গরুর দুধে যদি অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়, তাহলে এর মাংস খাওয়া কতোটা নিরাপদ? by সানজানা চৌধুরী
সম্প্রতি গরুর দুধের নমুনায় অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব ধরা পড়ায় এখন গরুর মাংসের মান নিয়েও ভোক্তাদের মনে প্রশ্ন উঠেছে। যেহেতু গরুর দুধে অ্যান্টিবায়োটিক শনাক্ত হয়েছে, তাহলে গরুর মাংস কতোটা নিরাপদ - এমন প্রশ্ন এখন বেশিরভাগ ভোক্তার।
ঢাকার
বাসিন্দা কুলসুমা বেগম সপ্তাহে অন্তত দুইবার গরুর মাংস খেয়ে থাকেন।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি যেন কোন কিছুতেই ভরসা পাচ্ছেন না।
বিবিসি
বাংলাকে মিসেস কুলসুমা আক্ষেপ করে বলেন, "যেখানে গরুর দুধের মধ্যে
অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়, তাহলে ওই গরুর মাংসেও তো অ্যান্টিবায়োটিক
থাকবে। ওই শরীরটা থেকেই তো দুধটা আসে।"
"আমরা এই দূষিত মাংস কিভাবে খাব? মাংস তো আর নিষিদ্ধ করা যাবেনা।"
অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া গরুর মাংস কি নিরাপদ?
সম্প্রতি সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাতে গরুর দুধের পাশাপাশি, এর মাংসেও অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়।
এ
ব্যাপারে পশু চিকিৎসকরা বলছেন, গরু যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এর শরীরে
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয় তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো ছাড়া আর কোন
উপায় থাকেনা।
বহু মানুষের পছন্দের খাবারের তালিকায় রয়েছে গরুর মাংসের তরকারি। |
কিন্তু পশুর অ্যান্টিবায়োটিক সহজলভ্য হওয়ায়
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম
ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মর্জিনা আক্তার।
"এখানে
যেটা সমস্যা হচ্ছে যে, গরু বাছুরকে কোন প্রেসক্রিপশন ছাড়াই না হলে
হাতুড়ে ডাক্তারের মাধ্যমে একটা ওষুধ লিখিয়ে পশুগুলোকে খাইয়ে দেয়া
হচ্ছে। আবার অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ালে কোর্স কমপ্লিট করছেনা। এক কথায়
নিয়ম নীতির কোন তোয়াক্কা করছে না কেউ।"
গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হলে, তাহলে সেটার রেসিডিউটা গরুর শরীরে ওষুধ ভেদে ৭ থেকে ১৫ দিন থেকে যায় বলে জানান মিজ আক্তার।
এই সময়কে গরুর রেস্টিং পিরিয়ড বা উইথড্রয়াল পিরিয়ড বলা হয়ে থাকে।
এখন এই রেস্টিং পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর গরুর দুধ বা মাংস খেলে কোন ঝুঁকি থাকে না।
অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে কি করছে সরকার?
অ্যান্টিবায়োটিকের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার ও বিক্রি বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে চলতি বছরের এপ্রিলে রুল জারি করে হাইকোর্ট।
সেখানে নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা যাবেনা বলে উল্লেখ করা হয়।
তারই
প্রেক্ষিতে প্রাণীসম্পদ অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা জেলা উপজেলার
প্রতিটি ওষুধের দোকানে তদারকি শুরু করেছে বলে জানান অধিদফতরের মহাপরিচালক
ড. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক।
বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে গরুর মাংস রান্না হয় তাতে ব্যাকটেরিয়া বাঁচেনা। |
সেইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন খামারে
অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়ে গরুর মাংসের মান পরীক্ষার কথা জানান
তিনি।
"আমরা আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের খামারগুলোয় নিয়মিত
তদারকিতে নিয়োজিত করেছি। যেসব অ্যান্টিবায়োটিক পশু এবং মানুষ উভয়ের
শরীরে ব্যবহৃত হয়। সেগুলোকে অ্যাভয়েড করার কথা বলছি।"
"অ্যান্টিবায়োটিকের
কোর্স শেষ করা আর ওষুধ খাওয়ানো শেষে এটি বিক্রির আগে ৭ থেকে ১৫ দিন
রেস্টে থাকার বিষয়টিও প্রচার করছি। এছাড়া ফার্মেসিগুলোয় চেষ্টা করছি
মনিটরিং করার।"
তবে জনবলের অভাব থাকায় পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান মি. ভৌমিক।
"আমার
একটা উপজেলাতে পশু ডাক্তার মাত্র একজন। এখন এই একজন ডাক্তার দিয়ে উপজেলার
সব প্রাণীকুলের চিকিৎসা দেয়া রীতিমত অসম্ভব ব্যাপার। এই স্বল্পতার কারণেই
মানুষ হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে যাচ্ছে।"
তবে নতুন জনবল সৃষ্টির জন্য একটা প্রস্তাবনা এরইমধ্যে সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়েছে বলে জানান মি. ভৌমিক।
তাদের সেই প্রস্তাবনা বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে।
সেটা পাস হলে সমস্যাগুলো অনেকাংশেই সমাধান হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া গরুর মাংস খাওয়া যাবে কিভাবে?
গরুর
মাংসে যে অ্যান্টেবায়োটিক ব্যবহার করা হয় সেটা যদি মানবদেহে প্রবেশ করে
তাহলে বড় ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদ
চৌধুরী তাসনিম।
কাঁচা গরুর মাংস কাটার সময় হাতে গ্লভস পরে নিতে হবে। |
তবে নিয়ম মেনে গরুর মাংস রান্না করলে বা সংরক্ষণ করলে সেই ঝুঁকি থাকেনা।
যেহেতু
বাইরে থেকে গরুর মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক আছে কিনা সেটা বোঝার উপায় নেই।
এমন অবস্থায় ভোক্তাদের সচেতন হওয়াটা সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন মিজ
তাসনিম।
"আমাদের দেশে যেভাবে গরুর মাংস রান্না করা হয়, ওই তাপে
অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব মাংসে আর থাকেনা। কিন্তু মাংসটাকে যখন কাটা
হচ্ছে, ধোয়া হচ্ছে তখন এটা ছড়াতে পারে।"
এজন্য কাঁচা মাংস নিয়ে কাজ করার সময় হাতে গ্লাভস পরার পরামর্শ দেন তিনি।
এছাড়া রান্নার আগে বা ফ্রিজে সংরক্ষণের আগে মাংস খুব ভালভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে, যেন রক্তের কোন চিহ্ন না থাকে।
সতর্কতা:
কেউ যদি আধা কাঁচা মাংস বা স্টেক, মাংসের কিমা অথবা মাংস সেদ্ধ খেতে পছন্দ করেন তাহলে মিট পয়জনিংয়ে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
চিকিৎসকের মতে, দুষিত মাংস খাওয়ার ফলে ভয়াবহ ফুড পয়জনিং এমনকি রক্তের সংক্রামক রোগ সেপ্টিসেমিয়া হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
তাই বলে আতঙ্কিত হয়ে গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়ার কোন কারণ নেই।
শুধুমাত্র সচেতন হলেই এ ধরণের ঝুঁকি শতভাগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আধা কাঁচা মাংস খেলে মিট পয়জনিংয়ের আশঙ্কা থাকে। |
No comments