ইসরায়েলের হাজারো গুপ্তহত্যার গুমর ফাঁস by মারুফ মল্লিক
প্রতিপক্ষকে
চিহ্নিত করো। এরপর তাকে নিশ্চিহ্ন করে দাও। প্রয়োজনে গুপ্তহত্যা করেও।
প্রাচীন কূটনীতির জনক কৌটিল্যের এই পরামর্শ ছিল ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্যের
প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রতি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন কৌটিল্যের
ছাত্র। কৌটিল্যের কাছে রাষ্ট্র পরিচালনার তাত্ত্বিক দীক্ষা নিয়েছিলেন
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
তিনি গুরুর পরামর্শ মেনে সম্ভাব্য শত্রুদের হত্যা
করেছিলেন বলে ইতিহাসে জানা যায়। ইতিহাস এমনও জানা যায়, মহাবীর
আলেক্সান্ডারের দুই জেনারেল নিকানর ও ফিলিপকে হত্যা করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্যের চর। আলেক্সান্ডার তখন বিপাশা নদীর অন্য পারে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের
সামরিক শক্তি মাপায় ব্যস্ত ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করায়
গুপ্তহত্যা অতি প্রাচীন চর্চা। এবং এই নীতি সময় থেকে সময়ে রাষ্ট্র থেকে
রাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে নিকট অতীতে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি
গুপ্তহত্যা ঘটিয়েছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ
এবং গত শতকে ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি। ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার
শিকার হয়েছেন ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের ফাতাহ ও হামাসের নেতা-কর্মীরা।
শুধু তা-ই নয়, বন্ধুরাষ্ট্রের যেসব নীতিনির্ধারককে ইসরায়েল নিজের স্বার্থের
পরিপন্থী বলে মনে করেছে, তাঁরাও ইসরায়েলের নির্মম টার্গেট কিলিং নীতির
শিকার হয়েছেন। মিসর, ইরাকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রকে সামরিক সহায়তা করা ঠেকাতে
জার্মানি, উরুগুয়ে, কানাডার নাগরিকদেরও ইসরায়েলি গোয়েন্দারা হত্যা করেছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের ইয়েদিওত আহারনত পত্রিকার ইন্টেলিজেন্স করেসপনডেন্ট রনেন
বার্গম্যান তাঁর ‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট: দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব
ইসরায়েলস টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশনস’ বইয়ে ইসরায়েলের গত ৭০ বছরে অবৈধ
দখলদারত্ব টিকিয়ে রাখার পথে যেসব গুপ্ত ও টার্গেট কিলিং সম্পন্ন করেছে, তার
বিবরণ দিয়েছেন। এই বইয়ে বার্গম্যান জানান, প্রতিষ্ঠার পর ২ হাজার ৭০০ জনকে
ইসরায়েল রাষ্ট্র হত্যা করেছে। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন ফিলিস্তিনের
ইন্তিফাদা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা। এর মধ্যে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতও
রয়েছেন। তাঁকে বিষাক্ত তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয় বলে
বার্গম্যান উল্লেখ করেছেন। এই বই লেখার জন্য বার্গম্যান ইসরায়েলি গোয়েন্দা
সংস্থা মোসাদ, শিন বেত ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এক হাজারের বেশি
কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বই প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি ইসরায়েলি
কর্তৃপক্ষের বাধার মুখেও পড়েছেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, এই ধরনের গবেষণা
ইসরায়েলের নিরাপত্তার ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তবে বার্গম্যান থেমে যাননি।
তিনি বইটি প্রকাশ করেছেন এবং ইসরায়েলের টার্গেট কিলিংয়ের আদ্যোপান্ত তুলে
ধরেছেন। যত দূর জানা যায়, ১৯৫৬ সালের মিসরের লে. কর্নেল মোস্তফা হাফেজকে
পার্সেল বোমা পাঠিয়ে হত্যা করে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। মোস্তফা হাফেজ
ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বাছাই করতেন।
গুপ্তহত্যার বড় ধরনের অভিযান ইসরায়েলিরা পরিচালনা করে ১৯৭২ সালে মিউনিখ
অলিম্পিকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে। মিউনিখ অলিম্পিক ভিলেজে হামলা করে
ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের অ্যাথলেটদের জিম্মি করে। ইসরায়েলি কমান্ডোরা
তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করলেও কাউকেই আটক করতে পারেনি। পরে দীর্ঘ সময়
নিয়ে ওই হামলায় অংশ নেওয়া সবাইকে বৈরুত, প্যারিস, অসলো ও যুক্তরাষ্ট্রে
হত্যা করে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। এর মধ্যে বৈরুতে হামলা করে ১৯৭৩ সালের ৯
এপ্রিল। ওই সময় পিএলওর শীর্ষস্থানীয় কয়েক নেতাকে হত্যা করে তারা। ১৯৮৮ সালে
তিউনিসে হত্যা করা হয় ফাতাহ আন্দোলনের নেতা আবু জিহাদকে। লিবিয়া থেকে
সিরিয়ায় যাওয়ার পথে ১৯৯৫ সালের মাল্টার ডিপ্লোম্যাট হোটেলের সামনে ফাতিহ
