সময়ের প্রতিধ্বনি-দুই উপদেষ্টার জয়, বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিপর্যয় by মোস্তফা কামাল
প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট মাসুল আদায় করা হবে না। তিনি বলেন, 'আমরা ট্রানজিট বিষয়ে অভিজ্ঞ নই। ভারত আগে ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করুক। অভিজ্ঞতা অর্জন করা হলে আমরা মাসুলের বিষয়টি বিবেচনা করব।'
এই লেখকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারেও অর্থ উপদেষ্টা একই ধরনের উক্তি করেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, ট্রানজিটের মাসুল চাওয়া উচিত নয়। এটা অসৌজন্য দেখায়। যদিও ভারত ট্রানজিট ফি দেবে না, এ কথা কখনো বলেনি। ঢাকায় সফরে এসে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা স্পষ্টই বলেছিলেন, ট্রানজিট ফি দিতে ভারত রাজি আছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়েও বাংলাদেশের কাছে একটি খসড়া তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, ট্রানজিট হলে উভয় দেশের মানুষই লাভবান হবে। এ জন্য উভয় দেশের আলোচনার ভিত্তিতে ট্রানজিট ফি বা মাসুল নির্ধারণ করলে ভারত তা দিতে রাজি।
তার পরও অর্থ উপদেষ্টা কী কারণে ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ফি আদায় না করার ব্যাপারে 'অতি উদার' মনোভাব দেখালেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তিনি আগে থেকে যেভাবে বলে আসছিলেন, সেভাবেই কাজটি সমাধা হলো। মাসুল ছাড়াই ভারতকে ট্রানজিট ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হলো।
অনেকে বলে থাকেন, ড. মসিউর নাকি দেশের স্বার্থ নয়, ভারতের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ১৯৯৬-২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ছিলেন। তখন থেকেই তিনি ভারতপন্থী আমলা হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। তিনি ভারতকে মুক্তহস্তে সব কিছু দিয়ে দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। এতে যদি দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলিও দিতে হয়, তাতে তাঁর আপত্তি নেই।
তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ড. গওহর রিজভী। তিনি দীর্ঘকাল দেশেই ছিলেন না। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি উদয় হন। তিনি পেশাদার কূটনীতিক নন এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। দেশের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণাই নেই। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার অভিজ্ঞতাও তাঁর নেই। তার পরও তিনি সরকারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
অবশ্য ভারতের পক্ষে এ দুই উপদেষ্টা বেশ করিৎকর্মা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তাঁদের অতি উৎসাহী কর্মকাণ্ড দেখে সবাই ধরেই নিয়েছেন, দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়ে আলোচনার জন্য ভারতের কর্মকর্তাদের ঢাকায় আসার প্রয়োজন নেই। গওহর রিজভী ও মসিউর রহমানকে ভারত মনোনীত করলেই ঢাকায় দিলি্লর স্বার্থ রক্ষা হবে। তাঁরা উভয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দরকষাকষি করে ভারতের প্রয়োজনীয় বিষয় আদায় করে নিতে পারবেন।
প্রিয় পাঠক, দুই উপদেষ্টাকে বিতর্কিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তাঁদের বিতর্কিত ভূমিকা আমাদের দেশের জন্য উদ্বেগের। সে কারণেই তাঁদের প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে করেছি।
গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে আমরা দুই উপদেষ্টার দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। তাঁরা কখনো ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের সঙ্গে, কখনো নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেননের সঙ্গে, আবার কখনো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। নানা রকম আশার বাণী জনগণকে শুনিয়েছেন।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে তাঁরা নিজেদের ক্রেডিট নেওয়ার কাজে বেশি ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। ভারতের সঙ্গে ডিলিংয়ের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা তথা কূটনৈতিক পেশাদারিকে অবজ্ঞা করে উপদেষ্টারা নিজেদের জাহির করতেই সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা এ রকম একটা আবহ তৈরি করেছিলেন, যেন তাঁরাই সব কিছু করছেন; পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিয়ে হচ্ছে না।
একের পর এক টিভি মাধ্যমে, পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজেদের প্রাজ্ঞ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। তাঁদের সরব উপস্থিতির কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মুখরক্ষার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সামনে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তাঁরা করেছেন। তাঁরা বেশ কয়েকবার টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছিলেন, ঢাকায়ই তিস্তা চুক্তি হবে এবং মমতাও আসবেন। তা ছাড়া মনমোহনের এই সফরেই দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। কিন্তু কোনোটাই যখন হলো না, তখন তাঁরা বড় ধরনের হোঁচট খেলেন।
আমরা জানতে পেরেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই উপদেষ্টার কর্মকাণ্ডে খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। ভারতের ব্যাপারে তাঁদের 'অতি উদারতা' দেখে প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অবশেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফর্মুলা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শক্ত অবস্থান নেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত ও আনুষ্ঠানিক বৈঠকে তিনি বলেই দিয়েছিলেন, যেহেতু তিস্তা হয়নি, সেহেতু অন্য কোনো চুক্তি করতে তিনি রাজি নন। তাতে বাংলাদেশের শেষরক্ষা হয়েছিল। কিন্তু উপদেষ্টারা তো বসে থাকার পাত্র নন। তাঁরা ট্রানজিট দেওয়ার জন্য নানা রকম ফাঁকফোকর খুঁজতে থাকলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের এক মাসের মধ্যেই তাঁরা তাতে সফল হলেন।
ভারতের প্রতি দুই উপদেষ্টার 'অতি ভালোবাসা'র খেসারত দিতে হলো বাংলাদেশকে। হারাতে হলো শেষ ট্রাম্পকার্ড ট্রানজিট। এখন আর দরকষাকষির কোনো হাতিয়ারই বাংলাদেশের হাতে থাকল না। এখন ভারত যদি বাংলাদেশকে কিছু নাও দেয়, তাহলেও কিছুই করার থাকবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার উপদেষ্টাদের পরামর্শ না শুনে যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করত, তাহলে হয়তো কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এত বড় বিপর্যয় হতো না। এখন এই বিপর্যয়ের দায়ভার কে নেবে? তা ছাড়া বাংলাদেশ যে ক্ষতির সম্মুখীন হলো, তা-ই বা পূরণ করবে কী দিয়ে?
