চরাচর-গুইসাপের অস্তিত্ব হুমকির মুখে by আজিজুর রহমান
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলদেশের গবেষণায় (২০০০) প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। রেকর্ডবুকে স্থান পাওয়া এই ১২৬টি সরীসৃপ প্রজাতিকে চারটি বর্গের ১৭টি গোত্রের অধীনে রাখা হয়েছে। চারটি বর্গের মধ্যে স্কোয়ামাটা বর্গকে আবার দুটি উপবর্গে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি হলো লেসারটিলিয়া। বাংলাদেশের গুইসাপ লেসারটিলিয়া উপবর্গের একটি প্রাণী।
শীতল রক্তবিশিষ্ট এই প্রাণীর গোত্রের নাম ভ্যারানিডাই। পৃথবীতে মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসেবে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল এই সরীসৃপরা, যারা স্থলভাগে অভিযোজিত হয়ে বসবাস শুরু করে। পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চলে এই সরীসৃপ বা গুইসাপদের দেখা যায়। ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো ড্রাগন কিংবা মেঙ্েিকার মরু অঞ্চলের গিলা মনস্টার অনেকের কাছেই পরিচিত। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ গুইসাপদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। একসময় বাংলাদেশের সর্বত্র বিপুল সংখ্যায় দেখা যেত। এখনো কমবেশি এদের দেখা যায়। বর্তমানে তিন প্রজাতির গুইসাপ দেশের সব এলাকায় কোনোমতে টিকে আছে। এগুলো হলো কালো গুইসাপ, সোনা গুইসাপ ও রামগদি গুইসাপ। এরা এক ধরনের টিকটিকি। এদের জিহ্বা মসৃণ, লম্বা, সরু, অগ্রভাগ দ্বিখণ্ডিত লিকলিকে এবং সাপের মতো সংকোচনশীল। দাঁতগুলো পোরোডন এবং পেছনে বাঁকানো। মুখ বন্ধ থাকলেও তুণ্ডের আগায় ফাঁক থাকায় তার ভেতর দিয়ে জিহ্বা চলাচল করতে পারে। সারা দেহ দানাদার বা গোলাকৃতির আঁশে আবৃত। কালো গুই পাঁচ ফুটের মতো লম্বা হয়ে থাকে। সোনা গুই কালো গুইয়ের চেয়ে ছোট আকৃতির হয়। রামগদি গুইসাপ বিশাল আকৃতির হয়ে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক রামগদি গুই সর্বোচ্চ ১২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। কালো গুই লোকালয়ে বসতবাড়ির আশপাশে বাস করে। তবে সোনা গুইদের স্বভাব কালো গুইসাপের সম্পূর্ণ বিপরীত। এরা লোকালয় থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। এদের বেশি দেখা যায় হাওর বা বিলের কাছাকাছি জায়গায়। এরা দক্ষ সাঁতারু। আর রামগদি গুইসাপ সম্পূর্ণ নোনা পানির বাসিন্দা। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় দ্বীপগুলোয় এদের বসবাস। এরা গাছে চড়তে বেশ দক্ষ। গুইসাপের খাদ্য হচ্ছে ছোট সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, কেঁচো, ছোট মাছ, কাঁকড়া, শামুক, সাপ-কচ্ছপ, হাঁস-মুরগির ডিম ইত্যাদি। সুযোগ পেলে এরা হাঁস-মুরগিও শিকার করে। এ ছাড়া জীবজন্তুর মৃতদেহও এরা সাবাড় করে। গুইসাপ ২০-৩০টি ডিম দেয়। এরা ডিম পাড়ে সাধারণত উইয়ের ঢিবি, গাছের কোটরে ও মাটির গর্তে। গুইসাপ কুমিরের মতো ছোট বাচ্চার পরিচর্যা করে না, তাই বাচ্চাগুলোর বেশির ভাগই নানা প্রাণীর পেটে চলে যায়। গুইসাপ নিঃসন্দেহে পরিবেশবান্ধব উপকারী জীব। খাদ্যশৃঙ্খলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এরা পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। এ ছাড়া গুইসাপের চামড়া খুবই মূল্যবান। আন্তর্জাতিক বাজারে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। গুইসাপের চামড়া দিয়ে দামি জুতা, ব্যাগ, কোমরের বেল্ট ইত্যাদি শৌখিন পণ্য তৈরি হয়। পরিবেশবান্ধব এই উপকারী প্রাণীটি এখন হুমকির মুখে। বন ধ্বংস, খাদ্যাভাব, পরিবেশদূষণ, অতিরিক্ত কৃষিকাজ, নগরসভ্যতার সম্প্রসারণ, চোরা চামড়া ব্যবসায়ীদের বেপরোয়া শিকার ও জনসচেতনতার অভাব এর অন্যতম কারণ। আইইউসিএন কালো গুইসাপকে সংকটাপন্ন এবং সোনা গুইসাপ ও রামগদি গুইসাপকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।
আজিজুর রহমান
No comments