সম্পূর্ণ প্রেমের গল্প by বদরুন নাহার
১.
লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফি সফ্ট সাটিন নাইট ড্রেসে ঘরে আসতেই ডোনা বুঝতে পারে। সে সুইজারল্যান্ড থেকে আনা সুগন্ধি মোম জ্বেলে নেয়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফি সফ্ট সাটিন নাইট ড্রেসে ঘরে আসতেই ডোনা বুঝতে পারে। সে সুইজারল্যান্ড থেকে আনা সুগন্ধি মোম জ্বেলে নেয়।
বিছানায়
লেফটেন্যান্ট তার পুরো শরীরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরলে ডোনা সম্পূর্ণরূপে তাঁর
শরীরের চাপ অনুভব করে। তখনো কর্নেল স্লিপিং গাউনের ফিতা উন্মুক্ত করেননি।
সাধারণত সেটা আর একটু পরের পর্ব। প্রথমে চেপে থাকা ডোনার শরীর থেকে পোশাক
টেনে টেনে খুলবেন তিনি; এবং নিজের গাউন উন্মুক্ত করবেন একটানে, মাত্র একটি
ফিতায় হাত রেখে। কিন্তু তার আগে তিনি ডোনার ঠোঁটটা পুরে নেবেন মুখের ভেতর।
ঘরে তখন সৌরভময় ধোঁয়া ছড়িয়ে গলে পড়ছে মোম। ডোনা প্রতিটি মুহূর্তকে
তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করে। ঠোঁট পিষ্ট শেষ হতে না হতেই ফোনটা বেজে ওঠে।
অনায়াসে শফি উঠে পড়লেন। ডোনা শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করে। তার শরীর জেগে
উঠেছে, তাড়া সইছে না।
লেফটেন্যান্ট বুট ছাড়াই পা ফ্লোরে দপ করে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইয়েস, স্যার।’
ডোনা বিছানা থেকে দেখে বুঝতে পারছে না, শফির মুখে কোনো ভাঁজ পড়ছে কি না। মোমের আলোতে ঠিক মুখের কাছে মুখটা মুখোমুখি ঝুলে থাকলেই কেবল সে ভালো করে তাঁকে দেখতে পায়। একসময় একটি তুলতুলে পাখির ছানার মতো সে শফির বুকের সঙ্গে মিশে থাকতে থাকতে দেখত শারীরিক শ্রমের প্রতি পর্বে তাঁর মুখের ভাঁজের পরিবর্তন।
লেফটেন্যান্ট পা আরও সোজা করে বললেন, ‘ইয়েস, স্যার।’
এবং আবারও বললেন, ‘ইয়েস, স্যার।’
এবার তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন, ডোনা অনুভব করল, তার ঠোঁট এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়েছে এবং ঠোঁটে দাঁতের স্পর্শে মাংস উঁচু হয়ে গেছে। সে তবু একটুও নড়ে না। সে অপেক্ষা করে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের ফিরে আসার। আর ভাবতে থাকে, ফিরে এসে তিনি কি আবার ঠোঁট থেকে শুরু করবেন নাকি পিঠের নিচে হাত দিয়ে খুলে ফেলবেন হুক? সে চোখ বন্ধ করে বিষয়টি অনুভবে আনতে চায়। ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে অতিপ্রিয় বুটের শব্দ। আজ রাতে সেই স্বপ্নময় আওয়াজে ডোনা চমকে ওঠে। চোখ মেলে দরজায় দেখতে পায় তাঁকে।
সেখান থেকেই লেফটেন্যান্ট শফি বলে ওঠেন, ‘গুড নাইট, সুইটহার্ট।’
বুটের আওয়াজ তুলে চলে যান শফি। ডোনার ঠোঁটে হঠাৎ ব্যথা অনুভূত হয়। মিলিয়ে যেতে থাকা বুটের শব্দকে ফিরে চলা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ বলে মনে হয়। সে ব্যথিত হয়। সেই কবে থেকে ঘোড়ার খুরের ধুলো উড়িয়ে আসার প্রতীক্ষায় ছিল সে! আজ প্রথমবারের মতো মনে হয়, ঘোড়া চেপে নয়, ফিরে এসো রাজকুমার নগ্ন পা ফেলে।
২.
