বিশ্বায়নের কাল- বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত কোনটি?
এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের মনে ভেসে উঠতে পারে ফিলিস্তিনিদের গাজা ভূখণ্ডের
সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্তের কথা।
কেননা, বছরের পর বছর
সেখানকার বহু ফিলিস্তিনির নিষ্ঠুর হত্যার খবর বিশ্বের প্রধান প্রধান
সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে উঠে এসেছে। এখন অবশ্য ২৫ মাইল সীমান্তজুড়ে তারা
গড়ে তুলেছে নিরাপত্তাপ্রাচীর এবং পাঁচটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রবেশপথ।
অবশ্য, গাজা এখন কার্যত বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত জেলখানা। অন্য আর যে
সীমান্তে রক্ষীদের গুলিতে প্রাণহানির কথা শোনা যেত, সেটি হলো আমেরিকা
মহাদেশে যুক্তরাষ্ট্র আর মেক্সিকোর সীমান্ত। কিন্তু গুগলে অনুসন্ধান করলে
দেখা যাবে যে এই প্রশ্নের উত্তরটি হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। কেননা,
সংখ্যার দিক থেকে সীমান্তে প্রাণহানিতে বিশ্ব রেকর্ডটি আমাদেরই। আর
দুর্ভাগ্যজনকভাবে হতাহতের সবাই না হলেও অন্তত ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি।
কিছুদিন পর পর সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে খবর চোখে পড়লেও বিষয়টি যে একটা বিশ্ব রেকর্ডে দাঁড়িয়েছে, সেটা প্রথম গণমাধ্যমের নজরে আসে বছর চারেক আগে ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর-এর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের এই আচরণ যে এতটা ভয়াবহ এবং গুরুতর রূপ নিয়েছে, সেটা বুঝতে না পারার কারণ প্রধানত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা। সামগ্রিকভাবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় সন্দেহভাজনদের হত্যার বিষয়টিকে যে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে, সেটা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে অনেক।
‘ইন্ডিয়া’স গ্রেট ওয়াল—দ্য ওয়ার্ল্ডস ডেডলিয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রচারিত হয় ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই। চ্যানেল ফোরের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন রাগম্যানের প্রায় সাড়ে আট মিনিটের এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি ইন্টারনেটে এখনো পাওয়া যায়। তাঁর প্রতিবেদনে তিনি দেখিয়েছেন যে সীমান্তে হতাহত ব্যক্তিদের সবাই গরু পাচারকারী অথবা চোরাকারবারি নন। এসব অবৈধ কারবারে কেউ কেউ নিশ্চয়ই জড়িত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুর্ভোগ এবং বিপদের শিকার হচ্ছেন সীমান্ত এলাকার সাধারণ কৃষক এবং তাঁদের পরিবারগুলো। চাষাবাদের কাজ করার সময় বিএসএফের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন অথবা গুলি খেয়ে বেঁচে গেছেন এ রকম বেশ কিছু গ্রামবাসীর সাক্ষাৎকার রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। অভিন্ন নদীর প্রবাহে সীমান্ত বিভাজন হয়েছে এ রকম তিস্তার এক অংশে নৌকায় বাংলাদেশি নারীদের একটি দলকে পাচারের দৃশ্যও তাঁর প্রতিবেদনে রয়েছে। সীমান্তে যে প্রায় দুই হাজার মাইলজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি হচ্ছিল, তার পাশ ধরে লোকজনের চলাচল এবং সীমান্তরক্ষীদের সতর্ক নজরদারি ওসব জনপদের মানুষের জীবনযাত্রায় যে কী ধরনের ছন্দপতন ঘটিয়েছে, তার প্রতিফলন আছে জোনাথনের প্রতিবেদনে।
কিন্তু চ্যানেল ফোরের প্রতিবেদন ইংল্যান্ডের দর্শকদের আলোড়িত করলেও বাংলাদেশ বা ভারতে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। এই দুই দেশের কোনো টিভি চ্যানেল ফোরের ওই প্রতিবেদন পুনঃপ্রচার অথবা তারপর কী ঘটছে, সে বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে নিজস্ব কোনো রিপোর্ট বা অনুষ্ঠান করেছে বলে শোনা যায়নি। অথচ, বিষয়টি নিয়ে দুই দেশেই জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক সূচনার মতো ‘ফলোআপ’ করার এক চমৎকার সুযোগ তখন তৈরি হয়েছিল। সুযোগ বলছি এ কারণে যে এ ধরনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য বিশেষভাবে বাংলাদেশে কোনো চ্যানেলই অর্থের সংস্থান করে না। সুতরাং বড় ধরনের অনুসন্ধানের কাজ ছাড়াই চ্যানেল ফোরের প্রতিবেদনকে তখন কাজে লাগানোর একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
চ্যানেল ফোরের রিপোর্টেরও দেড় বছর পর ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এ ধরনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ শিরোনামে বিশদ আকারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই শতকের প্রথম ১০ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছেন এক হাজারের মতো বাংলাদেশি, যার অর্থ হচ্ছে গড়ে প্রতিবছর ১০০ জন অর্থাৎ প্রতি সাড়ে তিন দিনে একজন করে বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া শান্তির সময়ে কোনো দেশ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই হারে হত্যা করছে—এটা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং নাগরিক সমাজ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবে তা কল্পনা করাও দুষ্কর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতেও যেমন বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা এর ভয়াবহতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা ফেলানীর নিথর দেহের ছবি সাময়িকভাবে আমাদের কিছুটা বিচলিত করলেও সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে সবাই ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতা শুধু ক্ষমতাসীনদের একার নয়, এর আগে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন তাঁদেরও।
ফেলানী হত্যার বিচার বিএসএফের আদালতে না করে ফৌজদারি আদালতে অনুষ্ঠানের জন্য ভারতের কাছে বাংলাদেশ কোনো দাবি জানিয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। নাকি সরকার আশা করেছিল বিএসএফ তাদের নিজেদের বিচারে নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করবে? ‘সীমান্তে সন্দেহভাজনদের গুলি করা বন্ধ হবে না’ মর্মে বিএসএফের সাবেক প্রধান ইউ কে বনশলের বহুল প্রচারিত বক্তব্য (ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১২ বিবিসি) বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা কি ভুলে গিয়েছিলেন? ফেলানীর হত্যাকারী তো তাঁর বাহিনীপ্রধানের নির্দেশনাই অনুসরণ করেছেন। তাহলে সেই বাহিনীর আদালত কেন তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করবেন?
