আমায় ক্ষমো হে-ওয়াল স্ট্রিট দখল আন্দোলন ও বাজার অর্থনীতির ভবিষ্যৎ by মামুন রশীদ
আসলেই কি বর্তমান বিশ্ব আর্থিক সংকট এবং মন্দাবস্থা পুঁজিবাদী অর্থনীতির পতন নিয়ে এসেছে? আমরা কি দেখতে পাচ্ছি সমাজতন্ত্রের উত্থান? অর্থনীতিবিদদের মতে, ইদানীংকালের মন্দাবস্থার পেছনে দায়ী হচ্ছে উন্নত অর্থনীতিগুলোতে নিয়ন্ত্রক মহলের ব্যর্থতা এবং সেই সুযোগে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ। যেটি আগেই বলেছি, এর ফলে প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বাজার ও প্রতিষ্ঠানগুলো।
আর্থিক বাজারের ব্যাপক পতন এবং বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সামগ্রিক মন্দাবস্থা নেমে আসে, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে পূর্ণাঙ্গ বাজারভিত্তিক অর্থনীতির বিবেচনা থেকে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির কিছু অসংলগ্নতাও রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়টি চোখে পড়ে সেটি হলো তথ্যের অসংলগ্নতা বা অপ্রতিসম তথ্য। যেমন_ঋণগ্রহীতারা তাদের নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য বা সচ্ছলতা সম্পর্কে যতটা ওয়াকিবহাল থাকে, ঋণদাতারা সেই তুলনায় অনেক কমই জানে। আর এ কারণেই ঋণগ্রহীতাদের ব্যাপারে ঋণদাতারা ঝুঁকি নিরূপণের যে কাজটি করেছে, সেটি যথাযথ হয়নি, অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ রয়ে গেছে। তার ওপর ঋণের ঝুঁকির পর্যালোচনায় কদাচিৎ বিরূপ পরিস্থিতি আমলে নেওয়া হয়। অনেকটা অনুমাননির্ভর প্রাক্কলনের কারণে ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়াটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণে স্বভাবতই একটি ঘূর্ণায়মান (প্রো-সাইক্লিক) প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। যখন ঋণের চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি সম্পদের মূল্যও বাড়ছিল, তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক পরিমাণে ঋণ সরবরাহ করছিল। কিন্তু বাজারভিত্তিক চাহিদা ও সরবরাহের সঙ্গে সম্পর্কহীন এই মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তখন আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এতে ঋণগ্রহীতাদের ভোগের প্রবণতা এবং সেই সঙ্গে বিনিয়োগও কমতে থাকে।
২০০৭ সালে সৃষ্ট উত্তর আমেরিকা তথা যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সংকটের ভূত ব্যাপক 'বেইল আউট' বা পুনরুদ্ধার প্যাকেজের পরও যেন শেষ হয়নি। বরং ইদানীংকালের ওয়াল স্ট্রিট দখল আন্দোলনসহ এই আন্দোলন পৃথিবীর আরো অনেক বড় শহরে ছড়িয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, সংকট যেন আরো ঘনীভূত হচ্ছে। প্রায় নেতৃত্বহীন সাধারণ জনগণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের এই আন্দোলন যদিও খুব একটা কার্যকর হবে বলে মনে হয় না, তবে তা বর্তমান বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা মডেলের প্রতি যে বেশ কিছুটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। অনেকে আবার অনেকটা এগিয়ে গিয়ে বলছেন, 'বাজার অর্থনীতির বারোটা বাজতে আর দেরি নেই; এই যেন এগিয়ে আসছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বজ্রনিনাদ।'
তৃতীয়ত, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক দিক থেকেও কিছু বিপদের ঝুঁকি ছিল। যেমন_বড় মাপের অনেক প্রতিষ্ঠানই মনে করেছিল, ব্যর্থতা অন্তত তাদের ছুঁতে পারবে না। তারা যদি সমস্যায়ও পড়ে, তখন তাদের উদ্ধার করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ থেকে সহায়তা পাওয়ার এই আশ্বাস কিন্তু বাজারভিত্তিক ধারণার পরিপন্থী।
আর্থিক খাতে সংকট দেখা দেওয়াটা একেবারে নতুন কোনো বিষয় নয়। এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক খাতে ভয়াবহ রকমের সংকট বা বিপর্যয়ের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। তখন ওই সব দেশের সরকারগুলোও বড় অঙ্কের আর্থিক পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ এবং সংশোধনমূলক পদক্ষেপ হাতে নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গত শতকের আশির দশকে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে আর্জেন্টিনা, চিলি, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রে। আবার নব্বইয়ের দশকে একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ফিনল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, মেঙ্েিকা, কোরীয় প্রজাতন্ত্র, সুইডেন, থাইল্যান্ড, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি দেশে। এখন আবার দেখছি যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশে। শোনা যাচ্ছে, আবাসন খাতে 'ফানুস' বিনিয়োগে চীনও কিছুটা সংকটে আছে। কিন্তু বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারের আর্থিক সংকটের সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী বিশেষত উন্নত দেশগুলোর (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি) বাজার নিয়ন্ত্রক এবং নীতিনির্ধারণী মহলের বেশ কিছু পদক্ষেপ।
