আন্তর্জাতিক-গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের দোলাচলে পাকিস্তান by শ্রাবণ সরকার
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশটির অনুষঙ্গ। প্রায় সাড়ে ছয় দশকের ইতিহাসের অর্ধেকেরও বেশি সময় পাকিস্তানের ক্ষমতা ছিল সামরিক বাহিনীর হাতে কিংবা সেনা সমর্থিত সরকারের জিম্মায়। এ যাবৎকালে চার-চারটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে দেশটিতে। আজ অবধি কোনো বেসামরিক বা নির্বাচিত সরকারই তার ্পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
বর্তমান জারদারি-গিলানি সরকারের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছর। তার আগেই দেখা দিতে শুরু করেছে সরকার পতনের নানা আলামত, শোনা যাচ্ছে আগাম নির্বাচনের শোরগোলও। ওয়াকিবহাল মহল জানেন, পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বরাবরের সম্পর্ক, এক কথায় অহি-নকুল। সেই 'যুদ্ধংদেহী' পরস্পরবিরোধী সম্পর্কের কিছুমাত্র নড়চড় হয়নি এখনো। তার সর্বশেষ উদাহরণ, সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে সৃষ্ট টানাপড়েন। ফলে চরম রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশটির ভবিষ্যৎ। এমন অস্থির পরিস্থিতিতে ফের সেনা অভ্যুত্থানের কবলে কি পড়তে যাচ্ছে পাকিস্তান_এমন প্রশ্ন ঘরে-বাইরে অনেকেরই মনে।
কেন এই দ্বন্দ্ব
কার্যত মনসুর ইজাজ নামের পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন ব্যবসায়ীর হাতেই বর্তমান সংকটের শুরু। গত অক্টোবরে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে একটি নিবন্ধ লেখেন তিনি। সেখানে তিনি দাবি করেন, সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান ঠেকাতে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কাটছাঁট করতে মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের কাছে সহায়তা চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি তাঁকে (ইজাজ) সেই 'গোপন চিঠি' (মেমোগেট) মার্কিন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও কর্মকর্তাদের ক্ষমতার রাশ আলগা করতে মার্কিন সহায়তা কামনা করার সেই ঘটনা ফাঁস হওয়ায় সরকার ও প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় নেমে এসেছে বললেও কম বলা হয়! বহুল বিতর্কিত সেই মেমোগেটের সূত্র ধরে সরকার ও সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন পরস্পর বিপরীতমুখী। ঘটনাচক্রে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বিচার বিভাগও। সব মিলিয়ে কার্যত ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছে দেশটিতে।
গোড়ার কথা
সম্ভাব্য এই অভ্যুত্থানের আশঙ্কার পেছনে রয়েছেন ওসামা বিন লাদেন! গত বছর মে মাসে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর গোপন অভিযানে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আল-কায়েদা নেতা বিন লাদেন নিহত হন। পাকিস্তানকে অন্ধকারে রেখে তাদের ভূখণ্ডে মার্কিন এ অভিযান থেকেই সংকটের সূত্রপাত। এ ঘটনায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার প্রশ্নে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। সেনাবাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। এ অবস্থায় সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কাই সরকারের মনে দানা বাঁধে বলে বলা হচ্ছে।
পরিস্থিতি কোন পথে?
