কান্নায় ভেঙে পড়েন সাক্ষী-‘সাঈদীসহ রাজাকাররা তিন বোনকে নিয়ে সেনাক্যাম্পে দেয়’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল সোমবার জবানবন্দি দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ১৩তম সাক্ষী। জবানবন্দিতে তাঁর তিন বোনকে সাঈদীসহ রাজাকারদের পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে দেওয়ার এবং তাঁদের পুরো পরিবারকে জোর করে ধর্মান্তরিত করার বর্ণনা দেন।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৩তম সাক্ষী এই জবানবন্দি দেন।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৩তম সাক্ষী এই জবানবন্দি দেন।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তিনি জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদিন সাঈদী কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে পিরোজপুরে তাঁদের (সাক্ষীর) বাড়িতে যান। রাজাকাররা তাঁদের বাড়ি লুট করে এবং তাঁর তিন বোনকে ধরে নিয়ে পিরোজপুরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসে। তিন দিন পর তিন বোনকে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল ২৭ বছর।
তিন বোনের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে সাক্ষী কান্নায় ভেঙে পড়েন। জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ওই ঘটনার কিছুদিন পর সাঈদী আবার কয়েকজন রাজাকার নিয়ে তাঁদের বাড়িতে যান। রাজাকাররা তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পরিবারের সব সদস্যকে জোর করে ধর্মান্তরিত করে। তাঁর নাম দেওয়া হয় আবদুল গনি। তাঁদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হয়। এর কিছুদিন পর তিনি ছাড়া পরিবারের অন্য সবাই ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর তিনি নিজ (হিন্দু) ধর্মে ফিরে আসেন।
জবানবন্দির এ পর্যায়ে সাক্ষী আবেগে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান এবং কাঁদতে থাকেন। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে শান্ত হয়ে বসতে বলেন।
জবানবন্দিতে সাক্ষী বলেন, তাঁকে ছাড়া আরও এক-দেড় শ হিন্দুসম্প্রদায়ের লোককে রাজাকাররা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নারায়ণ সাহা, নিখিল পাল, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল। তাঁদের অনেকে মারা গেছেন, অনেকে ভারতে চলে গেছেন।
সাক্ষীর জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত। জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে তিনি সাক্ষীর কাছে জানতে চান, সাঈদীকে তিনি চেনেন কি না? জবাবে সাক্ষী কাঠগড়ায় বসা সাঈদীকে দেখিয়ে দেন এবং তাঁকে চেনেন বলে জানান। তিনি বলেন, সাঈদীর শ্বশুরবাড়ি খালের ওপারে। তিনি তাঁদের (সাক্ষীর) বাড়ির কাছে বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
জবানবন্দি শেষে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। তিনি এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী রুহুল আমিন, মোস্তফা হাওলাদার, সুলতান আহমেদ হাওলাদার, মাহতাবউদ্দিন হাওলাদার, মানিক পসারি, জলিল শেখ ও বাসুদেব মিস্ত্রীর নাম উল্লেখ করে সাক্ষীর কাছে জানতে চান, এঁদের তিনি চেনেন কি না? সাক্ষী তাঁদের চেনেন বলে জানান। মিজানুল জানতে চান, সাক্ষীর তিন বোনকে নির্যাতন ও ধর্মান্তরিত করার ঘটনা ওই সাক্ষীরা জানেন কি না? জবাবে সাক্ষী বলেন, তাঁরা কী জানেন না-জানেন, তা তিনি বলতে পারবেন না।
বেলা একটায় এক ঘণ্টা বিরতির পর দুইটার দিকে আবার জেরা শুরু হয়। মিজানুল জানতে চান, সাক্ষী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে লুট হওয়া জিনিসপত্রের কোনো তালিকা দিয়েছেন কি না? জবাবে সাক্ষী বলেন, সবকিছু এমনকি ঘর ঝাড় দেওয়ার পিছা (ঝাড়ু) পর্যন্ত লুট হয়েছে। স্বাধীনতার পর নিজ ধর্মে ফিরতে কোনো প্রায়শ্চিত্ত করেছেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জীবনের মায়ায় ধর্মান্তরিত হয়েছি, এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত দরকার নেই।
একপর্যায়ে মিজানুল বলেন, সাক্ষীর ভোটার তালিকায় জন্ম তারিখ দেওয়া আছে ১৯৬৩ সালের ৮ জুলাই। এ সময় সাক্ষী বলেন, ভুল তারিখ বলায় অথবা লেখায় ভোটার তালিকায় জন্ম তারিখ ভুল হয়েছে।
পরে সাক্ষীকে জেরা করেন আসামিপক্ষের অপর আইনজীবী মনজুর আহমেদ আনসারী। তিনি আইনগত মতামতে বলেন, সাক্ষী সরকারি সুবিধা পেয়ে এবং আরও সুবিধা লাভের আশায় সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে সাক্ষী বলেন, এটি সত্য নয়।
বিকেল চারটার দিকে জেরা শেষ হলে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
(প্রথম আলোর নীতি অনুসারে সাক্ষী ও তাঁর বোনদের নাম প্রকাশ করা হলো না।)
No comments