প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে ২০০১ সালের বিশেষত ১১ সেপ্টেম্বর-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক অর্থনীতিতে প্রণোদনা সৃষ্টির জন্য জোর করে সুদের হার নামিয়ে আনার ঘটনাটি। কিন্তু আমরা জানি, পুঁজিবাদী তথা বাজারভিত্তিক অর্থনীতির মূলমন্ত্র হচ্ছে, বাজারই নির্ধারণ করবে সব পণ্যসহ বাজার সূচকের (সুদের হার, বিনিময় হার) মান। বাজারভিত্তিক অর্থনীতির পরিপন্থী এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাৎক্ষণিক সুফল বয়ে আনলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাজারপ্রবাহের বিপরীতে সুদের হার জোর করে নামিয়ে না আনলে হয়তো ব্যাপক পরিসরে এ রকম মন্দাবস্থার সৃষ্টি হতো না।
দ্বিতীয়ত, জটিল ঋণপণ্যগুলোর (কমপ্লেঙ্ ডেট সিকিউরিটিজ) কারণে এবং নতুন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সনাতনি বা প্রচলিত ব্যাংকিং নিয়মকানুন মেনে না চলার কারণে আর্থিক বাজারে যে ঝুঁকি দেখা দেয়, সেটির তীব্রতা মূল্যায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা লক্ষ করা গেছে। বাজারভিত্তিক ঝুঁকি পর্যালোচনার ভিত্তিতে এসব সহযোগী পণ্য বা ডেরিভেটিভের মূল্য নির্ধারিত হলে অনেক বিনিয়োগকারীর কাছেই এগুলো আকর্ষণীয় হতো না।
সর্বোপরি সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো অতীতের আর্থিক সংকটগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আগাম পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়া, ঋণ সংকোচন, ভোগব্যয় ও বিনিয়োগে মন্দা, পণ্য ও সেবা উৎপাদনে ভাটা এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার পরই যেন টনক নড়ে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর। বিলম্বিত বোধোদয়ের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অবশ্য দফায় দফায় নীতিনির্ধারণী কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সংকটে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন কর্মসূচির আওতায় নগদ অর্থের জোগান দেয়। জাতীয় বাজেটেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়দেনার হিসাব প্রাক্কলন করা হয়। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন পুঁজির জোগান দেয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল নির্বিশেষে দেশে দেশে আর্থিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এর আওতায় কমানো হয় আয়কর ও ভোক্তা কর। সেই সঙ্গে কম্পানিগুলোর কর পরিশোধ স্থগিত রাখা হয়। আবার ভোগের প্রবণতা বাড়াতে পারিবারিক পর্যায়ে নগদ অর্থ ও শপিং ভাউচার দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং পরিবহন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি খাতে সরকারগুলো প্রচুর পরিমাণে ব্যয় বাড়ায়।
প্রাথমিকভাবে কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখেই উলি্লখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়। লক্ষ্যগুলো হচ্ছে_১. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সচ্ছলতা জোরদার করার মাধ্যমে তাদের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা বাড়ানো; ২. ভোগব্যয় ও বিনিয়োগের চাহিদা জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে ঋণের চাহিদা বাড়ানো; ৩. যেসব পরিবার সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে, তাদের প্রয়োজনের সময় সাহায্য দেওয়া ইত্যাদি। বর্তমান সংকটটি যেহেতু আগেরগুলোর মতোই আবাসন খাতে এবং পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে বায়বীয় অর্থনীতির ওপর ভিত্তিশীল, এটি ঠিক করতে গেলেও তাই আমাদের কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
