গর্ভধারণ যখন পেশা

জীবিকার তাগিদে মানুষ কত কী-ই না করে। অন্যের সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ ও জন্ম দেওয়াও যে একটি পেশা হতে পারে, তা আমাদের অনেকের কাছে বিস্ময়ের।
অথচ আজকের পৃথিবীর দরিদ্র মানুষ স্রেফ জীবিকার্জনের জন্য যেসব পেশা বেছে নিচ্ছে, ‘ভাড়াটে মা’ হওয়া সেগুলোর অন্যতম।

‘ভাড়াটে মা’ বা ‘সারোগেট মাদার’ কার্যত গর্ভ ভাড়া দেওয়ার এক পেশা। এ ক্ষেত্রে একজন নারী গর্ভধারণে অক্ষম অন্য কোনো নারীর ভ্রূণ নিজের গর্ভে ধারণ করে সন্তান জন্ম দেন। ভ্রূণ থেকে সন্তান জন্মানো পর্যন্ত মাঝখানের কাজটি সম্পন্ন হয় একজন ভাড়াটে মায়ের গর্ভে।
ভারতের গুজরাটের আনন্দ এলাকার অনেক নারীর কাছে গর্ভ ভাড়া দেওয়ার কাজটি এখন পেশায় পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ সাময়িকী সম্প্রতি একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আনন্দের ‘সাত কাইভাল হসপিটাল অ্যান্ড আকাঙ্ক্ষা ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক’ এখন ভাড়াটে মা বা সারোগেট মায়েদের একটি বড় কেন্দ্রস্থল।
হাসপাতালটি পরিচালনা করেন নয়না প্যাটেল (৫৫) ও তাঁর স্বামী হূতেষ (৫৭)। তাঁদের তত্ত্বাবধানে এখন এ হাসপাতাল থেকে মাসে প্রায় ৩০টি শিশুর জন্ম দেওয়া হয়।
যে মায়েরা এসব শিশুর জন্ম দেন, তাঁদের অন্যতম সারোগেট মাদার ফাইভ হানড্রেড বা ৫০০তম ভাড়াটে মা। এই স্বামীপরিত্যক্ত নারীর দুটি সন্তান আছে। তিনি গত ৫ আগস্ট একটি মেয়েশিশুর জন্ম দেন। চারদিন পর তিনি শিশুটিকে প্রথমবারের মতো দেখার সুযোগ পান। তখন শিশুটি লক্ষেৗ থেকে আসা তার প্রকৃত মা-বাবার কোলে। শিশুটিকে দেখে অস্ফুট স্বরে তিনি বলেন, ‘এ বাচ্চাটা যদি মেয়ে হয়, তবে এটি অবশ্যই আমার।’

