কাশ্মীর: কারফিউর মধ্যে ঈদ, বড় মসজিদ-ঈদগাহ বন্ধ by শুভজ্যোতি ঘোষ
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা
কেড়ে নেওয়ার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় শ্রীনগরসহ গোটা কাশ্মীর উপত্যকায় আজ
(সোমবার) কোরবানির ঈদ পালিত হচ্ছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা আর কঠোর কারফিউর
মধ্যে।
শ্রীনগরের বড় কোন মসজিদে বা প্রধান রাস্তায় ঈদের জমায়েতের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
শহরের রাস্তাঘাট ছিল প্রায় জনশূন্য, মোবাইল-ল্যান্ডলাইন বা ইন্টারনেট পরিষেবাও এখনও চালু হয়নি।
এদিকে
বাকি ভারতের যেসব অভিবাসী শ্রমিক কাশ্মীরে গিয়ে কাজ করতেন, অগ্নিগর্ভ
উপত্যকা থেকে তারাও দলে দলে ফিরে আসছেন - কিন্তু ঈদের আগে তারা হাতে যে
কিছু টাকা-পয়সা পাবেন বলে ভেবেছিলেন সে সব কিছুই তাদের জোটেনি।
শ্রীনগর
থেকে সোমবার সকালে বিবিসির ইউগিতা লিমায়ে জানাচ্ছিলেন, গত দুদিন ধরে শহরে
কারফিউ যে অল্প কিছুটা শিথিল করা হয়েছিল, তা ঈদের দিন সকাল থেকেই ফের
উধাও।
কেন কারফিউ, জবাব নেই
কিন্তু কেন
আবার নতুন করে এই কড়াকড়ি, সরকারি কর্মকর্তারা তার কোন জবাব দিচ্ছেন না।
তারা দাবি করছেন কোন কারফিউ নেই, শুধু নিয়মটা হল চারজনের বেশি লোক একসঙ্গে
এক জায়গায় জড়ো হতে পারবেন না।
অথচ রাস্তায় দেখা যাচ্ছে পুলিশের
গাড়ি মাইকিং করে বেড়াচ্ছে, কেউ যেন কারফিউতে বাড়ি থেকে না-বেরোয়।
ইউগিতা লিমায়ের কথায়, সব মিলিয়ে যেন একটা পরস্পরবিরোধী বার্তা দেওয়া
হচ্ছে।
কাঁটাতার বসিয়ে বড় রাস্তায় বেরুনোর পথ বন্ধ করা হয়েছে। শ্রীনগরে বড় সব মসজিদ, ঈদগাহ বন্ধ রাখা হয়। |
কাশ্মীর উপত্যকা থেকে বিবিসির অন্য সংবাদদাতারাও জানাচ্ছেন,
জামিয়া মসজিদ বা হজরতবালের মতো প্রধান মসজিদগুলোতে কোন বড় ঈদ জামাতের
অনুমতি দেওয়া হয়নি।
মানুষকে বলা হয়েছে, নিজেদের মহল্লাতে স্থানীয় ছোট মসজিদেই যেন তারা ঈদের নামাজ আদায় করেন।
ভারতীয়
সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের প্রকাশ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, মানুষ শ্রীনগরের
একটি মসজিদের ভেতর ঈদের নামাজ পড়ছেন, তবে সেখানেও বড়জোর ৭০ বা ৮০ জনের
মতো ছিলেন।
ঈদের দিনেও গুলি
এর মধ্যে খবর
এসেছে, পুলিশের পেলেট গান বা ছররা বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে অনেকেই
হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে - যদিও সরকার সে কথা অস্বীকার করছে।
গুলিতে
জখম হয়ে হাসপাতালে কেউ ভর্তি আছেন কি না, বিবিসির এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব
এড়িয়ে গিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের এক মুখপাত্র দাবি করেন পুলিশ এখনও
পর্যন্ত একটা বুলেটও চালায়নি।
দিল্লিতে কাশ্মীরিদের সাথে ঈদের খাবার খাচ্ছেন লেখক, মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতি রয় |
এদিকে কাশ্মীরে সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট
ঈদের দিনেও অব্যাহত, আজ অন্তত মানুষ টেলিফোনে প্রিয়জনদের সঙ্গে একটু কথা
বলতে পারবেন তাদের সেই আশাও পূর্ণ হয়নি। এর মধ্যে দলে দলে অভিবাসী শ্রমিক
কাশ্মীর ছেড়ে বাসে বা ভাড়া গাড়িতে পালাতে শুরু করেছেন।
শ্রীনগরে
শহরের লালচক এলাকার কাছে জনাকয়েক কাশ্মীরি বিবিসিকে বলেন,
বাংলা-বিহার-দিল্লি থেকে বহু শ্রমিক রোজগারের আশায় এখানে আসেন। কাশ্মীরে
মজুরির জন্য তারা যে পয়সা পান ভারতের কোথাও তা পাওয়া যায় না, উল্টো
মালিক এখানে দুবেলা তাদের খেতেও দেয়। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তে এই বিহারি
বা হিন্দুদেরও এখন পালাতে হচ্ছে, অর্থাৎ সব ধর্মের লোকেরাই এর ফল ভুগছে।
উপত্যকা ছেড়ে পালাচ্ছেন অনেক বহিরাগত
ঈদের
আগে টাকা-পয়সা হাতে পেবেন ভেবে যে শ্রমিকরা আশায় আশায় ছিলেন, গত এক
সপ্তাহের পরিস্থিতি তাদের ভীষণ নিরাশ করেছে - ফলে তারা এখন জম্মুর বাসের
টিকিট খুঁজছেন।
শ্রীনগরে ঈদের দিনে সুনসান রাস্তা। বড় কোনো মসজিদেই ঈদের নামাজের অনুমতি দেওয়া হয়নি। |
এমনই একজন বিজনৌরের বিকাশ কুমার, যিনি শ্রীনগরে
রংমিস্ত্রির কাজ করতেন। তিনি বলেন, "কাজকর্ম সব বন্ধ, পয়সাই পাচ্ছি না।
এখানে থেকে আর কী করব, বলুন? মালিকও তো মুশকিলে আছে দেখতে পাচ্ছি। খুব
সমস্যায় পড়েছি, পয়সা ছাড়া চলবে কী করে?"
পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে কাশ্মীরে কাজ করতে আসা জাহাঙ্গীর আলমও বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে মহা বিপদে পড়েছেন।
"কাশ্মীরের
লোকজন কিন্তু ভীষণ ভালো। আমরা সেই ২০১২ সাল থেকে এখানে কাজ করছি, আগেও কত
হরতাল-বনধ হয়েছে, কেউ আমাদের গায়ে এতটুকু হাতও দেয়নি। ঠিকঠাক কাজ করেছি,
ভালো পয়সা পেয়েছি - কখনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু এখন এই যে দুম করে কাজটা
করল - দশ-বারো দিন সময় দিয়ে করলে তবু লোকগুলো হাতে পয়সাটা পেত। এখন তো
ভুখা মরার দশা! সবাই কান্নাকাটি করছে, কীভাবে যাবে, মেয়েছেলে নিয়ে কোথায়
যাবে বল?"
ফলে এবারের কোরবানির ঈদে কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে শুধুই
দমবন্ধ আতঙ্ক, উত্তেজনা আর হতাশারই ছবি। তা সে কাশ্মীরের ভূমিপুত্রদের জন্য
যেমন, তেমনি বহিরাগতদের জন্যও।
কাশ্মীর উপত্যকা ছাড়ছেন ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে আসা শ্রমিকরা |
No comments