আমাদের (অব.)-রা কি ভাববেন? by গওহার নঈম ওয়ারা
রেডিওতে
হঠাৎ শুনি বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জির কণ্ঠস্বর।
পরিষ্কার বাংলা গলা। নাশতা করছিলাম, উঠে গিয়ে আওয়াজটা বাড়িয়ে দিই। কিন্তু
দেব মুখার্জির কণ্ঠস্বর যেন ক্রমে নিচু হয়ে যায়। তাঁর গলাটা ধরে আসে, কথা
শেষ করতে পারেন না। বলছিলেন, ‘দেব মুখার্জি বলেছেন, ভাবুন ঈদের বাজার করে
ফিরছে একটা বাচ্চা ছেলে। তাকে যেভাবে ছুরি মেরে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে
দেওয়া হয়, তারপরও কি কারও চুপ থাকা সাজে?’ শুনতে শুনতে আমার মনে হলো, উনি
বোধ হয় কাঁদছেন। রেডিওর ভাষ্যকার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তিনি আর ৬৬
জন সাবেক জ্যেষ্ঠ আমলার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লেখা খোলা
চিঠিতে সই করলেন। কী এমন পরিস্থিতি হয়েছে ভারতে যে নানা ধর্মের, নানা
জাতিসত্তার এতজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা একমত হয়ে একটা চিঠির মুসাবিদা করে
একসঙ্গে স্বাক্ষর করলেন? সংবাদমাধ্যমে পাঠালেন?
চিঠিটা তাঁরা লিখেছেন
নরেন্দ্র মোদি সরকারের উদ্দেশে। প্রথম মুসাবিদা বা ড্রাফট তৈরি করেছেন
পশ্চিম বাংলার সাবেক মুখ্য সচিব অর্ধেন্দু সেন—এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক। প্রায় ৩৪ বছর দক্ষতারÿসঙ্গে কাজ করেছেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও
কেন্দ্রে। পশ্চিম বাংলার মুখ্য সচিবের দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি দিল্লিতে
ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিবের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি পশ্চিম বাংলায়
আসেন। মূলত তাঁর পরিশ্রমেই সাবেক আমলা, কূটনীতির আর পুলিশ কর্মকর্তারা
একজোট হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। ভারতে এ রকম নজির বড়ই
বিরল।সাবেক আমলাদের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে উজির-নাজির হওয়ার খায়েশ এ দেশে
যেমন আছে, সে দেশেও তেমনই। তবে এই ৬৭ জনের কেউই এখন পর্যন্ত তাঁদের
রাজনৈতিক উচ্চাশা ব্যক্ত করেননি। নিপাট অবসরেই আছেন সবাই। লেখালেখি,
পড়াশোনা আর নাতিপুতিদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন দিব্যি—কেউ ধর্মকর্মে মন
দিয়েছেন। তবে দেশকে যে একেবারেই ভুলে যাননি, সেটাই যেন প্রমাণিত হলো
তাঁদের উদাত্ত চিঠিতে। কিন্তু কেন লিখলেন তাঁরা এই চিঠি? ‘কাউকে না কাউকে
নীরবতা ভাঙতেই হবে। সরকারের নিশ্চল নীরবতা আমাদের বাধ্য করেছে,’
সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেন অর্ধেন্দু সেন।
‘ইদানীং যেসব কাণ্ডকারখানা চলছে, তাতে চুপ করে থাকা মানে বিবেককে ঘুম
পাড়িয়ে রাখা। সরকার যদিও কোনো সাড়া দেয়নি, কিন্তু মানুষ আমাদের অভিনন্দন
জানাচ্ছে, সমর্থন করছে। বিবেকের তাড়নায় আমরা চিঠি লিখেছি,’ ভারতীয়
গণমাধ্যমে বলেন তিনি। মহারাষ্ট্রের সাবেক পুলিশপ্রধান মিরন কেরওয়ানকার
বলেন, ‘খ্রিষ্টান, মুসলিমসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যেভাবে একের পর এক আক্রমণ
করা হচ্ছে, তাতে বিরক্ত হয়ে আমি প্রতিবাদ করেছি, চিঠিতে সই করেছি।’ ভারতে
মুসলিম নিধন, খ্রিষ্টানদের পুড়িয়ে মারা বা গির্জা জ্বালিয়ে দেওয়া তো নতুন
কিছু নয়। তাহলে হঠাৎ এই খোলা চিঠি কেন? অর্ধেন্দু সেন সে কথার জবাব
দিয়েছেন, ‘এ রকম ঘটনা আগেও হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বা