আগামী দিনগুলোতে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো আর্থিক খাতের ওপর কঠোর নজরদারির পদক্ষেপ নেবে বলে অনেকেই মনে করছেন। বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও উপকরণগুলোকে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা হবে। জাতীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকি করার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত খতিয়ে দেখতে হবে। এ ঘটনাগুলোর কারণে আমাদের মনে হতে পারে, আমরা কি বাজারভিত্তিক অর্থনীতির বিপরীত পথে চলা শুরু করেছি? রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্রের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি কি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিপন্থী নয়? কিন্তু একটু পর্যালোচনা করলেই আমরা অনুধাবন করতে পারব, এই পদক্ষেপগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রচলিত অর্থনৈতিক ধারাকে বাজারব্যবস্থার দিকে নিয়ে আসা। অতীতে বিভিন্ন অনিয়ম এবং বাজারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণে আর্থিক খাত তথা অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি থেকে যে অসংলগ্নতা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারের কঠিন নজরদারির মধ্যে রয়েছে, তার কোনোটাই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার চিরকাল নিজের নিয়ন্ত্রণে বা নজরদারির মধ্যে রাখার আশা পোষণ করে না; বরং বাজারব্যবস্থা একটু স্বাভাবিক হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগুলো বেসরকারি নিয়ন্ত্রণেই (ইতিমধ্যে অনেকেই সরকারের দেওয়া জরুরি অর্থ সাহায্য ফেরত দিতে শুরু করেছে কিংবা দিয়ে দিয়েছে) ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এমনকি বেশির ভাগই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সংকটের সময় স্বাভাবিক অবস্থাবহির্ভূত অনেক পদক্ষেপই নেওয়া হয়। সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা না করে বিচ্ছিন্ন বিশ্লেষণ করার ফলে আমরা এমন অনেক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, যা হয়তো প্রকৃত সত্য ও ঘটনাপ্রবাহের পরিপন্থী। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট এবং তার মোকাবিলায় নীতিনির্ধারক মহলের কর্মপ্রবাহের পর্যালোচনায় হয়তো অনেকেই বাজারভিত্তিক ব্যবস্থার বিপরীতধর্মী কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন; কিন্তু সেই স্বপ্ন হয়তো কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। যত দিন ব্যক্তির উদ্যোগের সাফল্য তাকে আলস্য, মেধাহীনতা ও উদ্যোগহীনতা থেকে দূরে রাখতে পারবে, তত দিন বাজার ও মুনাফাভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থাই চালাবে বিশ্ব অর্থনীতি। তবে জনস্বার্থ ও দায়িত্বশীলতার দিকটিতে নজর দিতে হবে আরো জোরালোভাবে। ভারসাম্য আনতে হবে রাষ্ট্র ও বাজারের ভূমিকার মধ্যেও। রাষ্ট্রকে হতে হবে অনেক বেশি সংবেদনশীল, পক্ষপাতহীন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়।
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
এ ক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয়টি চোখে পড়ে সেটি হলো তথ্যের অসংলগ্নতা বা অপ্রতিসম তথ্য। যেমন_ঋণগ্রহীতারা তাদের নিজেদের আর্থিক সামর্থ্য বা সচ্ছলতা সম্পর্কে যতটা ওয়াকিবহাল থাকে, ঋণদাতারা সেই তুলনায় অনেক কমই জানে। আর এ কারণেই ঋণগ্রহীতাদের ব্যাপারে ঋণদাতারা ঝুঁকি নিরূপণের যে কাজটি করেছে, সেটি যথাযথ হয়নি, অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ রয়ে গেছে। তার ওপর ঋণের ঝুঁকির পর্যালোচনায় কদাচিৎ বিরূপ পরিস্থিতি আমলে নেওয়া হয়। অনেকটা অনুমাননির্ভর প্রাক্কলনের কারণে ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়াটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আচরণে স্বভাবতই একটি ঘূর্ণায়মান (প্রো-সাইক্লিক) প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। যখন ঋণের চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি সম্পদের মূল্যও বাড়ছিল, তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক পরিমাণে ঋণ সরবরাহ করছিল। কিন্তু বাজারভিত্তিক চাহিদা ও সরবরাহের সঙ্গে সম্পর্কহীন এই মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তখন আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এতে ঋণগ্রহীতাদের ভোগের প্রবণতা এবং সেই সঙ্গে বিনিয়োগও কমতে থাকে।
২০০৭ সালে সৃষ্ট উত্তর আমেরিকা তথা যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের সংকটের ভূত ব্যাপক 'বেইল আউট' বা পুনরুদ্ধার প্যাকেজের পরও যেন শেষ হয়নি। বরং ইদানীংকালের ওয়াল স্ট্রিট দখল আন্দোলনসহ এই আন্দোলন পৃথিবীর আরো অনেক বড় শহরে ছড়িয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, সংকট যেন আরো ঘনীভূত হচ্ছে। প্রায় নেতৃত্বহীন সাধারণ জনগণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের এই আন্দোলন যদিও খুব একটা কার্যকর হবে বলে মনে হয় না, তবে তা বর্তমান বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা মডেলের প্রতি যে বেশ কিছুটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। অনেকে আবার অনেকটা এগিয়ে গিয়ে বলছেন, 'বাজার অর্থনীতির বারোটা বাজতে আর দেরি নেই; এই যেন এগিয়ে আসছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বজ্রনিনাদ।'
