সড়ক দুর্ঘটনা ও মিডিয়ার ভূমিকা by আরিফুর রহমান খাদেম

য়েক দিন আগে দেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত 'দুই পুরুষ' নামে একটি বাংলা ছায়াছবি দেখছিলাম। ছবিটির একপর্যায়ে দেখলাম, নায়িকা গাড়ি চালিয়ে মহাসড়ক দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন এবং একই সময় নায়কের সঙ্গে পুরোদমে মোবাইলে কথা বলছেন। তাঁকে যতক্ষণই গাড়ি চালাতে দেখানো হয়েছে, তাঁর গাড়ি প্রায় সময়ই দুই লেনের মধ্যে ছিল।
তা ছাড়া অপরপ্রান্ত থেকে আসা বাসও তাঁর গাড়ির পাশ ঘেঁষে অতিক্রম করে, যা মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারত। রাস্তায় এমন কোনো ট্রাফিক ছিল না যে তাঁকে বাধ্য করে এভাবে গাড়ি চালাতে হবে। আমার ধারণা ছিল, বিপজ্জনক ও বেপরোয়া এই ড্রাইভিংয়ের জন্য হয়তো একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা দেখতে পাব, যা গাড়িচালকদের সতর্ক করতে সাহায্য করবে। কিন্তু এ ধরনের কিছুই চিত্রায়িত হয়নি। বরং এটাই ছিল স্বাভাবিক গাড়ি চালনা, যেভাবে আমাদের দেশের বেশির ভাগ গাড়িচালকই গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, টিভি বা সিনেমা শুধু বিনোদনের জন্যই নয়, শিক্ষারও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও। কারণ একটি সিনেমা বা নাটক বাস্তবতার নিরিখেই তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ এ মিডিয়ার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে বা শিখতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে আমরা একটা জিনিস দেখতে, শুনতে ও উপভোগ করতে পারি, যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। একটি অনুষ্ঠান যেমন একজনকে আনন্দ দানের মাধ্যমে হাসাতে পারে, আবার মুহূর্তেই কাঁদাতেও পারে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ সিনেমা বা টিভি মিডিয়ার প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল। আর এ জন্যই বোধ হয় একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন দেশব্যাপী 'নিরাপদ সড়ক চাই' স্লোগান টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিল দেশের নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর অনেকেই। হয়তো তাঁর এই মহৎ কাজকে ভালোবেসে অনকেই রাস্তায় সতর্ক হয়েছে এবং অন্যকে সতর্ক হতে উপদেশ দিয়েছে। দেশের সড়কগুলো এতটাই অনিরাপদ যে শুধু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ছাড়া সড়কে আর কেউই নিরাপদ নয়। আগে শুধু সাধারণ মানুষই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতো। কিন্তু এখন প্রতি সপ্তাহেই আমরা দেশের কিছু মাথাও হারাচ্ছি। দুই সপ্তাহ আগেও আমার বন্ধু, একসময়ের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ও বর্তমানে চুয়েটের সহকারী অধ্যাপক ওবায়েদুল হক গাড়িচাপায় নির্মমভাবে নিহত হন। বছর দুয়েক আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, কয়েক মাস আগে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর এবং এরও আগে মিরসরাইয়ের ঘটনাগুলো দেশ-বিদেশে সবাইকে ব্যথিত করেছে। এরই জের ধরে গত কয়েক মাস প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলই দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষ নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার ওপর টক শো করে আসছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী, সচিব বা উচ্চপদস্থ কাউকে কোনো অনুষ্ঠানে এসে এ বিষয়ে আলোচনা করতে বা এর দায় স্বীকার করতে দেখিনি। তা ছাড়া কোনো মাধ্যমে মানুষের কাছে নিরাপদ সড়ক দেওয়ার কিছু প্রতিশ্রুতির বাণীও শোনা যায়নি। আমাদের দেশে জবাবদিহিতার অভাবেই এমনটা হয়। অন্যদিকে মিডিয়ায় সংবাদ আসার আগেই উন্নত দেশগুলোতে এগুলোর এক-দশমাংশ ঘটনায়ই যোগাযোগমন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। আর এটাই স্বাভাবিক। আমি কালের কণ্ঠের উপসম্পাদকীয়তে গত ২০ জানুয়ারি 'সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে করণীয় কী?' শিরোনামে একটি বিশদ আর্টিক্যাল লিখেছিলাম। লেখাটি প্রকাশের পর পরই আমি দেশের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও মিডিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য পাঠকের সুন্দর মতামত গ্রহণ করি, যা আমাকে দেশ নিয়ে আরো বাস্তবভিত্তিক লেখা লিখতে অনুপ্রেরণা জোগায়। আমার লেখার বিষয়বস্তু অনেকের মনকে দোলা দিলেও, প্রকৃতপক্ষে যাদের এ বিষয়গুলো নিয়ে বেশি করে ভাবা উচিত এবং সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে বাস্তবে প্রয়োগ করা উচিত, কাজেকর্মে এর কোনো আলামতই লক্ষ করছি না। সরকার মহাসড়ককে এক-দুটি লেন থেকে তিন বা চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন_বর্তমানে আমাদের যা আছে তা-ই যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারি, লেনের সংখ্যা বাড়িয়ে যদি দশেও উন্নীত করা হয়, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। আমি মনে করি, পর্যাপ্ত গতিসীমায় শুধু লেনের ভেতরে গাড়ি চালানোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আগে দেশের মানুষকে ট্রাফিক আইনের শিক্ষা নিতে হবে এবং এগুলো মানতে বাধ্য করতে হবে। আমাদের দেশের অনেকেই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে এতটাই উদাসীন বা অজ্ঞ যে দু-একটা বাস্তব উদাহরণ এখানে না শেয়ার করলেই নয়। কয়েক সপ্তাহ আগে দেশ টিভিতে প্রচারিত 'কে হতে চায় কোটিপতি'র পৃথক দুটি পর্বে নিমন্ত্রাতা বা হোস্ট একজন অতিথিকে জিজ্ঞেস করলেন, 'রাস্তায় সবুজ বাতি কী নির্দেশ করে বা কখন জ্বলে?' উত্তরদাতা অনেক সময় নিয়ে, অনেক চিন্তাভাবনার পর সঠিক উত্তরই দিলেন। আমার স্মরণে নেই, তিনি দর্শকদের সমর্থনে একটি লাইফলাইন ব্যবহার করেছিলেন কি না। অন্য একটি পর্বে অতিথিকে প্রশ্ন করা হয়, 'জেব্রা ক্রসিংয়ে কোন দুটি রং থাকে?' উত্তরদাতা সরাসরি উত্তরে না গিয়ে একটু বিশ্লেষণের মাধ্যমে, হোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় বললেন, 'যেহেতু জেব্রার রং সাদা ও কালো, সেহেতু জেব্রা ক্রসিংয়ে এ দুটি রংই থাকার কথা। এ দুজন অতিথির মধ্যে প্রথমজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে অনার্স পড়ুয়া ছাত্র এবং অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত। হোস্টের করা দুটি প্রশ্নই ট্রাফিক আইনের ভাষায় স্বরবর্ণ বা অ, আ, ই, ঈ বলা যায়। যদি আমাদের শিক্ষিত সমাজই ট্রাফিক আইনের মৌলিক বিষয়াদি বুঝতে হোঁচট খান বা এগুলোর ওপর সাধারণ জ্ঞান না রাখেন, তাহলে বাস-ট্রাক বা ট্যাঙ্রি চালকদের অবস্থা কী হবে? আমি ওই দুই ভদ্রলোককে হেয়প্রতিপন্ন করতে কথাগুলো বলছি না। হয়তো আমিও ওই সময়টায় দেশে থাকলে আমার জ্ঞানের পরিধি তাঁদের সমান্তরালই হতো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? সাধারণ মানুষ, অভিভাবক নাকি সঠিক নীতিনির্ধারণ, দিকনির্দেশনা ও প্রয়োগের অভাব? বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় মিডিয়া ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ট্রাফিক আইনের বাস্তবিক রূপ দিতে এবং রাস্তা ব্যবহারকারী ও গাড়িচালকদের নিরাপদ সড়ক উপহার দিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। টিভি, রেডিও এবং সিনেমা হলে নিয়মিত সড়ক ও ট্রাফিক আইনের ওপর বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র, আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন, নাটক বা নাটিকা প্রচার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার কুফল ও ভয়াবহতা বিস্তারিত তুলে ধরা যেতে পারে, যা গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে ও পরবর্তী সময়ে এগুলো মেনে চলতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। অপরদিকে মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকেও সড়ক ও ট্রাফিক আইনের ওপর বিস্তারিত বিভিন্ন অধ্যায় সংযোজন করা যেতে পারে, যার ফলে আগামী প্রজন্ম হয়ে উঠবে আমাদের চেয়েও অনেক বেশি সচেতন ও সভ্য। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সব মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষের সজাগ দৃষ্টি কামনা করছি।

লেখক : সিডনিতে ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ও খণ্ডকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
arifurk2004@yahoo.com.au

No comments

Powered by Blogger.