সাকিকিকে গুলি করে হত্যা করে মোসাদের সদস্যরা। ছদ্মনাম ড. ইব্রাহিম ধারণ
করে বিভিন্ন দেশে আনাগোনা করতেন সাকিকি। কিন্তু মোসাদের গোয়েন্দাদের ফাঁকি
দিতে পারেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রাবিন নিহত হওয়ার পর হামাসের
বোমা স্কোয়াডের সদস্য ইয়াহইয়া আয়েশের খোঁজে ছিল ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা
শিন বেত। ১৯৯৬ সালে তাঁকে গাজায় হত্যা করা হয়। আয়েশকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য
বন্ধুর চাচা কামিল হামাদকে এক মিলিয়ন ডলার, ভুয়া ইসরায়েলি পাসপোর্ট ও
মার্কিন ভিসা জোগাড় করে দেওয়া হয়। আয়েশকে হত্যার কিছুদিন পরেই চারটি
আত্মঘাতী হামলা করে ৬০ জন ইসরায়েলিকে হত্যা করে হামাস। হামাস নেতা খালেদ
মেশালকেও কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করেছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। একবার জর্ডানে
তাঁর ওপর বিষও প্রয়োগ করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত মেশাল বেঁচে যান।
ইসরায়েলি বন্দিবিনিময়ের জটিল এক খেলায় ইসরায়েলিদের কাছ থেকে সেই বিষনিরোধক
ওষুধ আনিয়ে মেশালের জীবন বাঁচানো হয়। খোদ মোসাদের প্রধান ড্যানি ইয়াটম ওই
ওষুধ বহন করে নিয়ে যান আম্মানে। তবে ২০০৪ সালে হত্যা করা হয় খালেদ মেশালসহ
অনেক হামাস নেতার তাত্ত্বিক গুরু শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে। ওপরে উল্লেখিত
ব্যক্তিদের ছাড়াও ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের বড় বড় রাজনৈতিক ও সামরিক
নেতার কমবেশি সবাই ইসরায়েলের গুপ্তহত্যা ও টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন। এ
ছাড়া সাতজন ইরানি বিজ্ঞানীকে হত্যা করে মোসাদের গোয়েন্দারা। কারণ,
ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, ইরানের সামরিক শক্তি ভবিষ্যতে ইসরায়েল
রাষ্ট্রের টিকে থাকা ও সম্প্রসারণে মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। বার্গম্যান
প্রশ্ন তুলেছেন টার্গেট কিলিংয়ের নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নিয়ে। মজার বিষয়
হচ্ছে, যে দেশে দাঁড়িয়ে বার্গম্যান নৈতিকতা ও আইনের প্রশ্ন তুলেছেন, সেই
রাষ্ট্রেরই নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি নেই।
কারণ, দখলদারদের কোনো আইনগত ও নৈতিক
ভিত্তি থাকে না। অবশ্য কেউ যদি রাজনৈতিক বাস্তববাদের কঠিন অনুসারী হয়ে
থাকেন, তবে ভিন্ন কথা। কারণ, বাস্তববাদে রাষ্ট্রকে টিকে থাকার জন্য যা খুশি
তা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এবং রাষ্ট্র টিকে থাকার জন্য যা করবে, তা-ই
যৌক্তিক। ইসরায়েল কেন বেছে বেছে প্রতিপক্ষের লোকজনকে হত্যা করছে? কেনইবা
হত্যার নীতি অবলম্বন করে টিকে থাকতে চাইছে? বার্গম্যানের বই থেকে আমরা
জানতে পারি, ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রাচীন ‘তালমুদ’ উপদেশে অনুপ্রাণিত হয়েই
বেছে বেছে প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয়েছে। এবং হত্যাকারীদের মধ্যে অনুশোচনাও
নেই। তালমুদ অনুসারে কেউ যদি তোমাকে হত্যা করতে আসে, তবে নিজেকে তৈরি করে
প্রতিপক্ষকে হত্যা করো। কিন্তু এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েল রাষ্ট্র
নিজেই অবৈধ দখলদার এবং তারা অসংখ্য নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। তাই
তাদের এই আত্মরক্ষার্থে তালমুদের বাণীর ব্যবহার এক বড় ধরনের ভাঁওতাবাজি।
ইসরায়েলিদের কেউ হত্যা করতে আসেনি। বরং জায়নবাদীরা রক্তের সাগরে ভেলা
ভাসিয়ে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি দখলের স্বপ্নে বিভোর, ফিলিস্তিনিরা তার
প্রতিরোধ করতে চাইছে মাত্র। রক্ত কিন্তু উভয় পক্ষেই ঝরছে। এবং রক্ত ঝরার
ক্ষেত্র বিস্তৃত হতে পারে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্র আফগানিস্তান,
ইরাক, সিরিয়া থেকে কত দূর বিস্তৃত হয়েছে, ইউরোপ ও আমেরিকা সেটা ভালোই টের
পাচ্ছে। বার্গম্যানের বই সেই রক্তঝরার ইতিহাসকেই সামনে তুলে এনেছে।
ইসরায়েলের এই গুপ্তহত্যা ও টার্গেট কিলিংয়ের কথা বিভিন্নভাবেই বলা হচ্ছিল।
ইসরায়েল ও তার সমর্থকেরা কখনোই এটিকে স্বীকার করেনি; বরং ইসরায়েল ও তার
সারথিরা ফিলিস্তিনের হামাস, ফাতাহ, পিএলওকে সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়ার
চেষ্টা ছাড়েনি। ইসরায়েলের গুপ্তহত্যা ও টার্গেট কিলিংকে সন্ত্রাসবাদের
বিরুদ্ধে লড়াই বলে জায়েজ করার চেষ্টা করেন অনেকে। তবে কোনটি সন্ত্রাসবাদ আর
কোনটি মুক্তি আন্দোলন, তা নির্ধারণ করতে হবে। এটি তেমন কঠিন কিছু নয়। এর
জন্য দরকার বিবেক ও বুদ্ধির সঠিক প্রয়োগ। বার্গম্যানের বই যে রাতারাতি
ইসরায়েল ও তার সারথিদের অবস্থানের পরিবর্তন করবে, তা নয়। তবে ফিলিস্তিন
নিয়ে অন্যদের ভাবনার পরিবর্তনে সহায়তা করবে।
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি
No comments