কবে থেকে ডোনা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল? স্কুলের গেটে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর দিকে সে তাকাতে পারত না। কারণ, সে সব সময় ভাবত যে দিগন্ত কাঁপিয়ে টগবগ টগবগ শব্দে আসবে রাজকুমার।
কলেজের প্রথম বর্ষের মেয়েদের মধ্যে ডোনাকে আলাদাভাবে চিনে নিত যে কেউ। তার মতো সুন্দর মুখের প্রাচুর্য তো ক্লাসময় ছিল না। কিন্তু সবাই তার দিকে তাকালেও ডোনা তাদের দেখেনি কখনো। সে কেবল কান পেতে থেকেছে। ঘোড়ার খুরের শব্দ দূর থেকে ক্রমশ কাছে আসতে আসতে বেড়ে যাওয়া শব্দের রাশ টেনে ধরায় প্রতিবাদী ঘোড়ার হ্রেষা; ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে আসবে যে, সে হবে পাহাড়ের মতো উঁচু, তার কণ্ঠের চমকে স্থির হয়ে যাবে ব্যস্ত শহর। সেই স্থির নীরবতায় পা ফেলে এগিয়ে এসে রাজকুমার হাঁটু গেড়ে নতজানু হবে ডোনার সামনে। বলবে, ‘এসেছি।’
ডোনার অধর কেঁপে কেঁপে যাবে, সে বলে উঠবে, ‘ভালোবেসেছি...ভালোবেসেছি...।’
শহর স্থির হয় না, ডোনার অধরও কাঁপে না। ব্যস্ততাক্লিষ্ট শহরের মধ্যে সাইকেলের টুংটাং শব্দে গতকালের চালানে আসা সবচেয়ে রঙিন গোলাপ হাতে কেউ এসে দাঁড়ালেও ডোনা চোখ ফিরিয়ে নেয়। এমনকি পালসার কিংবা ডিসকভারির হানড্রেড ফিফটি মোটরবাইক হার্ডব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পথরোধ করলেও উল্টো পথে হেঁটেছে ডোনা। সে তার সব প্রেম নিয়ে অপেক্ষায় আছে ঘোড়া সওয়ারির। মনে মনে ভেবে রেখেছে, তার সামনে নিজের আচরণটা কী হবে। কতটা নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠবে দুজন প্রথম দর্শনে। সে কি হাত বাড়িয়ে ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবে তাকে? হারিয়ে যাবে দিগন্ত থেকে দিগন্তে, নাকি হাত বাড়িয়ে চুম্বন করবে হাতে, চোখ বুজে আসবে ডোনার...। ক্লাসের ফাঁকে এমন সব ভাবনায় ফ্লোরোসেন্ট-ফরসা মুখে গিরগিটির মতো রক্ত জমা হলে বান্ধবীরা চেপে ধরত, ‘বল না, কে? কত দিন ধরে...ডুবে ডুবে জল!’
কিন্তু কোথায় সে? ক্লাসের পরীক্ষা ছাড়া আর সেই গোধূলি ধুলোর ঝড় তোলা-ক্ষণ আসে না। তবু ডোনা জানত, আসবে। তাই তার অপেক্ষার সময়গুলো পরিকল্পনার সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যায়।
ডোনা ভেবে রাখে, রাজকুমারকে সাত বর্ণের ঝালর বানিয়ে দেবে নিজ হাতে। কী ফুল আনবে সে? সে কি জানবে না রক্তকরবী নয়, নীলপদ্মও নয়, কেবল ক্যামেলিয়া ফুলের জন্য আজন্ম অপেক্ষা তার। প্রতিদিনই নিজেকে সুন্দর থেকে সুন্দর করে পরিপাটি করতে থাকে ডোনা। তবে দিন শেষে ক্লান্ত মনে সে অস্থির হয়। আর কবে? বান্ধবীদের কাছে হাসির খোরাক হচ্ছে দিনে দিনে। কেউ কেউ বলে অহংকারী। কিন্তু ডোনা কাউকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না তার প্রেমের গভীরতা, অপেক্ষার প্রহরে একাকিত্বের কষ্ট নিয়ে সে জেগে আছে দূরের চাঁদের মতো!
