মাঘেই পানিশূন্য তিস্তা হুমকির মুখে সেচ প্রকল্প
‘আমাদের
ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’ এই লাইন দু’টি
আমাদের দেশের ছোট ছোট নদীর েেত্র হলেও এখন খরস্রোতা তিস্তা নদীর েেত্রও
প্রযোজ্য। তবে বৈশাখ মাস নয়, তিস্তা এবার মাঘ মাসেই শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত
হয়েছে। তাই হুমকির মুখে পড়েছে। বোরো চাষাবাদ এবং বিপাকে পড়েছে তিস্তা
সেচপ্রকল্প কর্তৃপ। প্রতি বছর বর্ষা মওসুমে তিস্তা নদী ফুলে ফেঁপে দু’কূল
ভাসিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। তিস্তার করাল গ্রাসে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও
স্থাপনা বিলীন হয়ে যায়। আবার শুষ্ক মওসুমে তিস্তা শুকিয়ে ধু ধু বালু চরে
পরিণত হয়। আর তিস্তার এ অবস্থা প্রতি বছরেই হয়। গতকাল সকালে সরেজমিন সদর
উপজেলার রাজপুর ও আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়,
থেমে গেছে মাঝি-মাল্লাদের দৌড়-ঝাঁপ। শুকনো বালুচরে পড়ে আছে মাছ ধরা
নৌকাগুলো। তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে বালুচর। মাছ ধরতে না পেয়ে মানবেতর
জীবনযাপন করছে নদী পাড়ের জেলে পরিবারগুলো। জেগে উঠা চরে সেচের অভাবে ব্যাহত
হচ্ছে চাষাবাদ। কেউ কেউ দূর থেকে পানি এনে বাঁচিয়ে রেখেছেন ফসল। হুমকির
মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। পানি না থাকায় হেঁটেই তিস্তা পাড়ি দিচ্ছে নদী
পাড়ের মানুষজন। জানা যায়, ভারতের সিকিম রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে
প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার সীমান্ত হয়ে দেশের অন্যান্য জেলায়
প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক এ তিস্তা নদী। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও
গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে
ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে তিস্তা। প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য
নদীটির বাংলাদেশ অংশে রয়েছে মাত্র ১২৫ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন থেকে ভারতের
গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে সেই দেশের সরকার কয়েক যুগ ধরে একতরফা পানি
নিয়ন্ত্রণ করায় এক সময়ের খরস্রোতা তিস্তা নদীর এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তাইতো মাঘের শীতেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ফলে
লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১২৫ কিলোমিটার
তিস্তার অববাহিকায় রুক্ষ পরিবেশ বিরাজ করছে। দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে
জীববৈচিত্র্য। অপরদিকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা অবস্থিত দেশের
বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচপ্রকল্প প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সদর উপজেলার
তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও জেলার কালীগঞ্জ
উপজেলার কাকিনা এলাকায় নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু দাঁড়িয়ে রয়েছে
ধু ধু বালুচরের ওপর। ব্রিজ থাকলেও অনেকে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন তিস্তা নদী।
এক সময় তিস্তা নদীতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি ও মাছ বিক্রি করে জীবনযাপন করতেন এ
অঞ্চলের জেলেরা। তারাও আজ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেই
বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা শুরু করেছে। আর মাঝি-মাল্লারা কর্মহীন
হয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন। খেয়াঘাটের মাঝি আব্দুর রহিম (৪৫) বলেন, ‘পানি
নাই নৌকা চলবো ক্যামনে, তাই হগোলেই হাঁইটা নদী পাড় হইতাছে, আমাগো একটা নৌকা
বালু চরে তুইলা রাখছি’। তিস্তা পাড়ের জেলে শাহিন মিয়া জানান, ‘তিস্তায়
পানি নাই, তাই মাছও নাই। বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করে কৃষিশ্রমিক
হিসেবে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন তারা। আবার অনেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে
গিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন’। তিস্তা সেচপ্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া
পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান বলেন, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ
ধরে রাখতে প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি। গত বছর ফেব্র“য়ারি মাসে তিস্তার
পানিপ্রবাহ ছিল ১৫০০ কিউসেক। আর এ বছর ফেব্র“য়ারি মাসে তিস্তার পানিপ্রবাহ
৯০০ কিউসেকের নিচে চলে যাচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই
সেচপ্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
No comments