তৃতীয়ত, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক দিক থেকেও কিছু বিপদের ঝুঁকি ছিল। যেমন_বড় মাপের অনেক প্রতিষ্ঠানই মনে করেছিল, ব্যর্থতা অন্তত তাদের ছুঁতে পারবে না। তারা যদি সমস্যায়ও পড়ে, তখন তাদের উদ্ধার করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ থেকে সহায়তা পাওয়ার এই আশ্বাস কিন্তু বাজারভিত্তিক ধারণার পরিপন্থী।
আর্থিক খাতে সংকট দেখা দেওয়াটা একেবারে নতুন কোনো বিষয় নয়। এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক খাতে ভয়াবহ রকমের সংকট বা বিপর্যয়ের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। তখন ওই সব দেশের সরকারগুলোও বড় অঙ্কের আর্থিক পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ এবং সংশোধনমূলক পদক্ষেপ হাতে নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গত শতকের আশির দশকে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা গেছে আর্জেন্টিনা, চিলি, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রে। আবার নব্বইয়ের দশকে একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ফিনল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, মেঙ্েিকা, কোরীয় প্রজাতন্ত্র, সুইডেন, থাইল্যান্ড, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি দেশে। এখন আবার দেখছি যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশে। শোনা যাচ্ছে, আবাসন খাতে 'ফানুস' বিনিয়োগে চীনও কিছুটা সংকটে আছে। কিন্তু বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারের আর্থিক সংকটের সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী বিশেষত উন্নত দেশগুলোর (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি) বাজার নিয়ন্ত্রক এবং নীতিনির্ধারণী মহলের বেশ কিছু পদক্ষেপ।
প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে ২০০১ সালের বিশেষত ১১ সেপ্টেম্বর-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক অর্থনীতিতে প্রণোদনা সৃষ্টির জন্য জোর করে সুদের হার নামিয়ে আনার ঘটনাটি। কিন্তু আমরা জানি, পুঁজিবাদী তথা বাজারভিত্তিক অর্থনীতির মূলমন্ত্র হচ্ছে, বাজারই নির্ধারণ করবে সব পণ্যসহ বাজার সূচকের (সুদের হার, বিনিময় হার) মান। বাজারভিত্তিক অর্থনীতির পরিপন্থী এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাৎক্ষণিক সুফল বয়ে আনলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাজারপ্রবাহের বিপরীতে সুদের হার জোর করে নামিয়ে না আনলে হয়তো ব্যাপক পরিসরে এ রকম মন্দাবস্থার সৃষ্টি হতো না।
দ্বিতীয়ত, জটিল ঋণপণ্যগুলোর (কমপ্লেঙ্ ডেট সিকিউরিটিজ) কারণে এবং নতুন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সনাতনি বা প্রচলিত ব্যাংকিং নিয়মকানুন মেনে না চলার কারণে আর্থিক বাজারে যে ঝুঁকি দেখা দেয়, সেটির তীব্রতা মূল্যায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা লক্ষ করা গেছে। বাজারভিত্তিক ঝুঁকি পর্যালোচনার ভিত্তিতে এসব সহযোগী পণ্য বা ডেরিভেটিভের মূল্য নির্ধারিত হলে অনেক বিনিয়োগকারীর কাছেই এগুলো আকর্ষণীয় হতো না।
সর্বোপরি সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো অতীতের আর্থিক সংকটগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আগাম পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়া, ঋণ সংকোচন, ভোগব্যয় ও বিনিয়োগে মন্দা, পণ্য ও সেবা উৎপাদনে ভাটা এবং কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার পরই যেন টনক নড়ে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর। বিলম্বিত বোধোদয়ের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অবশ্য দফায় দফায় নীতিনির্ধারণী কিছু পদক্ষেপ নেয়। এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সংকটে পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন কর্মসূচির আওতায় নগদ অর্থের জোগান দেয়। জাতীয় বাজেটেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়দেনার হিসাব প্রাক্কলন করা হয়। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন পুঁজির জোগান দেয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল নির্বিশেষে দেশে দেশে আর্থিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এর আওতায় কমানো হয় আয়কর ও ভোক্তা কর। সেই সঙ্গে কম্পানিগুলোর কর পরিশোধ স্থগিত রাখা হয়। আবার ভোগের প্রবণতা বাড়াতে পারিবারিক পর্যায়ে নগদ অর্থ ও শপিং ভাউচার দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং পরিবহন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি খাতে সরকারগুলো প্রচুর পরিমাণে ব্যয় বাড়ায়।