এই মেমোগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ায় সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয় দ্বৈরথ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে বলে গুজবও রটতে থাকে বায়ুবেগে। হুসেইন হাক্কানিকে তলব করে ওয়াশিংটন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁকে বরখাস্তও করে সরকার। এতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বলাই বাহুল্য, এ ধরনের গোপন চিঠির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা, জারদারি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হাক্কানি উভয়েই অস্বীকার করেছেন।
তবে বাস্তবে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, বিষয়টি এখন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের কাঁধে। বিরোধীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার আদ্যোপান্ত দিবালোকে হাজির করার দায়িত্ব এখন আদালতের। প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরী ইতিমধ্যে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, সামরিক বাহিনী বা ক্ষমতাসীন পিপিপি কেউই তাঁকে সত্য উদ্ঘাটন থেকে নিরস্ত্র করতে পারবে না।
যেভাবে আদালতে বিষয়টি
এই মেমোগেট কেলেঙ্কারি তদন্তে পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-এন) নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফসহ কয়েকজন আদালতে আবেদন করেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীসহ ৯ জন বিচারপতিকে নিয়ে একটি বেঞ্চ গঠিত হয়। বেঞ্চে শুনানি শেষে চারজন বিচারপতির সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন আদালত। এই নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করতে আদালতে আবেদন করেন হাক্কানি।
আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিশন ইতিমধ্যে তাদের কাজ শুরু করেছে। তবে সরকার এই বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের বিরোধী ছিল। তাই এই কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে একটি পার্লামেন্টারি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে সরকার। উভয় কমিশনই তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই মেমোগেট কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সেনাপ্রধান ও আইএসআই প্রধানও।
প্রতাপশালী সেনাবাহিনী
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কেবল তাত্তি্বকভাবেই সে দেশের সরকারের অধীন। যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের ঊধর্ে্ব থেকেই যে তারা তাদের 'মর্জিমাফিক' কাজ করে, তার নজির ভূরি ভূরি। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটির সুপ্রিম কোর্টের কাছে দেওয়া এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছে, সামরিক বাহিনীর ওপর তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই।
জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি ২০০৭ সালে সেনাপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে সচেতনভাবেই সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন, বেসামরিক প্রশাসন থেকে সামরিক কর্তাব্যক্তিদের ফিরিয়ে নিয়েছেন। কায়ানির আগ্রহ মূলত দুটি বিষয়ের ওপর, এক প্রতিরক্ষা ও দুই পররাষ্ট্রনীতি। এ দুটি বিষয়ের ওপর তিনি নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। তাই তিনি যে আলোচিত মেমোগেট কেলেঙ্কারির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন, তা অসংগত নয়।
তবে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা এড়িয়ে সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার ঘটনাকে অসাংবিধানিক বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী গিলানি। প্রত্যুত্তরে চরম ক্রোধেরও প্রকাশ ঘটায় সেনাবাহিনী। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে 'সাংঘাতিক' আখ্যায়িত করে, এ কারণে সৃষ্ট জটিলতা এবং এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
তবে প্রশ্ন ওঠে, যে সেনাবাহিনী আজ অসাংবিধানিকতার অভিযোগে নাখোশ, সেই সেনাবাহিনীই চারবার সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করেছে। চলমান অস্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও তাদের বিরাট ভূমিকা। আর সংবিধানের প্রশ্নে তাদের অখুশি হওয়ার আগে, সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে প্রেসিডেন্টকে মান্য করাই তো সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব, এটা ভেবে না দেখা পরিহাস মাত্র।
চাপের মুখে সরকার
সেনাবাহিনী এবং আদালতের রায়ে কোণঠাসা সরকার। এ অবস্থায় গদি বাঁচাতে 'গণতন্ত্রের পক্ষে' আস্থা ভোট চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী গিলানি। গত শুক্রবার পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে 'গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে' সরকার ও বিরোধী নির্বিশেষে পার্লামেন্টের সব সদস্যের ভোট চান তিনি। তাঁর ভাষায়, 'নিজের জন্য বা প্রেসিডেন্ট জারদারির জন্য কারও কাছে সমর্থন চাইছি না। দুর্নীতির পক্ষে দাঁড়াতেও বলছি না। ভোট চাইছি দেশের গণতন্ত্রের জন্য। আপনারাই স্থির করুন, গণতন্ত্র থাকবে না স্বৈরতন্ত্র।'
বিশ্লেষকদের মতে, শীর্ষ আদালত ও সেনাবাহিনীর যৌথ 'আক্রমণের' মুখে অস্তিত্ব রক্ষায় নেওয়া গিলানির আস্থা ভোটের অভিনব পন্থা ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। সরকারের হয়ে জোটসঙ্গী আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি প্রধানের পেশ করা এই প্রস্তাবে পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল গতকাল সোমবার।
