আকাশে শান্তির নীড় by মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম

ছর দেড়েক আগে বাংলাদেশ বিমানের জন্য আমরা নতুন একটি প্রতীক ও বর্ণাঙ্গিক বরণ করেছিলাম। তবে কোনো কিছু নিজস্ব না হলে তা হয়তো বেশিদিন টেকে না। তাই ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজ এবং সবুজাভ বলাকা_কোনোটাই স্থায়ী হয়নি। আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি রক্তিম সূর্যের মধ্যে উড্ডীন সাদা বলাকা এবং লাল-সবুজের বর্ণাঙ্গিকে। তবে এ বর্ণাঙ্গিকে নতুনত্ব সংযোজিত হয়েছে। এতে আছে উড়ে চলার ছন্দ ও গতিময়তা।


বিমানের ব্র্যান্ডিংয়ের মূলমন্ত্র Uniquely and Warmly Bangladesh| অতুলনীয় সুষমামণ্ডিত ও উষ্ণ আতিথেয়তার বাংলাদেশ। এই মূলমন্ত্র সাতটি স্তম্ভের ওপর স্থাপিত। সেগুলো হচ্ছে অপরূপ বাংলাদেশ, আন্তরিক আতিথেয়তা, মুখরোচক রসনা, টিমওয়ার্ক, উড্ডয়ন নিরাপত্তা, কারিগরি নির্ভরযোগ্যতাভিত্তিক সময়ানুবর্তিতা এবং আন্তর্জাতিক মান অর্জনের স্পৃহা।
এই মূলমন্ত্র ও ব্র্যান্ড স্তম্ভের সামঞ্জস্যে আমরা সাজিয়েছি আমাদের নতুন বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজটি। প্রথম যেটি বহরে সংযোজিত হচ্ছে তার নাম পালকি। এই নামটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া। এ নাম বাংলার চিরায়ত ও শাশ্বত সংস্কৃতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ৪১৯ আসনের এ উড়োজাহাজে আছে দুটি শ্রেণী। বিজনেস শ্রেণীতে আছে ৩৫টি আসন, আর বাকি আসনগুলো ইকোনমি শ্রেণীর দুটি কেবিনে বিভক্ত। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা বিজনেস শ্রেণীটি সাজিয়েছি জামদানি সাজে। ইউক্লিডের জ্যামিতিক রেখাশিল্প আর বাংলার হাজার বছরের লৌকিক বুনন শিল্পের আবহ এ শ্রেণীতে। ইকোনমি ক্লাসের প্রথম কেবিনটি সাজানো হয়েছে আমাদের জাতীয় ফুল শাপলার সমারোহে। আর দ্বিতীয় কেবিনটি মনকাড়া ও নয়নাভিরাম শরতের কাশফুলের প্রাচুর্যে।
বিজনেস ক্লাসের প্রতিটি সিটই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এবং আরামপ্রদ। ইকোনমি ক্লাসের ৯টি সিটের পাশাপাশি বিন্যাস যাত্রীদের জন্য নিশ্চিত করবে আরামদায়ক ও প্রশস্ত আসনের। প্রতিটি সিটের জন্য বৃহদাকার ১০ ইঞ্চি Video Screen-এ আছে Remote I Touch Screen সুবিধা। এ ছাড়া Reclining Back Rest, Sliding Cushion এবং সেই সঙ্গে Adjustable Head Rest| এটি এমন একটি অত্যাধুনিক ব্যবস্থা, যা সমসাময়িক বিশ্বমানের অন্যান্য এয়ারলাইনসেও এ মূহূর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে না। মোটকথা, পুরো ব্যবস্থাটিই যাত্রীবান্ধব ও Ergonomically Compatible|
আধুনিক এই উড়োজাহাজের অভ্যন্তরে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে অত্যাধুনিক বিনোদনব্যবস্থা। প্রতিটি আসনে আছে নিজস্ব Audio-Video, যেটাকে বলা হয় AVOD অর্থাৎ Audio-Video on Demand । বিনোদনব্যবস্থায় থাকবে তিনটি ভাষার গান, নাটক, সিনেমা এবং ছোট্টমণিদের জন্য ভিডিও গেমসের ব্যবস্থা। তা ছাড়া স্থাপন করা হয়েছে Cabin Mood Light System, যা বাইরে রোদের আলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কেবিনের মধ্যে এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ বিমানের কাছে সবার চাওয়া অনেক। এ কথা অনস্বীকার্য যে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিমান সেভাবে বেড়ে উঠতে পারেনি। সুনির্দিষ্ট কারণ যেমন আছে, অজুহাতও আছে বিস্তর। তাই নন্দিত হওয়ার চেয়ে বিমান নিন্দিত হয়েছে বেশি। অতীতে স্বল্প লাভের মুখ দেখলেও বিগত দুটি বছর কেটেছে চরম উদ্বেগে। আকাশচুম্বী জ্বালানি মূল্যের কারণে আমাদের গুনতে হয়েছে লোকসান। জ্বালানি মূল্যের উচ্চহার, বহরের পুরনো উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ ও মেরামত ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতন-ভাতাদি, লিজকৃত উড়োজাহাজের ভাড়া এবং নতুন উড়োজাহাজের প্রাক ডেলিভারি পেমেন্টের সুদ খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে অনেক। ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভাড়া বাড়াতে গিয়েও বিভিন্নভাবে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ব্যয় সংকোচন ও ভাড়া কমানোর তাগিদ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। অথচ বিমানকে পাল্লা দিতে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর এয়ারলাইনসের সঙ্গে, যারা জ্বালানি খাতে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। গত অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠানটির জন্য কবিগুরুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রার্থনা করেছিলাম_'তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি'। পরম করুণাময়ের অপার কৃপায় এবং সদাশয় সরকারের প্রণোদনা ও সার্বিক সহায়তায় আস্তে আস্তে আমরা সে শক্তি অর্জন করছি। বহরে যে ১০টি নতুন বিমান সংযোজনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তার দুটি এ বছরই আসছে। প্রতিশ্রুত On line booking চালু করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এখন বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে আমাদের যাত্রীরা ঘরে বসে Internet-এর মাধ্যমে টিকিট কিনতে পারেন। অসাধু এজেন্টের কারসাজির কারণে False Booking-এর মাধ্যমে টিকিটের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি রোধ করার লক্ষ্যে GDS System-এর নিবিড় তদারকিসহ আমরা Automated Revenue Management System (RMS)-এর প্রকল্প গ্রহণ করেছি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এ ব্যবস্থা চালু হলে পুরনো সেই অনুযোগ (টিকিট নেই অথচ সিট খালি) আর অনুরণিত হবে না বলে আশা করি।
তবে শুধু উড়োজাহাজ ক্রয় ও ফ্লাইট পরিচালনা বিমান পরিবহনের শেষ কথা নয়। বিমান পরিচালনা ও বিমান পরিবহন সুশৃঙ্খল ও উচ্চমান নিয়ন্ত্রিত একটি পেশা ও ব্যবসা, সেটা হোক ভূমিতে কিংবা আকাশে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কারিগরি দক্ষতা, সুষ্ঠু অপারেশন, উড্ডয়ন নিরাপত্তা ও যাত্রীসেবার মানদণ্ডে বিবেচিত ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন তাই অত্যন্ত জরুরি।
প্রসঙ্গক্রমে নিতান্ত বিবেকের তাড়নায় ও আবেগের বশে একটা কথা বলতে চাই। সমালোচনা গঠনমূলক হলে শিরোধার্য। তবে সমসাময়িক বাংলাদেশে আমরা দেখেছি Constructive Criticism-এর চেয়ে Obstructive Cynicism-এর আধিক্য। Cynicism-এর বাংলা প্রতিশব্দ আমি জানি না। তবে সবচেয়ে নিকটতর হলো ছিদ্রানুসন্ধানী বা ছিদ্রান্বেষী। ইংরেজিতে একটি কথা আছে 'A Cynic knows the price of everything but value of nothing.' এমন লাগামহীন Cynicism সমাজে বয়ে আনবে হতাশা ও জন্ম দেবে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং শ্রদ্ধাবোধের দৈন্যের। শ্বেতশুভ্র বসন-ভূষণে আবৃত সত্যাগ্রহী শ্রদ্ধেয় একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক (শ্রদ্ধেয় ড. আকবর আলি খানের ভাষায় স্তম্ভক) একটি প্রথম শ্রেণীর রশ্মি ছড়ানো পত্রিকায় বর্তমান সরকারের দুই বছর পূর্তিতে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখের সংখ্যায় লিখেছেন : 'পৃথিবীতে আজ যত এয়ারলাইনস আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়।' তিনি আরো লিখেছেন, 'তিন বছরের মধ্যে অনুমান করি, এই সংস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।'
সেদিন পরম করুণাময়ের কাছে অশ্রুসিক্ত হয়ে প্রার্থনা করেছিলাম, তিনি যেন একদিন এর উত্তর দেওয়ার সুযোগ করে দেন। আজকে সে সুযোগ এসেছে। বিমান ধ্বংস হয়ে যায়নি, ইনশাল্লাহ, যাবেও না। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন জাতীয় পতাকাবাহী এ প্রতিষ্ঠান বিমানও ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে।
তবে পথ এখনো অনেক বাকি। তাই আজকের মুহূর্তে প্রার্থনা, 'ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনই অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।'
লেখক : বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
myaki_islam@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.