ইমরান খানের মতো আরও অনেকেই যে শিক্ষা নিতে পারে-একাত্তর by মোঃ আনোয়ার হোসেন
ইমরান খান ও জর্জ ওয়াশিংটনের বক্তব্য অনুযায়ী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি বন্দি সৈন্যকে মুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, সেই ১৯৩ জন পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের দোসর এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের কোনো ক্ষমা নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নেতৃবৃন্দকেও পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে হবে যে, গণতন্ত্রের দুর্বলতার কোনো সুযোগ নিয়ে কখনোই শাসনভার নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ার কোনো চেষ্টাই তারা করবেন না ভেতরে যে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে, নির্মম সত্য আছে, তা ইমরান খানের 'একাত্তর থেকে পাকিস্তান শিক্ষা নেয়নি' শীর্ষক শিরোনামের সাক্ষাৎকার থেকে বোঝা যায় না। ইমরান খানকে কে না চেনে। মার্জিত, শিক্ষিত এই মানুষটি পাকিস্তান ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব দিয়ে জিতে নিয়েছিলেন বিশ্বকাপ। পাকিস্তানের বাইরেও তিনি পরিচিত মুখ। পৃথিবী জোড়া তার নাম। ক্রিকেটের বাইরেও অনেক কিছু করেছেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মায়ের মৃত্যুর পর তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য পাকিস্তানে গড়ে তুলেছেন অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল। এজন্য জনে জনে হাত পেতেছেন সহায়তার জন্য। দূত হয়েছেন জাতিসংঘের নানা জনহিতকর কাজে। শুধু সুশীল হয়ে থাকেননি। যে দুরূহ কাজে নামতে সুশীল সমাজ দ্বিধাগ্রস্ত সেই কাজ অর্থাৎ রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন এবং এ পর্যন্ত দলটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে পেরেছেন। পাকিস্তান এবং তার বাইরেও উপমহাদেশের দেশগুলোতে রাজনীতিকদের অনেকের সম্পর্কেই যে জনমানসে বিরূপ ধারণা, ইমরান খানকে সে কাতারে ফেলা যায় না। তার স্ত্রী জেমিমা সন্তানদের নিয়ে ব্রিটেন চলে গেছেন। কিন্তু ইমরান খান সমরতন্ত্র, গণতন্ত্রহীনতা এবং ইসলামী জঙ্গিদের অব্যাহত সন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত মাতৃভূমি পাকিস্তানেই রয়ে গেছেন। পত্রপত্রিকার অভিমত অনুযায়ী বর্তমান সময়ে পাকিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি গণ্য হচ্ছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মনের কথা সাহসের সঙ্গে তুলে ধরে তিনি যে রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। তার ওপর দেশ-বিদেশের অনেকেই ভরসা রাখতে শুরু করেছেন।
সে ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ সাময়িকী 'দ্য ক্যারাভান' সম্প্রতি প্রকাশ করেছে ইমরান খানের সাক্ষাৎকার। বাংলায় অনূদিত হয়ে সমকালসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনামের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্মম সত্যের কথা শুরুতে বলেছি। কী সেসব কথা?
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে আইনের শাসন বিষয়ে তাদের অর্থাৎ পাকিস্তানের শিক্ষা নেওয়ার আছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের হয়ে ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে থাকাকালের স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি। সম্ভবত ১ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক ম্যাচটির কথা বলেছেন তিনি_ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে মুহূর্তে গোটা বাংলাদেশ ভূখণ্ড গর্জে ওঠে। ক্লাস রুম থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক, কলকারখানা থেকে শ্রমিক, অফিস থেকে কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং খেলার মাঠ থেকে দর্শকরা নেমে আসেন রাজপথে। ইমরান খান ঢাকায় থেকে নিজ কানে শুনেছেন পাকিস্তানি সমর শাসকদের সেই অভিশপ্ত নির্দেশ, 'ওই বামন ও কালোদের হত্যা কর।' সম্ভবত তিনি এও শুনে থাকবেন_ স্বাধীনতা যারা চায় তাদের হত্যা কর। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা কর। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দাও। নারীদের ধর্ষণ কর। বর্তমান পাকিস্তানেও একই ধরনের নির্মম নির্দেশ শুনছেন তিনি। পার্থক্য হলো বাঙালিদের বদলে এখন ওই নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে পাকিস্তানের পশতুনদের ওপর। বেলুচদের ওপরও তা হয়েছিল। পাকিস্তানি জান্তা বাঙালিদের চিরতরে দমিয়ে রাখার জন্য বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিতি পাওয়া টিক্কা খানকে ঢাকায় পাঠিয়েছিল সেনাপতি হিসেবে। তার তত্ত্বাবধানেই শুরু হয় ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন।