আবার গণতন্ত্রের পক্ষে ভোটাভুটির জন্য এমনই দিন নির্ধারণ করা হয়েছে, যেদিন সুপ্রিম কোর্টেও প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে। জারদারির বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতিসংক্রান্ত বেশ কিছু পুরনো মামলা রয়েছে, যা ২০০৭ সালে অর্ডিন্যান্স করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ওই মামলাগুলো ফের পুনরুজ্জীবিত করতে গিলানি সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, তার মেয়াদও শেষ হয়েছে গতকাল। এ প্রতিবেদন প্রেসে পাঠানো অবধি জারদারির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত ছিল না গিলানি সরকারের।
জারদারির ওই সব মামলা ফের চালু না করলে গিলানির বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে শীর্ষ আদালত ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। মেমোগেট কেলেঙ্কারি নিয়েও একটি শুনানি হওয়ার কথা ছিল গতকাল। এ পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট কী পদক্ষেপ নেয়, সেদিকেই তাকিয়ে গোটা পাকিস্তান।
বিদেশি কুটুম
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ এ সংকটময় প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসেছে বিনা প্রয়োজনে। দেশটি পাকিস্তানকে নিয়মিতভাবে যে অর্থ সাহায্য দেয়, তা থেকে ৩৬০ মিলিয়র ডলারের একটি বরাদ্দ বাতিল করেছে। ন্যাটো-মার্কিন বাহিনীর হামলায় ২৪ পাকিস্তানি সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে ভুল স্বীকার করলেও দুঃখ প্রকাশ করেনি। এ পরিস্থিতিতে কিছুটা সুযোগের আঁচ পেয়েছে চীন। পাকিস্তানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে কূটনৈতিক দূত পাঠিয়েছে তারা। তবে যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি সতর্ক। তারা ইতিমধ্যে একাধিকবার পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছে।
শেষতক কী হতে পারে?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও চাইছে, 'পরিবর্তন' এলে আদালতের হাত ধরেই আসুক। দেশটির সংবিধানের ১৯০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, মনে করলে নিজেদের কোনো নির্দেশ কার্যকর করাতে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে পারেন শীর্ষ আদালত। সম্ভবত সে কারণেই সেনাকর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের যেকোনো নির্দেশ কার্যকরে তাঁরা প্রস্তুত।
তবে বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণে পার্লামেন্টের ভোটের ফল গিলানির পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। বিশেষত তিনি যখন গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট চেয়েছেন, তখন বিরোধীদের পক্ষেও সরাসরি বিরোধিতা করা কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মত হলো, এ সুযোগে গিলানি যেমন আস্থার সিলমোহর লাগিয়ে তাঁর নড়বড়ে সরকারের 'সার্বিক' অবস্থান দৃঢ় করতে চাইছেন, তেমনি পাকিস্তানে সম্ভাব্য আর একটা সামরিক অভ্যুত্থান রুখতে বিরোধীদেরও পাশে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি তিনি মনে করছেন, আস্থা ভোটের ফল সরকারের পক্ষে গেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পাকিস্তানের রাজনৈতিক মনোভাব নিয়ে সদর্থক বার্তা যাবে, যা কার্যত চাপে রাখবে সেনাসদস্যদের।
সেনাবাহিনীর নাম না করলেও 'গণতন্ত্র বাঁচাতে' জনপ্রতিনিধির সাহায্য চাইতে গিয়ে গিলানি বলেছেন, 'সরকারের মেয়াদ কমাতে চাইলেও সংবিধান সংশোধনের দাবি জানান। প্রস্তাবে সবার সমর্থন থাকলে তা পাসও হবে। কিন্তু আপনারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিন।' সত্যি সত্যিই জনপ্রতিনিধিদের নিজেদের সিদ্ধান্তের ওপরই কার্যত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে পাকিস্তানের।
কেন এই দ্বন্দ্ব
কার্যত মনসুর ইজাজ নামের পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক মার্কিন ব্যবসায়ীর হাতেই বর্তমান সংকটের শুরু। গত অক্টোবরে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে একটি নিবন্ধ লেখেন তিনি। সেখানে তিনি দাবি করেন, সম্ভাব্য সেনা অভ্যুত্থান ঠেকাতে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কাটছাঁট করতে মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের কাছে সহায়তা চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি তাঁকে (ইজাজ) সেই 'গোপন চিঠি' (মেমোগেট) মার্কিন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে পেঁৗছে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ও কর্মকর্তাদের ক্ষমতার রাশ আলগা করতে মার্কিন সহায়তা কামনা করার সেই ঘটনা ফাঁস হওয়ায় সরকার ও প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক সর্বকালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় নেমে এসেছে বললেও কম বলা হয়! বহুল বিতর্কিত সেই মেমোগেটের সূত্র ধরে সরকার ও সেনাবাহিনীর অবস্থান এখন পরস্পর বিপরীতমুখী। ঘটনাচক্রে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বিচার বিভাগও। সব মিলিয়ে কার্যত ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছে দেশটিতে।
গোড়ার কথা
সম্ভাব্য এই অভ্যুত্থানের আশঙ্কার পেছনে রয়েছেন ওসামা বিন লাদেন! গত বছর মে মাসে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর গোপন অভিযানে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আল-কায়েদা নেতা বিন লাদেন নিহত হন। পাকিস্তানকে অন্ধকারে রেখে তাদের ভূখণ্ডে মার্কিন এ অভিযান থেকেই সংকটের সূত্রপাত। এ ঘটনায় দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার প্রশ্নে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। সেনাবাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। এ অবস্থায় সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কাই সরকারের মনে দানা বাঁধে বলে বলা হচ্ছে।
পরিস্থিতি কোন পথে?
