অধ্যাপক মামুন আমায় ক্ষমা করবেন-জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় by তারেক শামসুর রেহমান

যে ক'জন শিক্ষককে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর গর্ব করতে পারে, তার মাঝে অধ্যাপক এএ মামুন একজন। অথচ তিনি কি-না লাঞ্ছনার শিকার হলেন? আর তাকে লাঞ্ছিত করল একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এর বিচার আমি কার কাছে চাইব? যারা রাষ্ট্র চালান কিংবা ভবিষ্যতে চালাবেন, তারা কি সমকালে ছাপা হওয়া তিন কলামব্যাপী ওই ছবি দেখে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন অধ্যাপক এএ মামুন।


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমতিরি নবনির্বাচিত সভাপতি। গত ১৩ জানুয়ারি সমকালসহ প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে অধ্যাপক মামুনের কান্নার ও লাঞ্ছনার কাহিনী ছাপা হয়েছে। মামুনের এ কান্নার ছবি আমাকে কষ্ট দিয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার দুঃখ হয়, আমরা মামনুকে লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম না। যারা তাকে লাঞ্ছনা করেছে, তারা আমার সহকর্মী, শিক্ষক। তারা ওই ঘটনায় কতটুকু দায়ী আমি বলতে পারব না। কেননা শিক্ষক সমিতির ওই সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম না। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন লাঞ্ছিত হন, এর ভাগীদার আমিও। কেন একজন শিক্ষক লাঞ্ছিত হবেন? তিনি শিক্ষক সমিতির সভাপতি। সাধারণ শিক্ষকদের ভোটে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সভাপতি হিসেবে তার একটি দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাধারণ শিক্ষকদের ক্ষোভ থাকবে, ওটা স্বাভাবিক। জুবায়ের তো আমাদের সন্তানের মতো। আমার সন্তানকে যদি কেউ হত্যা করে, আমার তাতে রিঅ্যাক্ট করার কথা। সাধারণ শিক্ষকরা সেই কাজটিই করেছেন। তারা প্রতিবাদী হয়েছেন। হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেছেন। আর শিক্ষকদের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে তিনি একটি দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে তিনি লাঞ্ছনার শিকার হবেন, এটা কাম্য হতে পারে না। অধ্যাপক মামুনকে আমি অতীতে কোনোদিন শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখিনি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। শিক্ষক হিসেবে তার পরিচিতি দেশের বাইরেও রয়েছে। যে ক'জন শিক্ষককে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর গর্ব করতে পারে, তার মাঝে অধ্যাপক এএ মামুন একজন। অথচ তিনি কিনা লাঞ্ছনার শিকার হলেন? আর তাকে লাঞ্ছিত করল একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এর বিচার আমি কার কাছে চাইব? যারা রাষ্ট্র চালান কিংবা ভবিষ্যতে চালাবেন, তারা কি সমকালে ছাপা হওয়া তিন কলামব্যাপী ওই ছবি দেখে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন? আরও দুঃখজনক সংবাদ হচ্ছে, অধ্যাপক মামুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অধিকারী ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। আর যাদের দ্বারা তিনি অপমানিত হয়েছেন এবং যাদের নাম পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তারাও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। অন্য কোনো রাজনীতির অনুসারীরা তাকে হেনস্তা করেনি।
আমাদের মূল্যবোধটুকু পাল্টে যাচ্ছে। সিনিয়র শিক্ষকদের আমরা সম্মান করি না। ব্যক্তি তথা দলীয় স্বার্থ যেখানে বেশি, সেখানে নূ্যনতম সম্মানবোধ এতটুকু স্থান পায় না। অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছনা করার ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবমূর্তি জাতির কাছে কতটুকু উজ্জ্বল হয়েছে, এটা লাঞ্ছনাকারীরা কতটুকু উপলব্ধি করেছেন, আমার সন্দেহ হয়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেকে অপমানিত বোধ করছি। আমি অনেক 'ছোট' হয়ে গেছি অন্যদের কাছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে আলোচিত। একের পর এক ছাত্র হত্যা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। নারী শিক্ষক নির্যাতনকারীকে আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারিনি। একজন সিনিয়র শিক্ষক একজন জুনিয়র শিক্ষককে 'চড়-থাপ্পড়' পর্যন্ত মেরেছিলেন। 'ফেসবুকে' একজন সিনিয়র শিক্ষককে নিয়ে যখন লেখালেখি হলো, তখন প্রশাসন ছিল নির্লিপ্ত। একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে। একজন শিক্ষক ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর 'মৃত্যু' পর্যন্ত কামনা করেন! কী জঘন্য অপরাধ। এখানে উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এর চেয়ে তো আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। প্রতিটি অন্যায়ের যদি বিচার হতো, তাহলে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটছে, তা ঘটত না। স্বীকার করি, প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনাকারী শিক্ষক রুহুল আমিন খন্দকার বর্তমান উপাচার্যের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হননি; কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের আমলে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে ব্যক্তিগত আনুগত্য ও রাজনৈতিক আনুগত্যতা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। তারা তাই সিনিয়রকে সম্মান করে না। করতে শেখেনি। একজন ছাত্র এক সময় শিক্ষক হবে। শিক্ষকের ছত্রছায়ায় সে নিজেকে বিকশিত করবে। এটাই