমিশন। এখানে নিকট অতীতের কোনো রকম কাসুন্দি ঘাঁটার ইচ্ছা আমার নেই। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই তো সেদিন, দুর্নীতি দমন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান খেদোক্তি প্রকাশ করে বললেন, দুর্নীতি দমন কমিশন নামক বাঘটির দাঁত তো নেইই এখন নখও উপড়িয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। এহেন বক্তব্য থেকেও নির্বাচন কমিশন কি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না?
সঙ্গত কারণেই, আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো, অহমিকা ও ক্ষমতার ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে বিদায় করা। আর, অর্থ-সম্পদ বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ নাড়াচাড়ায় বেশি বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা। মনে রাখতে হবে, মানুষের জন্য ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী আর উপমা (Image) ও উদাহরণই (Example) চিরস্থায়ী। ক্ষমতার হাত বদল হতে পারে কিন্তু উপমা ও উদাহরণের হাত বদল কখনই হয় না। তাই, উপমা ও উদাহরণই সত্যিকারের মানুষের বৈশিষ্ট্য, কোনোভাবেই কম-বেশি ক্ষমতা নয়।
লেখক : পেনশনার
haquenoor@yahoo.com
আসলে, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের নীতিনির্ধারক ও সমাজপতিদের ঘাড়ে অহমিকা, ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদের যে ভূত সমূহ জেঁকে বসেছে, তা থেকে দূরে থাকা কি আমাদের এই সমাজেরই একটি অংশ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব? উত্তর খুবই সহজ, না। তবুও, নির্দিষ্ট খবরটি পড়ে আমি বেশ কয়েকদিন হলো যারপরনাই অস্থির সময় অতিবাহিত করছি। কারণ, যে কোনো মানদণ্ডে, আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বলতে যা বোঝায় তার শেষ ভরসা হিসেবে এতকিছুর পরে আজও এবড়ো থেবড়ো বাংলাদেশে হাতে গোনা দুই-একটি প্রতিষ্ঠানের মতো আমরা নির্বাচন কমিশনের দিকেই তাকিয়ে থাকি। আর, সেই প্রতিষ্ঠানই যদি ক্ষমতা কম না বেশি তা নিয়ে টানা-হেঁচড়ায় জড়িয়ে পড়ে তাহলে বাকি থাকে কি? তাই, উল্লিখিত খবরটি আমাদের জন্য সর্বৈব হতাশাব্যাঞ্জক ও নিতান্তই বেদনাদায়ক।
আমরা কি ভুলে গেলাম, প্রশ্নাতীত সর্বময় ক্ষমতাই দুরাচার-দুর্নীতির একমাত্র কারণ? সীমাহীন সর্বময় ক্ষমতাই যে কারও জন্য সবচেয়ে বড় পশ্চাত্পদতা-দুর্বলতা? প্রশ্নাতীত সর্বময় ক্ষমতাই যে কারও জন্য সবচেয়ে অসৌন্দর্য-অমর্যাদার? সীমাহীন সর্বময় ক্ষমতাই যে কোনো সমাজে হিংসা-বিবাদসহ অনাসৃষ্টির একমাত্র কারণ? আমি নিশ্চিত যে, আমাদের সবারই স্মরণশক্তি এত দুর্বল নয়। আর এসব ঘটন-অঘটনের সময়ের ব্যবধানও খুবই কম। কাজেই, এসবের কোনো কিছুই এত তাড়াতাড়ি সবার ভোলার কথা নয়। এতদসত্ত্বেও, নির্বাচন কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের এহেন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ কেন?
আসলে, আজকাল যেসব পর্যায়ে ক্ষমতার দাপট অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রদর্শিত হয়ে চলেছে তার জন্য এই মুহূর্তে সাধারণভাবেও যুক্তিভিত্তিক সন্তোষজনক কোনো কারণ আমার জানা নেই। তবে, পক্ষপাতিত্বের বাইরে এসে নিতান্তই সাদা-মাঠাভাবে বলা যায় এসবই হলো আমাদের সমাজে এক ধরনের ‘চেইন রিঅ্যাকশন’। আর, ‘চেইন রিঅ্যাকশনের’ সহজে বোধগম্য উদাহরণ বোধকরি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই তার কবিতায় দিয়ে গেছেন এই বলে, ‘বাবু যাহা বলেন, পারিষদগণ বলে তার শতগুণ।’
পৃথিবীতে কোনোকিছু বা কারও গ্রহণযোগ্যতা যে ক্ষমতার দাপটে নির্দিষ্ট হয় না বা স্থায়ী হয় না তা কি একবিংশ শতাব্দীতে এখনও আলোচিত হতে হবে? পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি যে সত্যটি সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত তা হলো, যে কোনো মানুষের গ্রহণযোগ্যতা তার কর্মতত্পরতার উদাহরণ দ্বারা, কখনই তার ক্ষমতার পরিধির দ্বারা নয়। এই তো সেদিন নভেম্বর ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া জাগানো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট দলের জাঁকজমকপূর্ণ নির্বাচনী কনভেনশনে সে দলের ডাকসাঁইটে নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার বক্তৃতায় বললেন, ''In today's world, United States of America should no more show examples of 'power', it should show power of 'examples' rather''. অর্থাত্, ‘আজকের পৃথিবীতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতার উদাহরণ না দেখিয়ে উদাহরণের ক্ষমতাই প্রদর্শন করা উচিত।’ একটু ভাবুন তো পাঠকবৃন্দ, এতকিছুর পর কী ধরনের আপরাধবোধ থেকে কী অদ্ভুত আত্মসমালোচনা ওদের। ভাবতে অবাক লাগে, তাই না? তবে, উল্লিখিত বক্তব্যটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সমাজপতি, ধর্তব্যের মধ্যের জ্ঞানী-গুণী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ও বোদ্ধা ব্যক্তিত্বদের জন্য কদাচিত্ কোনো বার্তা বহন করে কি?