শহরে তখন তুমুল জনস্রোত। কিন্তু পথটাকে ডোনার প্রতিদিনের মতো লাগে না, তবে কি সে ভিন্ন কোথায় চলে এল? জনস্রোতকে স্তব্ধ করে ভেসে আসে ছুটন্ত ঘোড়ার পদধ্বনি, হ্রেষা। এছাড়া আর সবই স্তব্ধ। যেমনটা হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তা-ই। ক্রমশ শব্দের নৈকট্যে ডোনার অস্থিরতা বাড়ে। ঘোড়ার মুখের পানে চেয়ে তাকাতে চায় রাজকুমারের দিকে, ঠিক তখনই জেগে ওঠে ডোনা। তার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে যায়, দুঃখ এসে ভর করে মনে। চেহারাটা পর্যন্ত দেখা হলো না! স্পর্শের কাছে পেয়েও যেন দূর হয়ে গেল সবকিছু। ডোনা জানালায় দাঁড়িয়ে মধ্যরাতে তারার ছুটে চলা দেখে। মনে মনে প্রার্থনা করে, রাজপুত্র এবং তার ঘোড়ার জন্য। তারাটি কি ডোনার খবর পৌঁছে দেবে তাকে?
৩.
মা বললেন, ‘ছেলেটা ভালো। তোমার বাবার সঙ্গে আমিও ছিলাম, দেখেছি। একেবারে রাজপুত্রের মতো।’
ডোনার মন ক্রমশ মেঘাচ্ছন্ন হয়। সে ভাবে, তাহলে কেন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এল না সে, এসে অস্ফুট স্বরে বলল না, ‘এসেছি।’
মা বলেন, ‘এখনকার দিনে সবচেয়ে দামি পাত্র সে। ডিফেন্সে আছে, বিয়ে করতে একটু দেরি হলো ক্যারিয়ারের জন্য।’
ডোনার চোখের সামনে ধুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মুখ সহজেই একটা অবয়ব পেতে থাকে। সে কোনো উত্তর দিতে পারে না। মা তাকে সময় দেন।
রাজকুমারের অপেক্ষায় থেকে এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে, সে চিন্তা কখনো হয়নি তার। বান্ধবীরা শুনেই বলে, ‘এই জন্যই অপেক্ষায় ছিলি?’
সে কিছু বলে না। কাউকে কিছু বললে হাসবে, ডোনার এই অপেক্ষারত প্রেমের কথা এমনকি মাকেও বলা যাচ্ছে না। তবে কি ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জীবন? অস্পষ্ট মুখের ছায়া খুঁজে ফিরতে হবে গোপনে, অন্যের বাহুলগ্ন থেকে!
ডোনা স্বপ্নভঙ্গের ব্যথায় ব্যাকুল। ভাবতে থাকে, আসলে সে কেমন দেখতে হতো, তার বুকটা কি লোমশ নাকি ঠোঁটের নিচে তিল?
ডোনার আকাঙ্ক্ষার উচ্চতা ছিল একটু বেশিই, তাই চারপাশে সবকিছু বড় তুচ্ছ আর নীচু মনে হয়েছে সব সময়। মা-ই তাকে তৈরি করে তুলেছিলেন উচ্চাভিলাষী করে। ছোটবেলায় মেয়ের নাক প্রতিদিন টেনে টেনে তেল মাখতেন তিনি, চোখে কাজল পরাতেন। ডোনা নাকি তাই এত সুন্দর হয়েছে, যা কিছু চিনতে শিখেছে, সবই সুন্দর। এমনকি অনেক উঁচুতে তার ভাবনার বসবাস! কিন্তু সেখান থেকে আজও সে ছুঁতে পারেনি প্রেম। এত যত্ন করে ভালোবাসতে শিখেছে, অথচ কোথায় সে জন? ডোনা চোখ মেলে পথের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, রিকশার হুড ফেলে চলে যাওয়া ছেলেটির চিবুকে ভাঁজ, মোটরবাইকের হেলমেট; কিন্তু কোথাও মেলে না খুরের শব্দে ছুটে আসা সেই রাজকুমার। অতঃপর নীরবতা পেরিয়ে বিয়ে!