এই মেমোগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ায় সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয় দ্বৈরথ। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে বলে গুজবও রটতে থাকে বায়ুবেগে। হুসেইন হাক্কানিকে তলব করে ওয়াশিংটন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁকে বরখাস্তও করে সরকার। এতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বলাই বাহুল্য, এ ধরনের গোপন চিঠির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা, জারদারি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হাক্কানি উভয়েই অস্বীকার করেছেন।
তবে বাস্তবে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, বিষয়টি এখন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের কাঁধে। বিরোধীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার আদ্যোপান্ত দিবালোকে হাজির করার দায়িত্ব এখন আদালতের। প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরী ইতিমধ্যে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, সামরিক বাহিনী বা ক্ষমতাসীন পিপিপি কেউই তাঁকে সত্য উদ্ঘাটন থেকে নিরস্ত্র করতে পারবে না।
যেভাবে আদালতে বিষয়টি
এই মেমোগেট কেলেঙ্কারি তদন্তে পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-এন) নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফসহ কয়েকজন আদালতে আবেদন করেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীসহ ৯ জন বিচারপতিকে নিয়ে একটি বেঞ্চ গঠিত হয়। বেঞ্চে শুনানি শেষে চারজন বিচারপতির সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন আদালত। এই নির্দেশ পুনর্বিবেচনা করতে আদালতে আবেদন করেন হাক্কানি।
আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিশন ইতিমধ্যে তাদের কাজ শুরু করেছে। তবে সরকার এই বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের বিরোধী ছিল। তাই এই কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে একটি পার্লামেন্টারি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে সরকার। উভয় কমিশনই তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই মেমোগেট কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সেনাপ্রধান ও আইএসআই প্রধানও।
প্রতাপশালী সেনাবাহিনী
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কেবল তাত্তি্বকভাবেই সে দেশের সরকারের অধীন। যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের ঊধর্ে্ব থেকেই যে তারা তাদের 'মর্জিমাফিক' কাজ করে, তার নজির ভূরি ভূরি। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটির সুপ্রিম কোর্টের কাছে দেওয়া এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছে, সামরিক বাহিনীর ওপর তাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই।
জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি ২০০৭ সালে সেনাপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে সচেতনভাবেই সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন, বেসামরিক প্রশাসন থেকে সামরিক কর্তাব্যক্তিদের ফিরিয়ে নিয়েছেন। কায়ানির আগ্রহ মূলত দুটি বিষয়ের ওপর, এক প্রতিরক্ষা ও দুই পররাষ্ট্রনীতি। এ দুটি বিষয়ের ওপর তিনি নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। তাই তিনি যে আলোচিত মেমোগেট কেলেঙ্কারির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন, তা অসংগত নয়।
তবে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা এড়িয়ে সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার ঘটনাকে অসাংবিধানিক বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী গিলানি। প্রত্যুত্তরে চরম ক্রোধেরও প্রকাশ ঘটায় সেনাবাহিনী। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে 'সাংঘাতিক' আখ্যায়িত করে, এ কারণে সৃষ্ট জটিলতা এবং এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
তবে প্রশ্ন ওঠে, যে সেনাবাহিনী আজ অসাংবিধানিকতার অভিযোগে নাখোশ, সেই সেনাবাহিনীই চারবার সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করেছে। চলমান অস্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও তাদের বিরাট ভূমিকা। আর সংবিধানের প্রশ্নে তাদের অখুশি হওয়ার আগে, সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে প্রেসিডেন্টকে মান্য করাই তো সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব, এটা ভেবে না দেখা পরিহাস মাত্র।
চাপের মুখে সরকার
