আরও একটি পদত্যাগ by কামাল আহমেদ
আড়াই
মাসেরও বেশি সময়ে দেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদের শূন্যতা পূরণ
করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ২ ফেব্রুয়ারি তিনি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেছেন। ১২ নভেম্বর সাবেক প্রধান বিচারপতি
সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সরকারের অদৃশ্য চাপের মুখে পদত্যাগ করলে আপিল
বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে এক মাসের জন্য
ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কথা ঘোষণা করে রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপন
জারি করেন। প্রজ্ঞাপনের সময় পার হওয়ার পরও প্রায় তিন মাস বিচারপতি ওয়াহ্হাব
মিঞা ওই দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন। একটানা প্রায় ১১ সপ্তাহ ও তার আগে এস
কে সিনহা ছুটিতে থাকার মাসাধিককাল তিনি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন
করলেও প্রধান বিচারপতি পদে তাঁকে নিয়োগ করা হয়নি। অতঃপর বিচারপতি সৈয়দ
মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই
ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা পদত্যাগ করেছেন। এস কে
সিনহার অস্বাভাবিক বিদায়কে ঘিরে বিতর্কের পটভূমিতে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে আনার লক্ষ্যে প্রণীত ষোড়শ সংশোধনী
অসাংবিধানিক ও বাতিলের রায়। শাসক দল ওই রায়ের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতির
বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে। আর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের
পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। তিনি
নিজে সুস্থ দাবি করলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিনি অসুস্থতার কারণে
ছুটির আবেদন করেছেন। আইনমন্ত্রী সেটি সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেন। এরপর
তাঁকে আর এজলাসে বসতে দেওয়া হয়নি। নভেম্বরের প্রথমার্ধে তিনি বিদেশ থেকে
পদত্যাগপত্র পাঠান। কিন্তু সেটি প্রকাশ করা হয়নি। পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি
গ্রহণ করেছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হলেও নতুন প্রধান বিচারপতি
নিয়োগের জন্য বিচারপতি সিনহার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়।
বিচারপতি সিনহার স্বাভাবিক মেয়াদ ছিল ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। তাঁর
পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে হলে পদত্যাগের কারণ প্রকাশ করার প্রশ্ন ওঠে। আমরা
জানি না, কী কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছেন। দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে আইনত
তার তদন্ত ও বিচার হওয়ার কথা। কিন্তু সে রকম কিছু হয়নি। সরকার-সমর্থকদের
দাবিই যদি তাঁর পদত্যাগের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে কোনো বিচারপতির চাকরিই
নিরাপদ নয়। সুতরাং, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতির
পদত্যাগের ঘটনাটির আসল সত্যটি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর পদত্যাগপত্রটি প্রকাশ
করা উচিত। আদতেই তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে, নাকি এই সময়টিকে ছুটি
হিসেবে দেখানো হচ্ছে, এমন প্রশ্ন অযৌক্তিক নয়। সংবিধানে বলা আছে, প্রধান
বিচারপতি নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু গত প্রায় তিন মাসেও প্রধান
বিচারপতি নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতি সময় পাননি, এমনটি মনে করার কোনো যৌক্তিক
কারণ নেই। কারণ আমরা জানি, এই সময়কালের মধ্যে তিনি সুপ্রিম কোর্ট দিবস
উদ্যাপনের অনুষ্ঠান এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের একটি সম্মেলনে অংশ
নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অন্তত দুটি সম্ভাবনার কথা উঠতে পারে। প্রথমত, সাবেক
প্রধান বিচারপতি সিনহা তাঁর পদত্যাগপত্রে পদত্যাগের যে কারণ লিখেছেন, তা
প্রকাশ করা সরকারের জন্য এতটাই বিব্রতকর যে তা এড়ানোর জন্য প্রায় তিন মাস
একটি সাংবিধানিক পদ শূন্য রাখতেও তাঁরা দ্বিধান্বিত হননি। দ্বিতীয়ত,
বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতি করা সরকারের জন্য ঝুঁকির
বিষয় হতে পারে, এমন আশঙ্কায় তাঁকে ওই পদের জন্য নাকচ করার সিদ্ধান্ত
শুরুতেই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের এ বিষয়টিও জানা ছিল যে তাঁকে বাদ
দিয়ে জ্যেষ্ঠতায় তাঁর পরে থাকা অন্য কাউকে নিয়োগ করা হলে তিনিও পদত্যাগ
করবেন। বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের পরপরই আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির
পদত্যাগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলত। সুতরাং, পরিস্থিতি কিছুটা
স্বাভাবিক করা ও নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই এই সময়ক্ষেপণের প্রয়োজন ছিল।
রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদন সাংবিধানিক
পদধারীদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের বিষয় হওয়ার পরও তা প্রকাশ করায় সরকারের
শীর্ষ পর্যায়ের অনেককে উৎসাহী হতে দেখা গেলেও নতুন নিয়োগের বিষয়টিকে খুব
সহজেই রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার বলে এড়ানো হয়েছে। বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞার
পদত্যাগের খবরে অনেকে কিছুটা নির্দয় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। তাঁদের
ভাষ্য হচ্ছে, বিচারপতি সিনহার বিদায়পর্বে তিনি সরকারের কথিত চাপের কাছে
নতিস্বীকার করেছেন। বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার
পর তা নিয়ে তাঁদের দেওয়া রায় অনুসরণ করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে
বিষয়টি তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পথে তাঁরা কেন গেলেন
না, সেই প্রশ্ন আবার ফিরে এসেছে। বিচারপতি সিনহাকে বয়কটের সিদ্ধান্তকে
স্বাভাবিক হিসেবে মানতে না পারায় এঁরা সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের মন্তব্যে
বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞার পরিণতিকে প্রাকৃতিক বিচার বলে অভিহিত করেছেন। তবে
বিষয়টিকে অন্যভাবেও দেখা যায়। কেননা, এ ধরনের পদত্যাগ কিন্তু সরকারের
খেয়ালখুশিমূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। আমাদের এ
কথাটিও স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে অনেক অজানা ঘটনারই সাক্ষী তিনি, যা
ভবিষ্যতে কাজে এলেও আসতে পারে। বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগের মধ্য
দিয়ে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়দানকারী আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির
তিনজনেরই বিদায় ঘটল। রায়টি সর্বসম্মত হলেও বিচারপতি নাজমুন আরা ছাড়া
প্রত্যেকেই আলাদাভাবে নিজ নিজ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। এ
ক্ষেত্রে নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বিশ্লেষণ, দেশ-বিদেশের
আইনি সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্তের উল্লেখ এবং আইনগত ব্যাখ্যা বিশেষ
তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর উল্লেখ করা দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার সাবেক
প্রধান বিচারপতি শিরানি বন্দরনায়েকের কথাও আছে। শিরানি বন্দরনায়েকেকে
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের সমর্থক সাংসদেরা দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে
অভিশংসন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের কিছু
পদক্ষেপ অসাংবিধানিক ঘোষণার কারণেই বিচারপতি শিরানির বিরুদ্ধে ওই ব্যবস্থা
নেওয়া হয়। কিন্তু নতুন যাঁকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল, তাঁকে
আইনজীবীরা বয়কট করেন এবং নির্বাচনে সরকার বদলের পর নতুন প্রেসিডেন্ট
সিরিসেনা প্রধান বিচারপতি পদে শিরানি বন্দরনায়েকেকে ফিরিয়ে আনেন। সরকারের
কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের এই লড়াইয়ের দৃষ্টান্তের
সঙ্গে বাংলাদেশের যথেষ্ট মিল থাকলেও এখানে পরিণতিটা একেবারেই আলাদা।
সুপ্রিম কোর্টের এই পরিবর্তনের পর এখন আমাদের অপেক্ষার পালা। ষোড়শ সংশোধনীর
রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে রিভিউর আবেদন করা হয়েছে, যা নিয়ে
ভবিষ্যতে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। তবে সেই শুনানি কি আপিল বিভাগের রায়
প্রদানকারী বিচারপতিদের অবশিষ্ট চারজনই করবেন, নাকি তাতে ভবিষ্যতে আপিল
বিভাগে নিয়োগ পাবেন, এমন বিচারপতিরাও যুক্ত হবেন? সম্প্রসারিত বেঞ্চে
শুনানি হলে নতুন কারা আপিল বিভাগে যাবেন, সেদিকেও আগ্রহী সবার নজর থাকবে,
সন্দেহ নেই। আমরা ইতিমধ্যে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির প্রশ্নে
আপিল বিভাগেই অতীতের সিদ্ধান্ত বদল হতে দেখেছি। বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক
ঘটনাপ্রবাহে জনমনে অনেক প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। উদ্বেগ গভীর থেকে গভীরতর
হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অসম্ভব বলেই এই
উদ্বেগ। নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সামনে তাই চ্যালেঞ্জটা
অনেক বড়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা তাঁর সাফল্যই কামনা করি।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক
কামাল আহমেদ সাংবাদিক
No comments