৪.
নিজের কল্পনাশক্তির প্রতি ডোনার বিশ্বাস ছিল, কিন্তু সেই কল্পনাকে যেন হার মানাল বাস্তব! এভাবে সত্যি সত্যিই তার আসল রাজকুমারকেই পেয়ে যাবে, তা কি আদৌ ভেবেছিল ডোনা! মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশের নয়, আসলেই মা তাকে রাজকুমার এনে দিয়েছেন। সেই ছোটবেলায় যেমন নাকটা টেনে টেনে উঁচু করেছিলেন, আজও যেন তাঁর যত্নের সেই ছোঁয়া।
ডোনার নিভে যাওয়া স্বপ্নের দরজায় প্রথম কড়া নাড়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফির চৌকস বুটের শব্দ। এল বুঝি রাজকুমার! কর্নেলের বুটের শব্দে সহসা মনে হয় ঘোড়ার খুরের আওয়াজ! এল রাজকুমার। তারপর শফি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে অধর ছুঁয়ে গেলে ডোনা কেঁপে কেঁপে যায়। সেই অপেক্ষমাণ কম্পনের ভেতর সে শুনতে পায়, ‘আই লাভ ইউ।’
তার ঠোঁট দুটো রাজকুমারের গহ্বরে ডুবে যেতে যেতে বলতে থাকে, ‘ভালোবেসেছি...ভালোবেসেছি।’
সেই থেকে ডোনার স্বপ্নের সংসারে লেফটেন্যান্ট শফি ঘোড়ার খুরের মতো পা ফেলে ফেলে ফিরে আসেন। তাঁর পৌরুষদীপ্ত ছোঁয়ায় একসময় নিজেকে রাজেশ্বরী মনে হতো ডোনার।
কিন্তু আজ! শরীরের ওপর কর্নেল না থাকলেও সে এতটুকু নড়তে পারে না। তার ভীষণ কষ্ট হয়। বুটের শব্দ মিলিয়ে গেলেও ডোনার কানে তা বেজে চলে কর্কশভাবে। সুগন্ধি মোমের মতো নীরবে তার চোখ বেয়ে নামে জল। আহারে রাজকুমার!
আজ হয়তো সারা রাত ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে কাটাবে। রাজার আদেশ।
লেফটেন্যান্ট বুট ছাড়াই পা ফ্লোরে দপ করে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইয়েস, স্যার।’
ডোনা বিছানা থেকে দেখে বুঝতে পারছে না, শফির মুখে কোনো ভাঁজ পড়ছে কি না। মোমের আলোতে ঠিক মুখের কাছে মুখটা মুখোমুখি ঝুলে থাকলেই কেবল সে ভালো করে তাঁকে দেখতে পায়। একসময় একটি তুলতুলে পাখির ছানার মতো সে শফির বুকের সঙ্গে মিশে থাকতে থাকতে দেখত শারীরিক শ্রমের প্রতি পর্বে তাঁর মুখের ভাঁজের পরিবর্তন।
লেফটেন্যান্ট পা আরও সোজা করে বললেন, ‘ইয়েস, স্যার।’
এবং আবারও বললেন, ‘ইয়েস, স্যার।’
এবার তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন, ডোনা অনুভব করল, তার ঠোঁট এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়েছে এবং ঠোঁটে দাঁতের স্পর্শে মাংস উঁচু হয়ে গেছে। সে তবু একটুও নড়ে না। সে অপেক্ষা করে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের ফিরে আসার। আর ভাবতে থাকে, ফিরে এসে তিনি কি আবার ঠোঁট থেকে শুরু করবেন নাকি পিঠের নিচে হাত দিয়ে খুলে ফেলবেন হুক? সে চোখ বন্ধ করে বিষয়টি অনুভবে আনতে চায়। ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে অতিপ্রিয় বুটের শব্দ। আজ রাতে সেই স্বপ্নময় আওয়াজে ডোনা চমকে ওঠে। চোখ মেলে দরজায় দেখতে পায় তাঁকে।
