‘দেশে ফেরার পর রোহিঙ্গাদের গৃহবন্দির মতো করে রাখা হবে’
গণহত্যা-জাতিগত
নিধনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরার
ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতায় পড়তে পারেন। বিশেষ করে মিয়ানমারে ফিরে নিজ
ঘরবাড়িতে ফেরার পরিবর্তে তাদের আশ্রয় শিবিরে রাখার পরিকল্পনার কারণে
অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আর আশ্রয় শিবিরে যাওয়ার পর সেখানে তাদের কতদিন থাকতে
হবে, সেই তথ্যও অজানা। ফলে সেখানে তাদের অনেকটা গৃহবন্দি হয়ে পড়ার আশঙ্কা
রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি নিয়ে মিয়ানমার
ফ্রন্টিয়ারে প্রকাশিত এক লেখায় এমন আশঙ্কার নানা দিক তুলে ধরেছেন সাংবাদিক
সিতু অং মিন্ট। তার লেখাটি তুলে ধরা হল- ‘চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসনে নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়।
দীর্ঘ আলোচনার পর সই হওয়া চুক্তির মূল বিষয় হল- দুই দেশই বছর দুয়েকের মধ্যে
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসন করতে চায়। জাতিসংঘের
বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে, গত বছরের আগস্টের শেষ দিকে রাখাইনে মিয়ানমারের
সেনা অভিযান শুরু হলে প্রায় পৌনে সাত লাখ রোহিঙ্গা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে
পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে হামলার পর লাখখানেক
রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছিল। গত আগস্ট থেকে যে ঢল শুরু হয়, তার আগেই দুই লাখ
রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। কিন্তু সেই দুই লাখ রোহিঙ্গা ফিরিয়ে
নেয়ার বিষয়ে নতুন প্রত্যাবাসন চুক্তিতে কোনো কথা বলা হয়নি। আজগুবি ব্যাপার
হল- কতজন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেবে, মিয়ানমার সরকার সেই সংখ্যা
উল্লেখ করেনি। মিয়ানমারের পৌরসভা প্রশাসন ও অভিবাসন কর্মকর্তারা দেশটির
গণমাধ্যমকে বলেছে- রাখাইনের পরিবারগুলোর গ্রুপ ছবিসহ মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে
তাদের সঠিক তথ্য আছে। যদি তাই হয়, তবে এ সহিংসতার পরও যারা রাখাইনে রয়ে
গেছেন, তাদের একটি সংখ্যা প্রকাশ করা জরুরি। কারণ তা হলে জানা যাবে
বাংলাদেশে কতজন পালিয়ে গেছেন। বিস্ময়কর ঘটনা হল মিয়ানমার সরকার সেই সংখ্যা
এখনও প্রকাশ করছে না। মিয়ানমারের নীতি হচ্ছে- ফেরত আসতে হবে একেবারে
স্বেচ্ছায়। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে মিয়ানমার সরকারের পাঠানো ফরমে
শরণার্থীদের বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে। যদি ফরমের সেই তথ্য সঠিক হয়, তবে
রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার সুযোগ দেয়া হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত আনতে বৌদ্ধ
সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি মংডুতে ইতিমধ্যে দুটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র প্রস্তুত
করেছে। যারা স্থলপথে আসবে, তাদের টাউং পে লেট ওয়ায়ে শহরের অভর্থ্যনা
কেন্দ্র থেকে গ্রহণ করা হবে। আর নৌকায় নাফ নদ পার হয়ে আসাদের গ্যাকোয়া
গ্রামের মধ্য দিয়ে ঢুকবে। তল্লাশি কেন্দ্রে তথ্য যাচাইয়ের পর তাদের হ্লা পো
খাউংয়ের অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে রাখা হবে।
১২৪ একর জমিতে নির্মিত ওই আশ্রয়
শিবিরে ৩০ হাজার রোহিঙ্গার সংকুলান হবে। ওই আশ্রয় শিবিরে কতজন রোহিঙ্গাকে
রাখা হবে, মিয়ানমার সরকার সেই তথ্য প্রকাশ করেনি। পালিয়ে যাওয়ার আগে
রোহিঙ্গারা যেখানে বসবাস করত, সেখানেই তারা ফিরতে পারবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা
মিয়ানমার কর্মকর্তারা দেয়নি। দেশটির কর্মকর্তারা তাদের পুনর্বাসনের জন্য
উত্তর রাখাইনের ১১টি জায়গা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ওইসব জায়গা পুরোপুরি
অনুন্নত। অথচ যারা ফিরে আসবে, তাদের বাড়িঘর নিজেদের তৈরি করে নিতে হবে।
বাড়ি নির্মাণের অর্থ জোগাড় করতে 'কাজের বিনিময়ে অর্থ' কর্মসূচি নিয়েছে
দেশটির সরকার। রোহিঙ্গারা যাতে নিজেদের অর্থে বাড়ি বানাতে পারে, সে জন্যই এ
কর্মসূচি নেয়া। যেসব রোহিঙ্গা উত্তর মংডুতে বসবাস করেছিল, তারা তাদের
গ্রামে ফিরে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের যে
গ্রামগুলো আগুনে ভস্মীভূত করে দেয়া হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গারা ফিরতে পারবে
কিনা, সে বিষয়টিও পরিষ্কার করেনি দেশটির সরকার। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের এ
প্রত্যাবাসন চুক্তি নানান প্রতিকূলতায় পড়বে বলে মনে হচ্ছে। পালিয়ে আসা
রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরবে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় বহু রোহিঙ্গা ফিরে যেতে অনিচ্ছুক। মিয়ানমারে ফিরে
আশ্রয় শিবিরে তাদের কতদিন থাকতে হবে, সেই তথ্যও অজানা। তবে রোহিঙ্গারা এটি
জানে, মিয়ানমারের অস্থায়ী ক্যাম্পে যারা ফিরে যাবে, তাদের রাখাইন রাজধানী
সিত্তে স্থানান্তর করা হবে। সেখানে তাদের গৃহবন্দির মতো করে রাখা হবে।
রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতাটি হবে জীবিকার সন্ধান। তাদের
বাড়িঘর, গবাদিপশু, ক্ষেতের ফসল থেকে শুরু করে উপার্জনের সব উপায় ধ্বংস করে
দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অধিকাংশ রোহিঙ্গা পেশাগতভাবে কৃষক। তারা তাদের
ভূমিতে চাষাবাদ করতে পারবে কিনা, মিয়ানমার সরকারকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে
হবে।
No comments