স্বাভাবিক। যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে। কিন্তু আজ 'ছাত্র' শিক্ষকের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আর উপাচার্য মহোদয় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই 'শিক্ষকের' বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এ কোন বিশ্ববিদ্যালয় আমরা দেখছি? শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের সংবাদ ছেপেছে সমকাল। এগুলো সবই কি অসত্য? দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে উপাচার্য মহোদয়ের সম্মান কি তাতে বেড়েছে? উপাচার্য নিজে একজন পণ্ডিত মানুষ। ভালো গবেষক। তাহলে তার হাত দিয়ে এসব অনিয়ম হলো কী করে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে থাকতে হবে আরও অনেকদিন। কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না। একজন অধ্যাপক মামুনের ওপর হামলা হয়েছে। কাল যে আমার বিরুদ্ধে হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? এমনিতেই আমি 'বিপদে' আছি। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আমাকে থানায় জিডি পর্যন্ত করতে হয়েছে। সেদিনও আমি কর্তৃপক্ষের সাহায্য পাইনি। আজ মামুন যখন লাঞ্ছিত হলেন, তিনিও কর্তৃপক্ষের সাহায্য ও সহযোগিতা পাবেন, তা মনে হয় না। উপাচার্যের অবস্থান হওয়া উচিত নিরপেক্ষ। অধ্যাপক মামুনের লাঞ্ছনার ছবি যখন ছাপা হয়েছে, তখন তার উচিত ছিল সিনিয়র শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা। তিনি তা করেননি। না করে তিনি তার নিরপেক্ষতা খুইয়েছেন। তিনি উপাচার্য। এর অর্থ তিনি আমাদের অভিভাবক। একজন শিক্ষক যখন লাঞ্ছিত হন, তখন তার পাশে তার দাঁড়ানো উচিত। তাকে উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার নয়। কিন্তু তিনি এখনও পারেন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে। যদি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায় ভালো। নতুবা উপস্থিত শিক্ষকদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলে আমার বিশ্বাস, শিক্ষকরা আর আন্দোলনে যাবেন না। যার বিরুদ্ধে অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে, তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার কথায় হয়তো সাধারণ শিক্ষকরা আস্থা রাখতে পারছেন না। কিন্তু একটি তদন্ত কমিটি যদি তাকে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয়, এটা তার নিজের জন্যও ভালো। এতে করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। গত শনিবার একজন অভিভাবক যখন আমাকে পেয়ে রীতিমতো অভিযোগ করলেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, তাকে আমি জবাব দিতে পারিনি। আগামীতে আমি জবাবটি দিতে চাই। এ জন্য উপাচার্য মহোদয়েরই এগিয়ে আসতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক রয়েছেন, দেশজুড়ে যাদের পরিচিতি রয়েছে। একজন শিক্ষকের জন্য আমরা কেন সবাই অপমানিত হবো? জাতির কাছে কেন 'ছোট' হবো? শিক্ষিকা নির্যাতনকারীকে আমরা শাস্তি দিয়েছি। সেদিন শিক্ষক হিসেবে আমরা অসম্মানিত হয়েছিলাম। সেদিনও আমরা বলেছিলাম ওই কুলাঙ্গার 'শিক্ষককে' দিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষক সমাজকে বিবেচনা করা যাবে না। আজ যারা অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছিত করেছে, তারা শিক্ষক বটে। কিন্তু তাদের দিয়েও সব শিক্ষককে বিবেচনা করা যাবে না। আরও একটা কথা। কোনো কোনো পত্রিকায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, উপ-উপাচার্যের একটি পদ খালি হয়েছে। ওই পদকে কেন্দ্র করে যে 'রাজনীতি' সেই রাজনীতির ফলশ্রুতিতেই জাহাঙ্গীরনগরে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে বলতে পারব না। কিন্তু যা বলতে পারব তা হচ্ছে এই মুহূর্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দু'জন উপ-উপাচার্যের কোনো প্রয়োজন নেই। একজন উপ-উপাচার্যের পেছনে মাসে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। রাষ্ট্র যেখানে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে, সেখানে বাড়তি লাখ লাখ টাকা খরচ করার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই দু'জন উপ-উপাচার্য নেই। অথচ জাহাঙ্গীরনগরে আছে। কেন? এর কোনো জবাব নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি একজন উপ-উপাচার্য দ্বারা পরিচালিত হতে পারে (এবং সে সঙ্গে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীও), তাহলে জাহাঙ্গীরনগরের জন্য দু'জন উপ-উপাচার্যের প্রয়োজন কেন হবে? দলীয় স্বার্থে বিষয়টি যেন দেখা না হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে জুবায়ের হত্যার যেমনি বিচার চাই, ঠিক তেমনি বিচার চাই অধ্যাপক মামুনের লাঞ্ছিত করার ঘটনারও। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্র পড়তে আসে, জীবন দিতে আসে না। আমরা যদি ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারি, এ ব্যর্থতা আমাদের সবার। যে অচলাবস্থা আজ জাহাঙ্গীরনগরে সৃষ্টি হয়েছে, তা কাম্য নয়। সবে প্রথম বর্ষের ছাত্ররা তাদের শিক্ষা জীবন শুরু করেছে। তারা এ ঘটনায় কী 'শিক্ষা' পেল? তারা দেখল, তাদের এক সিনিয়র বড় ভাইকে 'হত্যা' করা হয়েছে! তারা দেখল, একজন শিক্ষক অপর একজন শিক্ষকের ওপর চড়াও হয়েছে! শিক্ষকদের ওপর তাদের আস্থা কি থাকে আর? আমি লজ্জিত, দুঃখিত এবং অপমানিত বোধ করছি। অধ্যাপক মামুন, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমরা আপনাকে সম্মান দিতে পারলাম না।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.