২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সম্মিলিতভাবে 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' শুরু করলে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী, সেই একই ধরনের গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে স্বাধীনচেতা পশতুনদের ওপর। পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দুর্গম আফগান সীমান্তবর্তী এলাকায় পশতুনদের বাস। তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি এই পশতুন জাতি তালেবান, পাঞ্জাবি বা কারও অধীনতা চায় না। তারা চায় নিজস্ব জাতিসত্তা বাঁচিয়ে রাখতে। মনে পড়ল, তাদের মহান নেতা সীমান্ত গান্ধী হিসেবে পরিচিত আবদুল গফ্ফার খানের কথা। ১৯৭১ সালে যখন পাঞ্জাবি সেনাতন্ত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, তখন গফ্ফার খান ও তার রাজনৈতিক দল ন্যাপ এর প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তানে সে সময়ে সীমিত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাই এমন দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।
সাক্ষাৎকারে ইমরান খান আরও কী বলেছেন? 'তারা (পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক ও যুদ্ধাপরাধী) শাস্তি পেলে আমাদের (পাকিস্তান) একই পথে (সেনাশাসন ও নিপীড়ন) হাঁটতে হতো না।'
বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে ইমরান খানের সাহসী উচ্চারণ কী অর্থ বহন করে? আমাদের বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের বহু শিক্ষাই নেওয়ার আছে ইমরান খানের বক্তব্য থেকে। শিক্ষা নেওয়ার আছে আমাদের সেনানায়কদেরও। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর নির্যাতিত মানুষের বহু প্রতাশিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। চার দশক ধরেই এ দাবি জোরালো ছিল। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে এ দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত দাবি ছিল_ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা নেই। গত কয়েক মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের একে একে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ আটক হয়েছেন গোলাম আযম_ যার নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ। তাদের বিচারও শুরু হয়েছে। এ বিচারকে বানচাল করার জন্য শুরু হয়েছে নানা ষড়যন্ত্র। পরিতাপের কথা হলো, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও সে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র এবং তাদের সরকারের অংশীদার জামায়াতে ইসলামী তাদের ওপর সওয়ার হয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা ও জাল বিস্তৃত করছে। ইমরান খান ৪০ বছর পর যে সত্য অনুধাবন করছেন শুধু নয়, তা প্রকাশও করছেন, তার মর্মবাণী আমাদের গণতন্ত্র প্রত্যাশিত রাজনীতিবিদ, সমরবিদ ও সুশীল সমাজকে অনুধাবন করতে হবে। তা হলো, কখনোই সমরতন্ত্র বা সামরিক শাসন নয়, গণতান্ত্রিক শাসনেই আমাদের মুক্তি। সামরিক শাসন কখনোই গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না। এ বিষয়ে বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ভাবতে হবে। এই দলের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া এবং অন্য নেতৃবৃন্দ আশির দশকে এবং ২০০৭-২০০৮ সালে সামরিক শাসকদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। তাই জামায়াতে ইসলামীর ষড়যন্ত্রের নীলনকশার ফাঁদে তারা আটকে পড়তে পারেন না।
ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারকে শিক্ষা নিতে হবে ইমরান খানের বোধোদয় ও বক্তব্য থেকে। দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সম্পন্ন করা হবে তাদের অন্যতম কর্তব্য। আরও একটি কাজ শাসক দল করতে পারে। তা হলো, মুক্তিযুদ্ধকালে চিহ্নিত ১৯৩ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী যারা পাকিস্তান-ভারতের সিমলা চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিল, তাদের বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে হস্তান্তর করার দাবিটি তোলা। ইমরান খান তা সহজ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের একটি বক্তব্য মনে পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, 'ওরা (ইংরেজ সৈন্য), যারা আমাদের হাতে বন্দি তারা যুদ্ধবন্দি, যুদ্ধাপরাধী নয়। আমরা চাইলে তাদের মুক্তি দিতে পারি। কিন্তু নিজ দেশের বাসিন্দা হয়ে যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, হত্যা করেছে, আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে, তারা যুদ্ধবন্দি নয়, তারা যুদ্ধাপরাধী। তাদের কোনো ক্ষমা নেই। তাদের হত্যা করার জন্য বুলেট খরচেরও প্রয়োজন নেই। গরম আলকাতরা তাদের মাথায় ঢেলে তাদের হত্যা করা প্রয়োজন।'
