চারদিক-ছোটদের জন্য ছোটদের আয়োজন!

ড় বড় গাছে ঘেরা বেশ উঁচু একটি জায়গা। ভেতরে সবুজ ঘাসে বসতে ইচ্ছে করে। চারদিকে সবুজের রাজত্ব। এখানেই এক পাশে কয়েকজন গোল হয়ে বসে আছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, ওদের একজন দাঁড়িয়ে গল্প পড়ছে। তার নিজের লেখা গল্প। বয়স আর কত হবে, খুব বেশি হলে ১২ বছর। ছেলেটি গল্প পড়া শেষে বসে পড়ল। নাম ঘোষণা করা হলো আরেকজনের। সে দাঁড়িয়ে একটি ছড়া পড়ল। এরপর একে একে প্রায় সবাই পড়ল।


কেউ গল্প, কেউ বা ছড়া আর কেউ কবিতা; তাও আবার স্বরচিত। শেষে একজন ওদের সবার লেখা নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। কীভাবে লিখলে আরও ভালো হবে, বেশি বেশি করে পড়তে হবে ইত্যাদি। ১৭ জনের দলের দুজন ছাড়া কারও বয়স ১৬ পেরোয়নি। এরা সবাই স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী। প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও দুজন রয়েছে। সবার কথা শুনে বোঝা গেল, এটা একটি সাহিত্য আসর। স্থানীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ‘ফুটতে দাও ফুল’-এর আয়োজনে ৬৩তম সাহিত্য আসর এটি।
২৯ ডিসেম্বর শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার সরকারি নার্সারিতে বসেছিল এই আসর। সেদিন সংগঠনটির আট বছর পূর্তি হয়। মফস্বল এলাকায় সাহিত্যচর্চা করা সহজ বিষয় নয়। বড় বড় শহরেই সাহিত্যচর্চা করা বড়দের জন্য কঠিন। আর দেশের সীমান্তবর্তী একটি এলাকায় কয়েকজন শিশু-কিশোর সাহিত্যচর্চা করছে। এখন পর্যন্ত ৬৩টি সাহিত্য আসরের আয়োজন করা হয়েছে। শুধু সাহিত্য আসরই নয়, ছোটদের জন্য তারা একটি পত্রিকাও বের করেছে। ফুলকলি নামের পত্রিকাটির নয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। শুধু ফুটতে দাও ফুল-এর সদস্য কিংবা শেরপুরের লেখকেরাই নয়, সারা দেশের বিভিন্ন জায়গার অনেক লেখকের লেখাও এতে ছাপা হয়েছে। ফুলকলির নবম সংখ্যা দেখে ভালোই লাগল। আকারে ছোট হলেও বেশ পরিপাটি। ছোটদের লেখার পাশাপাশি দেশের খ্যাতনামা লেখকদের লেখাও রয়েছে এতে। না বললে বিশ্বাসই হবে না, এটি ফটোকপি করে ছাপানো।
সংগঠনটির সহ-পরিচালক রেজাউল করিম লিটন জানান, ২০০৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ করি/ সুন্দর ভবিষ্যৎ এসো গড়ি’ স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে ফুটতে দাও ফুল-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় একটি পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে। পাঠাগারে নিয়মিত তিনটি জাতীয় দৈনিক রাখা হতো এবং বই ছিল শতাধিক। বড়রাও এসে পাঠাগারে পত্রিকা পড়তেন। পাঠাগারটিই সংগঠনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহূত হতো। এর আগে খেলাধুলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সংগঠনের কার্যক্রম। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ফুলকলির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ২০০৫ সালে শুরু হয় সাহিত্য আসর। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বসত এই আসর। ২০০৮ সালের শুরুর দিকে বিভিন্ন সমস্যার কারণে পাঠাগারটি বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে চারটি লেখালেখির কর্মশালা, একটি ক্যারিয়ার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে তিনটি পাঠচক্র হয়েছে।
পরিবেশ রক্ষায় গাছের ভূমিকা অনেক। সংগঠনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রায় ১৫০০ গাছের চারা বিতরণ করেছে। বিভিন্ন দিবসে ছোটদের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। ধূমপান না করতে শপথ গ্রহণ করেছে জড়িত সবাই। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম করেছে। সবচেয়ে বড় কাজ যেটি করেছে, তা হলো শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন। এতে ছোটদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। প্রেসক্লাব-শ্রীবরদীর সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান আবু বলেন, ‘ছোটদের মেধা বিকাশে সাহিত্যচর্চা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন অনেক জরুরি। আর এসব আয়োজন করার কথা বড়দের। কিন্তু পুরো জেলায় ছোটদের নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। আমাদের এখানে ছোটদের জন্য ছোটরাই আয়োজন করছে। ওরা আমাদের গর্ব।’
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানজিল রিমন বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের সবাই ছোট হওয়ায় পাঠাগারটি বন্ধ হয়ে গেছে। কেননা কোনো ঘর ভাড়া নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এখন কোনো কার্যালয় নেই। কিন্তু আমাদের কার্যক্রম থেমে নেই। ভবিষ্যতে আমরা পাঠাগারটি আবারও চালু করব। প্রতিবছর দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়ার চিন্তা আছে। স্থানীয়ভাবে বইমেলা ও ছোটদের জন্য পত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
২৯ ডিসেম্বর সাহিত্য আসর শেষে ফুটতে দাও ফুল-এর অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে আগামী ১৮ ও ২০ জানুয়ারি দুই দিনব্যাপী এক ‘শিশু উৎসব’ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে থাকছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য চিত্রাঙ্কন, কবিতা আবৃত্তি, রচনা লিখন, উপস্থিত বক্তৃতা, একক অভিনয়, একক নৃত্য, যেমন খুশি তেমন সাজোসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। থাকছে আনন্দ শোভাযাত্রা, পুরস্কার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এখন থেকে প্রতিবছর শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয় জেলার সাত ব্যক্তিকে ‘ফুটতে দাও ফুল সম্মাননা পদক’ দেওয়া হবে। শিশুসাহিত্যের ছড়া শাখায় অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে পদকপ্রাপ্তরা হলেন: সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, আলম তালুকদার, আনজীর লিটন, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, জগলুল হায়দার, লুলু আব্দুর রহমান ও রইস মনরম। আগামী ২০ জানুয়ারি শিশু উৎসবে ফুটতে দাও ফুল সম্মাননা পদক ২০১১ তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। শিশু উৎসবে প্রধান অতিথি থাকবেন বিশিষ্ট কবি ও শিশুসাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী।
তাইয়্যেবুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.