প্রধানমন্ত্রীকে এ রকম পরিস্থিতিতে কখনো চুপ থাকতে দেখিনি আমরা।’ তাঁরা হয়
ছুটে গিয়েছেন বা তাঁদের অবস্থান খোলসা করে বিবৃতি দিয়েছেন। এখন তো সবাই
নীরব। এই নীরবতাকে দুষ্কৃতকারীরা সমর্থন বলে মনে করতে পারে। হয়তো মনে
করছেও। তাঁদের সবার কথায় একটা জিনিস পরিষ্কার, যত বাঘা আমলাই তাঁরা হোন না
কেন, বিবেক তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। দেশের প্রয়োজনে ক্ষুদ্র
ভেদবুদ্ধির ওপরে তাঁরা উঠতে পেরেছেন, আর এটাই তাঁদের বক্তব্যকে উজ্জ্বল
করে তোলে। মন্ত্রী হওয়ার চিন্তা বা পদক পাওয়ার লোভ কিংবা আরেকটা
চুক্তিভিত্তিক টুকরা কেকের আশা তাঁদের জাপটে ধরেনি। তাঁদের বিবেক দেশের
দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠছে। দেব মুখার্জির কণ্ঠে সে কান্নার ধ্বনি শোনা যায়।
সব মানুষ আমলা হলে, পুলিশ হলে, কূটনীতিবিদ হলে যে মনের মানুষটা শুকাতে
শুকাতে একেবারে শেষ হয়ে যায় না, তার এক তাজা উদাহরণ অর্ধেন্দু সেনদের কলম
আর কলমের আওয়াজ। সারা ভারতের আনাচকানাচে বিশ্রামে থাকা আমলাদের এই আওয়াজ
থেকে আমরা কি কিছু আমল করতে পারি? সিভিল আমলাদের এই ‘মন কি বাত’ বা মনের
কথা খুলে বলার চেষ্টা গত বছর থেকে শুরু।
তাঁদের এই প্রচেষ্টা দেখে
প্রতিরক্ষাবাহিনীর সাবেকরাও এগিয়ে আসেন। গত বছরের জুন-জুলাই মাসে ভারতজুড়ে
তখন চলছিল ‘আমার নামে নয়’ বা ‘নট ইন মাই নেম’ আন্দোলন। ভারতের
মধ্যবিত্তদের সেই আন্দোলন ছিল নাম দেখে দেখে ভারতবিরোধী আর অনুপ্রবেশকারী
চিহ্নিত করার যে গুন্ডাগিরি শুরু হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে এক জোরদার
প্রতিবাদ। সারা ভারতে সাড়া তুলেছিল সেই আন্দোলন, নামটা সব নয়,
ধর্মপরিচয়ের নামের কারণে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক
কর্মকর্তারা সেই আন্দোলনের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে আওয়াজ তোলেন, মুসলিম আর
দলিতদের যেভাবে টার্গেট করা হচ্ছে, তা আমরা সইতে পারছি না। আমাদের
পক্ষেÿএসব সংবিধানবিরোধী আচরণ নীরবে দেখে যাওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। আমরা
কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারগুলোকেও সংবিধানের মর্ম আর শব্দগুলোর
প্রতি তাদের আনুগত্য রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের এই মতামত প্রকাশ কোনো
বিদ্রোহ নয়, বরং গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের অবিচল আস্থার প্রতিফলন। এই
চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ১১৪ জন অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা।
বিচার বিভাগ তো বেসামরিক আর সামরিক আমলাদের ছড়িয়ে গেল। মনের কথা চেপে
রাখলেন না অবসরে না-যাওয়া সিনিয়র বিচারকেরা। কোনো পথ না পেয়ে বিবৃতি নয়,
প্রেস কনফারেন্স করে গত ১২ জানুয়ারি যা বলার, তা বলে দিয়েছেন সুপ্রিম
কোর্টের চারজন বিচারক। প্রধান বিচারকের পক্ষপাতমূলক আর ন্যায়নীতিপরিপন্থী
কাজের সাক্ষীগোপাল হতে তাঁরা রাজি নন। কাজ হয়েছে তাঁদের এই পদক্ষেপে। মান
রক্ষা আর ইমেজ মেরামতে মন দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আমাদের অবসরে থাকা
আমলারা যদি একটু কম্বল ছেড়ে বিবেকের তাড়নায় চিঠি না হোক একটা চিরকুটের
মুসাবিদা করতেন! নাকি কোনো সংকট, কোনো অন্যায়, কোনো হত্যা-নির্যাতন চলছে না
আমাদের দেশে। অতএব প্রতিবাদেরও কিছু নেই। যা চলছে তা ভালোই চলছে, যা
চলেছিল তাও ভালোই চলেছে, আর যা হবে তাও ভালোই হবে—এমন বিশ্বাসের আরামে চলবে
আমাদের ভালো থাকা?
No comments