প্রাথমিকভাবে কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখেই উলি্লখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়। লক্ষ্যগুলো হচ্ছে_১. আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সচ্ছলতা জোরদার করার মাধ্যমে তাদের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা বাড়ানো; ২. ভোগব্যয় ও বিনিয়োগের চাহিদা জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে ঋণের চাহিদা বাড়ানো; ৩. যেসব পরিবার সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে, তাদের প্রয়োজনের সময় সাহায্য দেওয়া ইত্যাদি। বর্তমান সংকটটি যেহেতু আগেরগুলোর মতোই আবাসন খাতে এবং পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে বায়বীয় অর্থনীতির ওপর ভিত্তিশীল, এটি ঠিক করতে গেলেও তাই আমাদের কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
আগামী দিনগুলোতে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো আর্থিক খাতের ওপর কঠোর নজরদারির পদক্ষেপ নেবে বলে অনেকেই মনে করছেন। বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও উপকরণগুলোকে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা হবে। জাতীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকি করার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে কি না, তা নিয়মিত খতিয়ে দেখতে হবে। এ ঘটনাগুলোর কারণে আমাদের মনে হতে পারে, আমরা কি বাজারভিত্তিক অর্থনীতির বিপরীত পথে চলা শুরু করেছি? রাষ্ট্র ও প্রশাসনযন্ত্রের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি কি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিপন্থী নয়? কিন্তু একটু পর্যালোচনা করলেই আমরা অনুধাবন করতে পারব, এই পদক্ষেপগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রচলিত অর্থনৈতিক ধারাকে বাজারব্যবস্থার দিকে নিয়ে আসা। অতীতে বিভিন্ন অনিয়ম এবং বাজারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের কারণে আর্থিক খাত তথা অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি থেকে যে অসংলগ্নতা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারের কঠিন নজরদারির মধ্যে রয়েছে, তার কোনোটাই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার চিরকাল নিজের নিয়ন্ত্রণে বা নজরদারির মধ্যে রাখার আশা পোষণ করে না; বরং বাজারব্যবস্থা একটু স্বাভাবিক হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগুলো বেসরকারি নিয়ন্ত্রণেই (ইতিমধ্যে অনেকেই সরকারের দেওয়া জরুরি অর্থ সাহায্য ফেরত দিতে শুরু করেছে কিংবা দিয়ে দিয়েছে) ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এমনকি বেশির ভাগই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সংকটের সময় স্বাভাবিক অবস্থাবহির্ভূত অনেক পদক্ষেপই নেওয়া হয়। সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা না করে বিচ্ছিন্ন বিশ্লেষণ করার ফলে আমরা এমন অনেক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, যা হয়তো প্রকৃত সত্য ও ঘটনাপ্রবাহের পরিপন্থী। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট এবং তার মোকাবিলায় নীতিনির্ধারক মহলের কর্মপ্রবাহের পর্যালোচনায় হয়তো অনেকেই বাজারভিত্তিক ব্যবস্থার বিপরীতধর্মী কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন; কিন্তু সেই স্বপ্ন হয়তো কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে। যত দিন ব্যক্তির উদ্যোগের সাফল্য তাকে আলস্য, মেধাহীনতা ও উদ্যোগহীনতা থেকে দূরে রাখতে পারবে, তত দিন বাজার ও মুনাফাভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থাই চালাবে বিশ্ব অর্থনীতি। তবে জনস্বার্থ ও দায়িত্বশীলতার দিকটিতে নজর দিতে হবে আরো জোরালোভাবে। ভারসাম্য আনতে হবে রাষ্ট্র ও বাজারের ভূমিকার মধ্যেও। রাষ্ট্রকে হতে হবে অনেক বেশি সংবেদনশীল, পক্ষপাতহীন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়।
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
No comments