ইমরান খান ও জর্জ ওয়াশিংটনের বক্তব্য অনুযায়ী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি বন্দি সৈন্যকে মুক্তি দেওয়া যায়; কিন্তু যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, সেই ১৯৩ জন পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের দোসর এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের কোনো ক্ষমা নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নেতৃবৃন্দকেও পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে হবে যে, গণতন্ত্রের দুর্বলতার কোনো সুযোগ নিয়ে কখনোই শাসনভার নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ার কোনো চেষ্টাই তারা করবেন না। তা মহাভুল হবে। পাকিস্তানের ইমরান খান বর্তমান পাকিস্তানের নির্মম বাস্তবতা থেকে যে শিক্ষালাভ করেছেন, তা নিশ্চয়ই আমাদের সমরবিদরাও উপলব্ধি করবেন। বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের নির্বিঘ্ন যাত্রার জন্য এটাই প্রয়োজন। এর ভিত এখনও যতই সীমিত ও দুর্বল হোক না কেন, তার বিকল্প সামরিক শাসন হতে পারে না।
ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন :অধ্যাপক
প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ, বিজ্ঞান বিভাগ
সভাপতি, ঢাবি শিক্ষক সমিতি
সে ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ সাময়িকী 'দ্য ক্যারাভান' সম্প্রতি প্রকাশ করেছে ইমরান খানের সাক্ষাৎকার। বাংলায় অনূদিত হয়ে সমকালসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনামের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্মম সত্যের কথা শুরুতে বলেছি। কী সেসব কথা?
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে আইনের শাসন বিষয়ে তাদের অর্থাৎ পাকিস্তানের শিক্ষা নেওয়ার আছে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের হয়ে ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে থাকাকালের স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি। সম্ভবত ১ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক ম্যাচটির কথা বলেছেন তিনি_ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার প্রতিবাদে মুহূর্তে গোটা বাংলাদেশ ভূখণ্ড গর্জে ওঠে। ক্লাস রুম থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক, কলকারখানা থেকে শ্রমিক, অফিস থেকে কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং খেলার মাঠ থেকে দর্শকরা নেমে আসেন রাজপথে। ইমরান খান ঢাকায় থেকে নিজ কানে শুনেছেন পাকিস্তানি সমর শাসকদের সেই অভিশপ্ত নির্দেশ, 'ওই বামন ও কালোদের হত্যা কর।' সম্ভবত তিনি এও শুনে থাকবেন_ স্বাধীনতা যারা চায় তাদের হত্যা কর। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা কর। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দাও। নারীদের ধর্ষণ কর। বর্তমান পাকিস্তানেও একই ধরনের নির্মম নির্দেশ শুনছেন তিনি। পার্থক্য হলো বাঙালিদের বদলে এখন ওই নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে পাকিস্তানের পশতুনদের ওপর। বেলুচদের ওপরও তা হয়েছিল। পাকিস্তানি জান্তা বাঙালিদের চিরতরে দমিয়ে রাখার জন্য বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিতি পাওয়া টিক্কা খানকে ঢাকায় পাঠিয়েছিল সেনাপতি হিসেবে। তার তত্ত্বাবধানেই শুরু হয় ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন।
২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সম্মিলিতভাবে 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ' শুরু করলে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী, সেই একই ধরনের গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে স্বাধীনচেতা পশতুনদের ওপর। পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দুর্গম আফগান সীমান্তবর্তী এলাকায় পশতুনদের বাস। তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি এই পশতুন জাতি তালেবান, পাঞ্জাবি বা কারও অধীনতা চায় না। তারা চায় নিজস্ব জাতিসত্তা বাঁচিয়ে রাখতে। মনে পড়ল, তাদের মহান নেতা সীমান্ত গান্ধী হিসেবে পরিচিত আবদুল গফ্ফার খানের কথা। ১৯৭১ সালে যখন পাঞ্জাবি সেনাতন্ত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল, তখন গফ্ফার খান ও তার রাজনৈতিক দল ন্যাপ এর প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তানে সে সময়ে সীমিত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাই এমন দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।
সাক্ষাৎকারে ইমরান খান আরও কী বলেছেন? 'তারা (পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক ও যুদ্ধাপরাধী) শাস্তি পেলে আমাদের (পাকিস্তান) একই পথে (সেনাশাসন ও নিপীড়ন) হাঁটতে হতো না।'
বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে ইমরান খানের সাহসী উচ্চারণ কী অর্থ বহন করে? আমাদের বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের বহু শিক্ষাই নেওয়ার আছে ইমরান খানের বক্তব্য থেকে। শিক্ষা নেওয়ার আছে আমাদের সেনানায়কদেরও। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর নির্যাতিত মানুষের বহু প্রতাশিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। চার দশক ধরেই এ দাবি জোরালো ছিল। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে এ দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত দাবি ছিল_ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা নেই। গত কয়েক মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের একে একে কারাগারে নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ আটক হয়েছেন গোলাম আযম_ যার নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ। তাদের বিচারও শুরু হয়েছে। এ বিচারকে বানচাল করার জন্য শুরু হয়েছে নানা ষড়যন্ত্র। পরিতাপের কথা হলো, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও সে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র এবং তাদের সরকারের অংশীদার জামায়াতে ইসলামী তাদের ওপর সওয়ার হয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা ও জাল বিস্তৃত করছে। ইমরান খান ৪০ বছর পর যে সত্য অনুধাবন করছেন শুধু নয়, তা প্রকাশও করছেন, তার মর্মবাণী আমাদের গণতন্ত্র প্রত্যাশিত রাজনীতিবিদ, সমরবিদ ও সুশীল সমাজকে অনুধাবন করতে হবে। তা হলো, কখনোই সমরতন্ত্র বা সামরিক শাসন নয়, গণতান্ত্রিক শাসনেই আমাদের মুক্তি। সামরিক শাসন কখনোই গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না। এ বিষয়ে বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে ভাবতে হবে। এই দলের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া এবং অন্য নেতৃবৃন্দ আশির দশকে এবং ২০০৭-২০০৮ সালে সামরিক শাসকদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। তাই জামায়াতে ইসলামীর ষড়যন্ত্রের নীলনকশার ফাঁদে তারা আটকে পড়তে পারেন না।
ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারকে শিক্ষা নিতে হবে ইমরান খানের বোধোদয় ও বক্তব্য থেকে। দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সম্পন্ন করা হবে তাদের অন্যতম কর্তব্য। আরও একটি কাজ শাসক দল করতে পারে। তা হলো, মুক্তিযুদ্ধকালে চিহ্নিত ১৯৩ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী যারা পাকিস্তান-ভারতের সিমলা চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিল, তাদের বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে হস্তান্তর করার দাবিটি তোলা। ইমরান খান তা সহজ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের একটি বক্তব্য মনে পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, 'ওরা (ইংরেজ সৈন্য), যারা আমাদের হাতে বন্দি তারা যুদ্ধবন্দি, যুদ্ধাপরাধী নয়। আমরা চাইলে তাদের মুক্তি দিতে পারি। কিন্তু নিজ দেশের বাসিন্দা হয়ে যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, হত্যা করেছে, আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি ঘটিয়েছে, তারা যুদ্ধবন্দি নয়, তারা যুদ্ধাপরাধী। তাদের কোনো ক্ষমা নেই। তাদের হত্যা করার জন্য বুলেট খরচেরও প্রয়োজন নেই। গরম আলকাতরা তাদের মাথায় ঢেলে তাদের হত্যা করা প্রয়োজন।'
ইমরান খান ও জর্জ ওয়াশিংটনের বক্তব্য অনুযায়ী ৯৩ হাজার পাকিস্তানি বন্দি সৈন্যকে মুক্তি দেওয়া যায়; কিন্তু যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, সেই ১৯৩ জন পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের দোসর এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের কোনো ক্ষমা নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নেতৃবৃন্দকেও পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে হবে যে, গণতন্ত্রের দুর্বলতার কোনো সুযোগ নিয়ে কখনোই শাসনভার নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ার কোনো চেষ্টাই তারা করবেন না। তা মহাভুল হবে। পাকিস্তানের ইমরান খান বর্তমান পাকিস্তানের নির্মম বাস্তবতা থেকে যে শিক্ষালাভ করেছেন, তা নিশ্চয়ই আমাদের সমরবিদরাও উপলব্ধি করবেন। বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের নির্বিঘ্ন যাত্রার জন্য এটাই প্রয়োজন। এর ভিত এখনও যতই সীমিত ও দুর্বল হোক না কেন, তার বিকল্প সামরিক শাসন হতে পারে না।
ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন :অধ্যাপক
প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ, বিজ্ঞান বিভাগ
সভাপতি, ঢাবি শিক্ষক সমিতি
No comments