আমরা আগেও বলেছিলাম, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক সুবিধা নিতে পারে। সম্ভাবনা ও সুযোগ সময়মতো কাজে লাগাতে না পারলে আমরা পিছিয়েই থাকব। দেশের উন্নয়ন চাইলে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সব দরজা বন্ধ রেখে ঘরে বসে থাকলে একঘরে হয়ে যেতে হবে। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা উন্নয়নের গতিধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হব, নাকি হাত গুটিয়ে বসে থাকব!
আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব না, আবার উদারহস্তে অন্য দেশকে সব কিছু দিয়েও দেব না। আমাদের লাভের দিকটাই আগে দেখতে হবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শুধু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যই নয়, নেপাল ও ভুটানকেও ট্রানজিট-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এই তিন দেশই বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট ব্যবহারের সুযোগ চেয়ে আসছিল।
এডিবির এক জরিপ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ট্রানজিট ব্যবহারের সুবিধা দিলে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাবে। তবে বিআইডিএসের জরিপে বলা হয়েছে, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ ৪০০ কোটি টাকা পাবে। কোন জরিপটি সঠিক, সেই বিতর্কে না গিয়ে এটা স্পষ্ট করে বলা যায়, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট ব্যবহারের সুযোগ দিলে বাংলাদেশ লাভবানই হবে; ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
এসব তথ্য নিশ্চয়ই সরকারের কাছেও রয়েছে। প্রয়োজনে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটিও করতে পারত সরকার। তারা ট্রানজিটের লাভালাভ খতিয়ে দেখে সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করত। তার আলোকে সরকার সিদ্ধান্ত নিত। এখন যেটা হলো, তাতে বিরোধীদের কাছে আন্দোলনের ইস্যু তুলে দিল সরকার। এই ইস্যুতে তারা জনগণের সমর্থনও পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমার তো মনে হয়, এ পরিস্থিতিতে সরকার বেশ বিপদেই আছে। এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে হলে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভারত যদি বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো, বিশেষ করে ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় জমি হস্তান্তর, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দ্রুত সই করতে পারে, তাহলে বিপদ কেটে যেতে পারে। ভারত যেহেতু তার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার ট্রানজিট সুবিধা পেয়ে গেছে, তাই বড় দেশ হিসেবে বড় উদারতাও বাংলাদেশকে দেখাতে পারে। তাতে এ দেশের মানুষের ভারতবিরোধী মনোভাবের পরিবর্তন ঘটতে পারে। অন্যথায় ভারতের জন্যও তা সুখকর হবে না।
এ ক্ষেত্রে আবারও আমি ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরালের সেই উক্তিটি এখানে তুলে ধরতে চাই, যা গুজরাল মতবাদ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি বলেছিলেন, 'বড় দেশ হিসেবে ভারতেরই উচিত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সব বিরোধ মিটিয়ে ফেলা এবং সম্পর্কের উন্নয়ন করা।' এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরাও একমত পোষণ করি। আমরাও মনে করি, বড় দেশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোর উন্নয়নে বড় ভূমিকা ভারতকেই রাখতে হবে। ছোট দেশগুলোকে ভয়ে ও চাপে রেখে ভারত কিছুই আদায় করতে পারবে না। চাণক্য কূটনীতির কূটকৌশলে ভারত ট্রানজিট সুবিধা নিতে সক্ষম হলেও অদূর-ভবিষ্যতে তা বুমেরাং হতে পারে, মানুষের মনে ভারতবিরোধী মনোভাব আরো চাঙ্গা হতে পারে। যেমন ভারতের প্রতি এ দেশের মানুষের অবিশ্বাস বাড়িয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন করতে হলে প্রতিবেশীর মর্যাদার বিষয়টিও ভারতকে ভাবতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক mostofakamalbd@yahoo.com
No comments