এক বছর আগে এই ভাড়াটে মা ছিলেন নিঃস্ব, রিক্ত। তখন তাঁর ছোট ছেলেটির বয়স তিন বছর, আর বড়টির পাঁচ। ছোট সন্তানের জন্মের পর তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর তিনি তাঁর গৃহকর্মী মায়ের কাছে চলে যান। তাঁর মা তখন নয়না প্যাটেলের হাসপাতালের পেছনে এক রাস্তার ফুটপাতে থাকতেন। সেখানে থেকে তিনিও মায়ের পেশায় যোগ দেন। এতে তাঁর মাসে আয় হতো দুই হাজার রুপির মতো। এরপর তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে নয়নার হাসপাতাল নিয়ে যান এবং তিনি শুরু করেন নতুন পেশার কাজ।
যে শিশুটি তিনি জন্ম দিয়েছেন, তাকে তিনি আর কখনোই দেখতে পারবেন না। তবু কাজটি করে তাঁর মধ্যে এক ধরনের সন্তুষ্টি আছে। তিনি আয় করেছেন তিন লাখ রুপি। এই অর্থ তিনি ব্যয় করতে চান তাঁর অজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণে—একটি ছোট বাড়ি বানাতে।
নয়না ১৯৯৯ সাল থেকে খেয়ালের বশে গর্ভপ্রতিস্থাপন (ইন-ভাইট্রো ফার্টিলাইজেশন) অস্ত্রোপচারের কাজ শুরু করেন। এরপর ২০০১ সালে তাঁর কাছে এক অদ্ভুত প্রস্তাব আসে। এক নারী তাঁর মেয়ের ভ্রূণ নিজের গর্ভে ধারণ করতে চান। কারণ ওই মেয়ের সন্তান হচ্ছে না বলে তাঁর পরিবার ভেঙে যেতে বসেছে। তাই মেয়ের ভ্রূণ নিজের গর্ভে প্রতিস্থাপন করে তিনি মেয়ের সংসার ঠিক রাখতে চান। নয়না অস্ত্রোপচারটি করেন এবং একই সঙ্গে তিনি এটাও বুঝতে পারেন যে ভারতের অনেক পরিবারেই এ ধরনের সংকট আছে। এরপর তিনি এ ধরনের বিশেষায়িত কাজের জন্য একটি ক্লিনিক খুলে বসেন।
নয়না প্যাটেলের এ ধরনের তত্পরতার পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এটি অভারতীয় নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য হবে। এ নীতিমালার শুরুটি ছিল একটি ঘটনাকে ভিত্তি করে। এক জাপানি দম্পতি নয়নার কাছে আসে একটি গর্ভ ভাড়া করে তাদের সন্তানের জন্ম দিতে। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু সন্তান জন্মানোর আগেই ওই দম্পতির মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এবং কেউই ওই সন্তানের দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। ফলে ওই শিশুকে পড়তে হয় বিপত্তির মধ্যে। তাই সরকারও উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাপারটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে।
এরপর আরেকটি মামলা সরকারকে নীতিমালা প্রণয়নে বাধ্য করেছে। জান বালাজ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে এক মামলা হয়েছিল। ওই মামলার রায়ে আদালত বলেন, এ ধরনের শিশুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব থাকবে এবং তাদের যদি কেউ গ্রহণ করতে চায়, তবে দত্তক আইন মেনেই তা করতে হবে।

নীতিমালা
এখন পর্যন্ত নয়নার ক্লিনিকে ৬৮০টি শিশুর জন্ম হয়েছে। তবে নতুন আইন বলছে, ক্লিনিকটি এত দিন ভাড়াটে মায়েদের যেমন করে নিয়োগ দিয়েছে, তা আর করা যাবে না। বরং ভাড়াটে মায়েদের দেখভালের জন্য একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে, যারা মায়েদের সব দিকে খেয়াল রাখবে। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন: গর্ভধারণকারীর বয়স ২১-২৫ বছরের মধ্যে হতে হবে; কোনো নারীই তিনবারের বেশি গর্ভ ভাড়া দিতে পারবেন না; বিবাহিত হলে ওই নারীকে অবশ্যই স্বামীর অনুমতি নিতে হবে; শুধু ভারতীয় নাগরিকদের ভ্রূণই গর্ভে ধারণ করা যাবে; গর্ভধারণকারীকে অবশ্যই সন্তানের ওপর আইনত মা-বাবার যে দাবি থাকে, সেগুলো পরিত্যাগ করতে হবে; সন্তান জন্মানোর পর প্রকৃত মা-বাবা ওই সন্তানকে গ্রহণে বাধ্য থাকবেন ইত্যাদি।

অর্থ
ভাড়াটে মায়েরা জানান, পুরো কাজের জন্য দম্পতিরা যে পরিমাণ অর্থ দেয়, তার এক-চতুর্থাংশ পান তাঁরা। সাধারণত পুরো কাজের জন্য আট থেকে ১১ লাখ রুপি নেওয়া হয়। দম্পতিরা দেশি হোক বা বিদেশি, এতে তেমন হেরফের হয় না। তবে দম্পতিদের কাছ থেকে পাওয়া আচরণে তফাত হয়। ভাড়াটে মায়েরা জানান, সাধারণত ভারতীয় মা-বাবারা সন্তানকে পরে আর ভাড়াটে মায়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ করতে দেন না এবং পরিচয় গোপন রাখতে চান। বিদেশিরা এ ক্ষেত্রে অনেক উদার।

