দাভোস-পরবর্তী বিষাদ by জোসেফ ই স্টিগলিৎস
বিশ্বের
চলমান গুরুতর সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করতে তথাকথিত বৈশ্বিক এলিট
শ্রেণি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ১৯৯৫ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের
বার্ষিক সম্মেলন করে আসছে। আমি সেখানে প্রতিবারই হাজির থাকি। কিন্তু এবারের
মতো অন্য কোনোবারই এত ভগ্নহৃদয় নিয়ে আমাকে সেখান থেকে ফিরতে হয়নি।
‘দুরারোগ্য’ নানা সমস্যা এমনিতেই বিশ্বকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে।
সমৃদ্ধ
অর্থনীতির দেশগুলোতে বৈষম্য ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। বহু সুবিধা নিশ্চিত করলেও
ডিজিটাল বিপ্লব নানা সমস্যাও তৈরি করেছে। বিশেষত ফেসবুক, গুগলসহ হাতে গোনা
কয়েকটি একচ্ছত্র প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ও চীনা শক্তি নিয়ন্ত্রণ
করায় ব্যক্তিগত নিভৃতি, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও গণতন্ত্র এখন চ্যালেঞ্জের
মুখে পড়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর নীতির কারণে
বৈশ্বিক অর্থনীতিও অস্তিত্বগত হুমকির মুখে পড়ে গেছে। এসব সমস্যা যতটা না
আমাদের হৃদয়যন্ত্রণার কারণ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের
প্রতিক্রিয়ায়। দাভোসে প্রতিবছরই বিশ্বের বিভিন্ন বড় দেশ থেকে আসা সম্মানিত
সিইওরা তাঁদের ভাষণ শুরু করেন নৈতিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে।
তাঁরা ভালো ভালো কথা বলেন। অনেক আশার কথা শোনান। তাঁরা ঘোষণা করেন, তাঁরা
নেহাত অংশীদারদের মুনাফা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবসা করেন না; বরং তাঁদের
কর্মীদের কর্মপরিবেশ এবং কর্মীরা যে সমাজভুক্ত, সেই সমাজের উন্নয়ন মাথায়
রেখে কাজ করেন। এতে সাধারণভাবে সারা বিশ্ব উন্নতির পথে ধাবিত হয়। দায়সারা
মুখের কথা হলেও জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষম্য নিয়ে তাঁরা কিছু বলেন। কিন্তু এ
বছরের দাভোসের ভাষণে সিইওদের মুখে সেই নীতিনৈতিকতার মুখস্থ কথাগুলোও শোনা
গেল না। এ বিষয়ে তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেন। এ বছর দাভোসে যেসব সিইও
ভাষণ দিলেন, তাঁদের একজনকেও আমি সম্মেলনস্থলে উপস্থিত থাকা মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গোঁড়ামি, নারীবিদ্বেষ কিংবা বর্ণবাদ নিয়ে
কিছু বলতে শুনিনি। হঠকারী কথাবার্তা, ধারাবাহিক মিথ্যার চর্চা এবং
বিদ্বেষসূচক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ট্রাম্প শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট
পদকেই কলঙ্কিত করেননি, বরং তিনি বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রকে হেয় করলেন-এই
সত্য কথাটা একজন সিইও একবারও উচ্চারণ করেননি। সত্য তুলে ধরার স্বার্থে
তাঁদের কেউই ট্রাম্পের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মতান্ত্রিকতা থেকে বিচ্যুতির কথা
অকপটে বললেন না। আমেরিকান অর্থনীতির সুবিধা তুলনামূলকভাবে সবার জন্য
নিশ্চিত করা এবং আমেরিকান জীবনমানের সামগ্রিক উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান
গবেষণার বরাদ্দ সবচেয়ে জরুরি। এই বরাদ্দ ট্রাম্প প্রশাসন কমিয়েছে।
আশ্চর্যজনক হলো, দাভোসে আমেরিকান রাঘববোয়াল করপোরেটদের কেউই এ নিয়ে কথা
বলেননি।
ট্রাম্প প্রশাসন যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রত্যাখ্যান
করছে; মার্কিন গণতন্ত্রের ভারসাম্যের নিয়ামক গণমাধ্যমকে গালিগালাজ করছে;
এমনকি বিচার বিভাগকে আক্রমণ করছে-এসব নিয়ে একজনও মুখ খোলেননি। ট্রাম্প এবং
কংগ্রেসে রিপাবলিকান নেতারা যে আয়কর আইন পাসের প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন, সেই
আইন ট্রাম্পের মতো ধনীদের শত শত কোটি ডলারের মালিক হওয়ার সুযোগ করে দেবে।
এই আইন পুরোদমে কার্যকর হলে বিত্তশালীরা বিরাট অঙ্কের কর ছাড় পাবেন এবং ৩০
বছর ধরে যাঁদের ভাগ্য ধারাবাহিকভাবে পড়তির দিকে, সেই মধ্যবিত্তদের ওপর করের
বোঝা আরও চাপবে। এসব নিয়ে একজন সিইও মুখ ফসকেও একটা কথা বলেননি। দাভোসে যে
সিইওরা আসেন, তাঁরা মনে করেন প্রতিটি সমস্যার সমাধান করতে ধনিক শ্রেণি ও
তাদের করপোরেশনের কর কমানো এবং তাদের ওপর রাখা বিধিনিষেধ শিথিল করা উচিত।
তাঁরা মনে করেন, চুইয়ে পড়া অর্থনীতি একসময় সব মানুষের কাছে পৌঁছায় এবং এর
মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপকৃত হয়। ফলে এই চুইয়ে পড়া
অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে তাঁরা সোচ্চার থাকেন। ইতিহাস শিক্ষা দেয়, চুইয়ে পড়া
অর্থনীতি কখনোই কার্যকর নয়। দাভোসের সিইওরা তাঁদের প্রবৃদ্ধি নিয়ে যথারীতি
মাতোয়ারা ছিলেন। তাঁদের ঊর্ধ্বমুখী মুনাফা আর ক্ষতিপূরণের হিসাব নিয়ে মগ্ন
ছিলেন। অর্থনীতিজ্ঞরা তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এটি টেকসই নয়। কিন্তু
ভোগবাদী বস্তুবাদই যে দুনিয়ার রাজা, সেখানে এসব তর্কের দাম কতটুকুই-বা!
সুতরাং, ভাষণের প্রথম অনুচ্ছেদে সিইওরা যে নীতিনৈতিকতার স্তাবকতা করেন, তা
ভুলে যাওয়াই ভালো। ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ওয়াল স্ট্রিট-এর চরিত্র
মাইকেল ডগলাসের মতো স্পষ্টবাদিতার অভাব তাঁদের মধ্যে আছে বটে; কিন্তু
ছবিটির মূল বক্তব্য আর তাঁদের মূল সুর পাল্টায়নি। সেটি হলো: ‘গ্রিড ইজ গুড’
(লোভ ভালো)। তবে আমাকে যেটি পীড়া দিচ্ছে সেটি হলো, এই বার্তা নিঃসন্দেহে
মিথ্যা; কিন্তু ক্ষমতায় থাকা বহু লোক এটিকেই নিদারুণ সত্য বলে মানে।
অনুবাদ সারফুদ্দিন আহমেদ
অনুবাদ সারফুদ্দিন আহমেদ
No comments