২০১১ সালের ২৫ জুলাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে চিঠি দিয়ে সীমান্তে নতুন করে হত্যা এবং নির্যাতনের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর দ্রুত ও স্বচ্ছ ফৌজদারি তদন্ত এবং ন্যায়বিচার দাবি করেছিল। ওই চিঠিতে তারা বলেছিল, ‘শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমায় প্রবেশের কারণে ভারতীয় জেলেদের বিরুদ্ধে কলম্বো কোনো পদক্ষেপ নিলে ভারত যখন প্রতিবাদ করে, তখন তাদেরই সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের এত দ্বিধা কেন?’ এ ধরনের যুক্তি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কণ্ঠে শোনা যায় না। বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে এটুকু নৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে না পারলে সেই সম্পর্কে বন্ধুত্বের আর কি অবশিষ্ট থাকে?
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের আরেকটি খবরের উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি নির্ধারণের একটি গবেষণা চালায়। তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কী ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হতে পারে, তার সম্ভাব্য কয়েকটি কাল্পনিক অবস্থার বিশ্লেষণ করা হয়। এতে যেসব সম্ভাব্য চিত্র তাদের সামনে উত্থাপিত হয়, তার একটি ছিল বাংলাদেশের একটি বিশাল এলাকা সাগরে তলিয়ে যাওয়ার কারণে কোটি মানুষের বাস্তুহারা হওয়া। এসব বাস্তুহারা স্বভাবতই বাঁচার আশায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতমুখী হতে চাইবে এবং তখন যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে, সেটা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দিতে পারে।
একাত্তরে কোটি খানেক বাংলাদেশিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ভারতের পক্ষে কি মেনে নেওয়া সম্ভব? সুতরাং দুই হাজার মাইল কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ তো একটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। বিএসএফের নিষ্ঠুরতার কারণে এই সীমান্তে বাংলাদেশিদের সন্ত্রস্ত রাখাটাই হয়তো তাদের কৌশলের অংশ। সীমান্ত এলাকায় চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) মোতায়েনের ঘোষণা (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩) এ ধারণাকেই সমর্থন করে। যদিও বিএসএফ-প্রধান বাংলাদেশ সীমান্তে এ ধরনের পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করেছেন। অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, ভারতে সন্ত্রাসীদের কথিত অনুপ্রবেশের সমস্যা পাকিস্তান সীমান্তে প্রকট হলেও ভারতের কাছে বাংলাদেশ সীমান্তের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। এর উপসর্গ বা লক্ষণ হিসেবে তাই তারা বলে থাকে যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান, চীন কিংবা মাওবাদী সন্ত্রাসকবলিত নেপালের সীমান্তে প্রাণহানির ঘটনা বাংলাদেশ সীমান্তের মতো এতটা নয়।
সীমান্ত সম্মেলনের মতো বিচ্ছিন্ন আলোচনা বা উদ্যোগে ভারতের এই সীমান্ত রক্ষানীতিতে যে পরিবর্তন আসবে না, সেটা বোঝার জন্য ইতিমধ্যেই অনেক কালক্ষেপণ হয়েছে। প্রাণ গেছে অনেক বেশি নিরীহ বাংলাদেশির। অথচ এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা শুধু এখনো পর্যন্ত শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ। সীমান্তে হত্যা বন্ধের জন্য ভারতের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির ন্যূনতম একটি পদক্ষেপ হতে পারে জাতীয় সংসদে সর্বদলীয় প্রস্তাব পাস, যাতে তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায় যে তাদের নাগরিকের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, ছোট প্রতিবেশীর অনুভূতি তার থেকে আলাদা নয়। অন্যান্য রাজনৈতিক বিরোধের বিষয়ে নিজেরা একে অপরকে রাজপথে মোকাবিলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলেও সীমান্তে মৃত্যুর মিছিল বন্ধে অন্তত একটা সমঝোতা হওয়া উচিত। তাহলে ওই প্রস্তাবে গণতান্ত্রিক ভারতের নেতাদের এ কথাটিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাবে যে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ পরিচয়টি কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদা বাড়ায় না। সামগ্রিক সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন না ঘটিয়েও তা সম্ভব হতে পারে।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
No comments