সেনাবাহিনী এবং আদালতের রায়ে কোণঠাসা সরকার। এ অবস্থায় গদি বাঁচাতে 'গণতন্ত্রের পক্ষে' আস্থা ভোট চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী গিলানি। গত শুক্রবার পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে 'গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে' সরকার ও বিরোধী নির্বিশেষে পার্লামেন্টের সব সদস্যের ভোট চান তিনি। তাঁর ভাষায়, 'নিজের জন্য বা প্রেসিডেন্ট জারদারির জন্য কারও কাছে সমর্থন চাইছি না। দুর্নীতির পক্ষে দাঁড়াতেও বলছি না। ভোট চাইছি দেশের গণতন্ত্রের জন্য। আপনারাই স্থির করুন, গণতন্ত্র থাকবে না স্বৈরতন্ত্র।'
বিশ্লেষকদের মতে, শীর্ষ আদালত ও সেনাবাহিনীর যৌথ 'আক্রমণের' মুখে অস্তিত্ব রক্ষায় নেওয়া গিলানির আস্থা ভোটের অভিনব পন্থা ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। সরকারের হয়ে জোটসঙ্গী আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি প্রধানের পেশ করা এই প্রস্তাবে পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল গতকাল সোমবার।
আবার গণতন্ত্রের পক্ষে ভোটাভুটির জন্য এমনই দিন নির্ধারণ করা হয়েছে, যেদিন সুপ্রিম কোর্টেও প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে। জারদারির বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতিসংক্রান্ত বেশ কিছু পুরনো মামলা রয়েছে, যা ২০০৭ সালে অর্ডিন্যান্স করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ওই মামলাগুলো ফের পুনরুজ্জীবিত করতে গিলানি সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, তার মেয়াদও শেষ হয়েছে গতকাল। এ প্রতিবেদন প্রেসে পাঠানো অবধি জারদারির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত ছিল না গিলানি সরকারের।
জারদারির ওই সব মামলা ফের চালু না করলে গিলানির বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে শীর্ষ আদালত ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। মেমোগেট কেলেঙ্কারি নিয়েও একটি শুনানি হওয়ার কথা ছিল গতকাল। এ পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট কী পদক্ষেপ নেয়, সেদিকেই তাকিয়ে গোটা পাকিস্তান।
বিদেশি কুটুম
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ এ সংকটময় প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসেছে বিনা প্রয়োজনে। দেশটি পাকিস্তানকে নিয়মিতভাবে যে অর্থ সাহায্য দেয়, তা থেকে ৩৬০ মিলিয়র ডলারের একটি বরাদ্দ বাতিল করেছে। ন্যাটো-মার্কিন বাহিনীর হামলায় ২৪ পাকিস্তানি সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে ভুল স্বীকার করলেও দুঃখ প্রকাশ করেনি। এ পরিস্থিতিতে কিছুটা সুযোগের আঁচ পেয়েছে চীন। পাকিস্তানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে কূটনৈতিক দূত পাঠিয়েছে তারা। তবে যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি সতর্ক। তারা ইতিমধ্যে একাধিকবার পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছে।
শেষতক কী হতে পারে?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও চাইছে, 'পরিবর্তন' এলে আদালতের হাত ধরেই আসুক। দেশটির সংবিধানের ১৯০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, মনে করলে নিজেদের কোনো নির্দেশ কার্যকর করাতে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে পারেন শীর্ষ আদালত। সম্ভবত সে কারণেই সেনাকর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের যেকোনো নির্দেশ কার্যকরে তাঁরা প্রস্তুত।
তবে বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণে পার্লামেন্টের ভোটের ফল গিলানির পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। বিশেষত তিনি যখন গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট চেয়েছেন, তখন বিরোধীদের পক্ষেও সরাসরি বিরোধিতা করা কঠিন বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মত হলো, এ সুযোগে গিলানি যেমন আস্থার সিলমোহর লাগিয়ে তাঁর নড়বড়ে সরকারের 'সার্বিক' অবস্থান দৃঢ় করতে চাইছেন, তেমনি পাকিস্তানে সম্ভাব্য আর একটা সামরিক অভ্যুত্থান রুখতে বিরোধীদেরও পাশে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি তিনি মনে করছেন, আস্থা ভোটের ফল সরকারের পক্ষে গেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পাকিস্তানের রাজনৈতিক মনোভাব নিয়ে সদর্থক বার্তা যাবে, যা কার্যত চাপে রাখবে সেনাসদস্যদের।
সেনাবাহিনীর নাম না করলেও 'গণতন্ত্র বাঁচাতে' জনপ্রতিনিধির সাহায্য চাইতে গিয়ে গিলানি বলেছেন, 'সরকারের মেয়াদ কমাতে চাইলেও সংবিধান সংশোধনের দাবি জানান। প্রস্তাবে সবার সমর্থন থাকলে তা পাসও হবে। কিন্তু আপনারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিন।' সত্যি সত্যিই জনপ্রতিনিধিদের নিজেদের সিদ্ধান্তের ওপরই কার্যত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে পাকিস্তানের।
No comments