আসলে সীমাহীন ক্ষমতা মানুষকে কখনোই উজ্জীবিত করতে পারে না। অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা মানুষের জ্ঞানের ও বিবেকের পরিধিকে সঙ্কুচিত করে। দায়বদ্ধহীন ক্ষমতা সাধারণভাবে মনুষ্যত্বতে দ্রুত অবদমিত করে। বিচার-বুদ্ধিহীন ক্ষমতার হাতছানি আর দশটা জীবের ন্যায় মানুষকে উদ্দেশ্যবিহীন জীবন-যাপনে উত্সাহিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষমতার কোন্দল-লড়াইয়ে আমাদের প্রাপ্তি কি ও কতটুকু? সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অহেতুক ক্ষমতার লড়াইয়ে বাংলাদেশের নামি-দামি, প্রতিভাবান, সম্ভাবনাময় ও প্রায় প্রতিষ্ঠিত নেতারা হয় নিহত হয়েছেন আর না হয় সময়ের ব্যবধানে নাজেহাল হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। আর, এর ফলে নানাবিধ দুর্ভোগ ও দুর্দশা বেড়েছে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশীদের, যারা কোনো অবস্থায় এবং কোনোভাবেই ক্ষমতার লড়াইয়ে সম্পৃক্ত নয়।
এখন ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে ইদানীং সবাই বিশেষ করে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শুধুই আরও আরও ক্ষমতার মরীচিকার পেছনে ছুটছে তো ছুটছেই। এ ছোটাছুটির বোধ করি কোনো শেষ নেই। সবাই চান একের উপরে অন্যের সীমাহীন অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা (endless unchallenging power)। কিন্তু কেন, কিসের জন্য, কার পক্ষে এবং কার বিরুদ্ধে তার কোনো নির্দিষ্ট উত্তর আছে কি?
আজ রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে ল্যাম্পপোস্টে সাঁটা পোস্টারে স্লোগানের মতো একটি লেখা লক্ষ্য করলাম, তাতে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষা।’ অথচ, আমাদের নির্বাচন কমিশন তাদের দাফতরিক হাত আরও শক্তিশালী করার জন্য বাড়তি ক্ষমতা চাইছে। এমন কি তাদের ক্ষমতা যেন কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তার জন্য প্রায় দায়মুক্তি পর্যন্তও। পরিতাপের বিষয় হলো, নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠরা যাদের অথবা যে দফতর/প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কিছু একটা শিখবেন তাদেরই বোধ হয় যথাযথ শিক্ষার অভাব রয়ে গেছে। কাজেই, যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলেই ভবিষ্যতে ক্ষমতা আর বাড়তি ক্ষমতার নেশা এদের পেয়ে বসবে না বলে মন্তব্য করলে কিছু ভুল হবে কি?
নির্বাচন কমিশনকে অধিক ক্ষমতা প্রদানের সুবাদে বাংলাদেশের নির্বাচন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে, বিষয়টি একেবারেই স্থূল চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। বস্তুত যে কোনো কাজে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা আসে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুস্থ চিন্তা-চেতনা, সার্বিক মনন আর কর্মতত্পরতার বহিঃপ্রকাশ থেকে। এখানে কম-বেশি ক্ষমতার কোনো স্থানই নেই। ক্ষমতার ফল ক্ষণস্থায়ী ও সময়ের ব্যবধানে অগ্রহণযোগ্য বলে বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। আর ‘ইনডেমনিটি’ প্রদান যে কোনো সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই না।
ক্ষমতা কখন আসে কখন যায়, কখন কোন মানুষ/প্রতিষ্ঠান/সংস্থা ক্ষমতাধর বনে যায় অথবা আবার কখন ক্ষমতা হারায়, ইদানীং সময়ে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বোধকরি আমাদের শত আলোচিত দুর্নীতি দমন কমিশন। এখানে নিকট অতীতের কোনো রকম কাসুন্দি ঘাঁটার ইচ্ছা আমার নেই। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই তো সেদিন, দুর্নীতি দমন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান খেদোক্তি প্রকাশ করে বললেন, দুর্নীতি দমন কমিশন নামক বাঘটির দাঁত তো নেইই এখন নখও উপড়িয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। এহেন বক্তব্য থেকেও নির্বাচন কমিশন কি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না?
সঙ্গত কারণেই, আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো, অহমিকা ও ক্ষমতার ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে বিদায় করা। আর, অর্থ-সম্পদ বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ নাড়াচাড়ায় বেশি বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা। মনে রাখতে হবে, মানুষের জন্য ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী আর উপমা (Image) ও উদাহরণই (Example) চিরস্থায়ী। ক্ষমতার হাত বদল হতে পারে কিন্তু উপমা ও উদাহরণের হাত বদল কখনই হয় না। তাই, উপমা ও উদাহরণই সত্যিকারের মানুষের বৈশিষ্ট্য, কোনোভাবেই কম-বেশি ক্ষমতা নয়।
লেখক : পেনশনার
haquenoor@yahoo.com
No comments