সেখান থেকেই লেফটেন্যান্ট শফি বলে ওঠেন, ‘গুড নাইট, সুইটহার্ট।’
বুটের আওয়াজ তুলে চলে যান শফি। ডোনার ঠোঁটে হঠাৎ ব্যথা অনুভূত হয়। মিলিয়ে যেতে থাকা বুটের শব্দকে ফিরে চলা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ বলে মনে হয়। সে ব্যথিত হয়। সেই কবে থেকে ঘোড়ার খুরের ধুলো উড়িয়ে আসার প্রতীক্ষায় ছিল সে! আজ প্রথমবারের মতো মনে হয়, ঘোড়া চেপে নয়, ফিরে এসো রাজকুমার নগ্ন পা ফেলে।
২.
কবে থেকে ডোনা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল? স্কুলের গেটে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর দিকে সে তাকাতে পারত না। কারণ, সে সব সময় ভাবত যে দিগন্ত কাঁপিয়ে টগবগ টগবগ শব্দে আসবে রাজকুমার।
কলেজের প্রথম বর্ষের মেয়েদের মধ্যে ডোনাকে আলাদাভাবে চিনে নিত যে কেউ। তার মতো সুন্দর মুখের প্রাচুর্য তো ক্লাসময় ছিল না। কিন্তু সবাই তার দিকে তাকালেও ডোনা তাদের দেখেনি কখনো। সে কেবল কান পেতে থেকেছে। ঘোড়ার খুরের শব্দ দূর থেকে ক্রমশ কাছে আসতে আসতে বেড়ে যাওয়া শব্দের রাশ টেনে ধরায় প্রতিবাদী ঘোড়ার হ্রেষা; ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে আসবে যে, সে হবে পাহাড়ের মতো উঁচু, তার কণ্ঠের চমকে স্থির হয়ে যাবে ব্যস্ত শহর। সেই স্থির নীরবতায় পা ফেলে এগিয়ে এসে রাজকুমার হাঁটু গেড়ে নতজানু হবে ডোনার সামনে। বলবে, ‘এসেছি।’
ডোনার অধর কেঁপে কেঁপে যাবে, সে বলে উঠবে, ‘ভালোবেসেছি...ভালোবেসেছি...।’
শহর স্থির হয় না, ডোনার অধরও কাঁপে না। ব্যস্ততাক্লিষ্ট শহরের মধ্যে সাইকেলের টুংটাং শব্দে গতকালের চালানে আসা সবচেয়ে রঙিন গোলাপ হাতে কেউ এসে দাঁড়ালেও ডোনা চোখ ফিরিয়ে নেয়। এমনকি পালসার কিংবা ডিসকভারির হানড্রেড ফিফটি মোটরবাইক হার্ডব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পথরোধ করলেও উল্টো পথে হেঁটেছে ডোনা। সে তার সব প্রেম নিয়ে অপেক্ষায় আছে ঘোড়া সওয়ারির। মনে মনে ভেবে রেখেছে, তার সামনে নিজের আচরণটা কী হবে। কতটা নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠবে দুজন প্রথম দর্শনে। সে কি হাত বাড়িয়ে ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবে তাকে? হারিয়ে যাবে দিগন্ত থেকে দিগন্তে, নাকি হাত বাড়িয়ে চুম্বন করবে হাতে, চোখ বুজে আসবে ডোনার...। ক্লাসের ফাঁকে এমন সব ভাবনায় ফ্লোরোসেন্ট-ফরসা মুখে গিরগিটির মতো রক্ত জমা হলে বান্ধবীরা চেপে ধরত, ‘বল না, কে? কত দিন ধরে...ডুবে ডুবে জল!’
