রক্তে ভয়ংকর মাত্রায় বিষ-অবিলম্বে সব দূষণ রোধ করতে হবে

বাংলাদেশের মানুষের রক্তে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ৫০ গুণ পর্যন্ত বেশি বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে। মূলত দূষিত খাবার ও পানীয় গ্রহণ এবং পরিবেশদূষণের কারণেই মানুষের শরীরে ক্রমে বেশি করে বিষ জমা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স এবং সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। এটি রীতিমতো ভয়ংকর এক দুঃসংবাদ।


অথচ তা নিয়ে আমাদের কারো কোনো মাথাব্যথা নেই_না রাষ্ট্রের, না ব্যক্তির। মঙ্গলবারের কালের কণ্ঠে এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শরীরে এ ধরনের বিষের উপস্থিতি ক্যান্সার সৃষ্টি, লিভার ও কিডনি অকেজো করাসহ নানা ধরনের রোগব্যাধির জন্ম দিতে পারে এবং দিচ্ছেও। সাম্প্রতিক কালের বিভিন্ন তথ্যে বাংলাদেশে এই রোগব্যাধির ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিই এর প্রমাণ।
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, মানুষের শরীরে প্রতি গ্রাম রক্তে শূন্য দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বিষ সহনীয় হলেও একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের রক্তে ৯ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বিষ পাওয়া গেছে। আবর্জনা অথবা ভারী ধাতব পদার্থ নিয়ে কাজ করে এমন শিশুদের কারো কারো শরীরে ১৩ দশমিক ৬ মাইক্রোগ্রাম (৬৮ গুণ) পর্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে। কিভাবে মানুষের শরীরে এসব বিষ ছড়াচ্ছে? কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বাজারে এখন এমন খাদ্যদ্রব্য পাওয়াই কঠিন, যাতে কোনো না কোনো ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য নেই। মাছের পচন ঠেকাতে ফরমালিনসহ নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। দুধে ফরমালিন মেশানো হয়। ফল পাকাতে কার্বাইডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। গুড় সাদা করতে রাসায়নিক মেশানো হয়। আরো কত কী! এমনকি সাদা দেখানোর জন্য মুড়ি ভাজতেও ইউরিয়া মেশানো হয়। অন্যদিকে ফসলি জমিতে কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে যেখানে কীটনাশক আমদানি করা হয়েছিল তিন কোটি ৮৫ লাখ টাকার, সেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে কীটনাশক আমদানি করা হয়েছে ১৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকার। আর আমদানির চেয়েও বেশি পরিমাণ কীটনাশক দেশে প্রবেশ করে অবৈধভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে, যার বেশির ভাগই আসে ভারত ও চীন থেকে। আমাদের কৃষকদের কোন ফসলের কতটুকু জমিতে কতটুকু কীটনাশক এবং কী ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে সেই জ্ঞান নেই বললেই চলে। ফলে তাঁরা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করেন। অতিরিক্ত কীটনাশক খাদ্যবাহিত হয়ে মানব-শরীরে আসে। প্রতিটি কীটনাশকেরই সক্রিয় আয়ুষ্কাল আছে। জ্ঞান না থাকায় যেখানে স্বল্প আয়ুষ্কালের কীটনাশক ব্যবহার করলে চলে, সেখানে দীর্ঘ আয়ুষ্কালের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। সে অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবহারের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেসব শাকসবজি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়। অথচ দেখা যায়, তরি-তরকারিতে কীটনাশক ব্যবহারের পরদিনই সেগুলো তারা বাজারে নিয়ে আসে। সেই তরি-তরকারি খেলে শরীরেও বিষক্রিয়া হয়। অনেক কল-কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদী বা জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও পানির মাধ্যমে সেগুলো মানব-শরীরে প্রবেশ করে। ভারী ধাতব কারখানায় কাজ করার সময় যে ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা নেওয়া হয় না। ফলে সেসব কারখানায় কর্মরত শিশুরা সহজেই অধিক পরিমাণে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। একটি স্বাধীন-সভ্য দেশে এই নৈরাজ্য আর কত দিন চলবে?
মানব-শরীরে ক্রমবর্ধমান এই বিষক্রিয়া রোধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগকে শক্তিশালী করে নিয়মিতভাবে খাদ্য তদারকি করতে হবে। এ-জাতীয় গবেষণার মাত্রা আরো বাড়াতে হবে। তা না হলে অচিরেই গোটা জাতির স্বাস্থ্য চরম হুমকির মুখে পড়বে। এ দেশ পঙ্গু, বিকলাঙ্গ ও অসুস্থ মানুষের দেশে পরিণত হবে।

No comments

Powered by Blogger.