সমালোচনা
তবে এ নিয়ে জটিলতা এখনো অনেক। নয়না প্যাটেল বলেছেন, সরকার ভাড়াটে মায়েদের দেখভালের জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেবে। ব্যাপারটি যেন এ রকম যে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলো গর্ভধারণকারীদের দেখভাল করতে পারে, কিন্তু চিকিত্সকেরা পারেন না। এ যুক্তি অগ্রহণযোগ্য।
সুমন নামের ৩২ বছর বয়সী আরেক ভাড়াটে মা বলেন ভিন্ন সমস্যার কথা। তিনি বলেন, ধরা যাক, এক নারী যমজ সন্তানের জন্ম দিলেন, যার মধ্যে একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। প্রকৃত দম্পতি কেবল মেয়েটিকে গ্রহণ করতে চান। তখন ছেলেটিকে কি তার গর্ভধারণকারী গ্রহণ করবেন, বা করতে বাধ্য থাকবেন?
সুমন সামাজিক সমস্যার কথাও জানান। তিনি বলেন, তাঁর তিনটি সন্তান আছে: নিধি (৭), নিশা (৯) ও নিরালি (১১)। তিনি গত পাঁচ মাস ধরে হাসপাতালে আছেন। এ সময় তাঁর সন্তানেরা কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছে। প্রতিবেশীরাও অনেকে গেছেন। কিন্তু এক প্রতিবেশী পরিবার যায়নি, কারণ তারা সুমনের বিষয়টি ভালো চোখে দেখেয় না।
এ প্রসঙ্গে সুমন বলেন, ‘যারা সমালোচনা করছে, তারা কি আমাকে ভাত দেবে? আমি ভুল কিছু করিনি। তাহলে আমি কেন সত্য গোপন করব?’ তিনি জানান, তাঁর অর্থের দরকার। তাঁর স্বামী অন্যের জমিতে কৃষিমজুরের কাজ করেন। তিনি দিনে মাত্র ১০০ রুপি আয় করেন। তাতে সংসার চলে না।
নয়না প্যাটেলও বলেন, ক্লিনিকটি চালুর পর তাঁকেও অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এ কাজের ফলে অনেক পরিবারের যে উপকার হচ্ছে, তা মানুষের কাছে ক্রমে পরিষ্কার হচ্ছে।
নয়না এ খাতের অনেক সম্ভাবনাও দেখছেন। তিনি বলেন, সরকারের উচিত এ ধরনের উদ্যোগকে দেশময় ছড়িয়ে দেওয়া। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও উদ্যোগ বাড়াচ্ছেন। এক লাখ বর্গফুটের বিশাল হাসপাতাল নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছেন নয়না। এটি ২০১৪ সালে চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
নয়না জানান, মেথোডিস্ট বা ক্যাথলিক চার্চের পাদরি, মৌলভি ও হিন্দুধর্মীয় নেতাদের সবাই গর্ভ ভাড়া দেওয়ার কাজটি নিন্দনীয় বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তাতে এ পেশা বন্ধ হয়ে যায়নি। নয়না বলেন, ‘আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন পরিস্থিতি ছিল খুবই বন্ধুর। এখন আমি কাউকে কিছু বলি না। কারণ আমি জানি, যাঁরা কথা বলছেন, তাঁরা কেউ যেমন সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তান দিতে পারেন না, তেমনি ভাড়াটে মা হিসেবে কাজ করা নারীদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারেন না।’

No comments

Powered by Blogger.