কিন্তু কোথায় সে? ক্লাসের পরীক্ষা ছাড়া আর সেই গোধূলি ধুলোর ঝড় তোলা-ক্ষণ আসে না। তবু ডোনা জানত, আসবে। তাই তার অপেক্ষার সময়গুলো পরিকল্পনার সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যায়।
ডোনা ভেবে রাখে, রাজকুমারকে সাত বর্ণের ঝালর বানিয়ে দেবে নিজ হাতে। কী ফুল আনবে সে? সে কি জানবে না রক্তকরবী নয়, নীলপদ্মও নয়, কেবল ক্যামেলিয়া ফুলের জন্য আজন্ম অপেক্ষা তার। প্রতিদিনই নিজেকে সুন্দর থেকে সুন্দর করে পরিপাটি করতে থাকে ডোনা। তবে দিন শেষে ক্লান্ত মনে সে অস্থির হয়। আর কবে? বান্ধবীদের কাছে হাসির খোরাক হচ্ছে দিনে দিনে। কেউ কেউ বলে অহংকারী। কিন্তু ডোনা কাউকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না তার প্রেমের গভীরতা, অপেক্ষার প্রহরে একাকিত্বের কষ্ট নিয়ে সে জেগে আছে দূরের চাঁদের মতো!
শহরে তখন তুমুল জনস্রোত। কিন্তু পথটাকে ডোনার প্রতিদিনের মতো লাগে না, তবে কি সে ভিন্ন কোথায় চলে এল? জনস্রোতকে স্তব্ধ করে ভেসে আসে ছুটন্ত ঘোড়ার পদধ্বনি, হ্রেষা। এছাড়া আর সবই স্তব্ধ। যেমনটা হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তা-ই। ক্রমশ শব্দের নৈকট্যে ডোনার অস্থিরতা বাড়ে। ঘোড়ার মুখের পানে চেয়ে তাকাতে চায় রাজকুমারের দিকে, ঠিক তখনই জেগে ওঠে ডোনা। তার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে যায়, দুঃখ এসে ভর করে মনে। চেহারাটা পর্যন্ত দেখা হলো না! স্পর্শের কাছে পেয়েও যেন দূর হয়ে গেল সবকিছু। ডোনা জানালায় দাঁড়িয়ে মধ্যরাতে তারার ছুটে চলা দেখে। মনে মনে প্রার্থনা করে, রাজপুত্র এবং তার ঘোড়ার জন্য। তারাটি কি ডোনার খবর পৌঁছে দেবে তাকে?
৩.
মা বললেন, ‘ছেলেটা ভালো। তোমার বাবার সঙ্গে আমিও ছিলাম, দেখেছি। একেবারে রাজপুত্রের মতো।’
ডোনার মন ক্রমশ মেঘাচ্ছন্ন হয়। সে ভাবে, তাহলে কেন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এল না সে, এসে অস্ফুট স্বরে বলল না, ‘এসেছি।’
মা বলেন, ‘এখনকার দিনে সবচেয়ে দামি পাত্র সে। ডিফেন্সে আছে, বিয়ে করতে একটু দেরি হলো ক্যারিয়ারের জন্য।’
ডোনার চোখের সামনে ধুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মুখ সহজেই একটা অবয়ব পেতে থাকে। সে কোনো উত্তর দিতে পারে না। মা তাকে সময় দেন।
রাজকুমারের অপেক্ষায় থেকে এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে, সে চিন্তা কখনো হয়নি তার। বান্ধবীরা শুনেই বলে, ‘এই জন্যই অপেক্ষায় ছিলি?’
সে কিছু বলে না। কাউকে কিছু বললে হাসবে, ডোনার এই অপেক্ষারত প্রেমের কথা এমনকি মাকেও বলা যাচ্ছে না। তবে কি ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জীবন? অস্পষ্ট মুখের ছায়া খুঁজে ফিরতে হবে গোপনে, অন্যের বাহুলগ্ন থেকে!
ডোনা স্বপ্নভঙ্গের ব্যথায় ব্যাকুল। ভাবতে থাকে, আসলে সে কেমন দেখতে হতো, তার বুকটা কি লোমশ নাকি ঠোঁটের নিচে তিল?
ডোনার আকাঙ্ক্ষার উচ্চতা ছিল একটু বেশিই, তাই চারপাশে সবকিছু বড় তুচ্ছ আর নীচু মনে হয়েছে সব সময়। মা-ই তাকে তৈরি করে তুলেছিলেন উচ্চাভিলাষী করে। ছোটবেলায় মেয়ের নাক প্রতিদিন টেনে টেনে তেল মাখতেন তিনি, চোখে কাজল পরাতেন। ডোনা নাকি তাই এত সুন্দর হয়েছে, যা কিছু চিনতে শিখেছে, সবই সুন্দর। এমনকি অনেক উঁচুতে তার ভাবনার বসবাস! কিন্তু সেখান থেকে আজও সে ছুঁতে পারেনি প্রেম। এত যত্ন করে ভালোবাসতে শিখেছে, অথচ কোথায় সে জন? ডোনা চোখ মেলে পথের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, রিকশার হুড ফেলে চলে যাওয়া ছেলেটির চিবুকে ভাঁজ, মোটরবাইকের হেলমেট; কিন্তু কোথাও মেলে না খুরের শব্দে ছুটে আসা সেই রাজকুমার। অতঃপর নীরবতা পেরিয়ে বিয়ে!
৪.
নিজের কল্পনাশক্তির প্রতি ডোনার বিশ্বাস ছিল, কিন্তু সেই কল্পনাকে যেন হার মানাল বাস্তব! এভাবে সত্যি সত্যিই তার আসল রাজকুমারকেই পেয়ে যাবে, তা কি আদৌ ভেবেছিল ডোনা! মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশের নয়, আসলেই মা তাকে রাজকুমার এনে দিয়েছেন। সেই ছোটবেলায় যেমন নাকটা টেনে টেনে উঁচু করেছিলেন, আজও যেন তাঁর যত্নের সেই ছোঁয়া।
ডোনার নিভে যাওয়া স্বপ্নের দরজায় প্রথম কড়া নাড়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফির চৌকস বুটের শব্দ। এল বুঝি রাজকুমার! কর্নেলের বুটের শব্দে সহসা মনে হয় ঘোড়ার খুরের আওয়াজ! এল রাজকুমার। তারপর শফি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে অধর ছুঁয়ে গেলে ডোনা কেঁপে কেঁপে যায়। সেই অপেক্ষমাণ কম্পনের ভেতর সে শুনতে পায়, ‘আই লাভ ইউ।’
তার ঠোঁট দুটো রাজকুমারের গহ্বরে ডুবে যেতে যেতে বলতে থাকে, ‘ভালোবেসেছি...ভালোবেসেছি।’
সেই থেকে ডোনার স্বপ্নের সংসারে লেফটেন্যান্ট শফি ঘোড়ার খুরের মতো পা ফেলে ফেলে ফিরে আসেন। তাঁর পৌরুষদীপ্ত ছোঁয়ায় একসময় নিজেকে রাজেশ্বরী মনে হতো ডোনার।
কিন্তু আজ! শরীরের ওপর কর্নেল না থাকলেও সে এতটুকু নড়তে পারে না। তার ভীষণ কষ্ট হয়। বুটের শব্দ মিলিয়ে গেলেও ডোনার কানে তা বেজে চলে কর্কশভাবে। সুগন্ধি মোমের মতো নীরবে তার চোখ বেয়ে নামে জল। আহারে রাজকুমার!
আজ হয়তো সারা রাত ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে কাটাবে। রাজার আদেশ।
No comments