পিপ্পির মন খারাপ by আশিক মুস্তাফা
মরিচ দেখলেই মাথায় চক্কর মেরে ওঠে পিপ্পির। এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। হেলেদুলে পড়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
একেবারে
হার্ট-অ্যাটাক করা মানুষের মতো অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন তার
কপাল-মুখে পানি ছিটালেও কাজ হয় না। মড়ার মতো পড়েই থাকে। তবে বুদ্ধি করে
কেউ যদি তার নাকের সামনে মরিচ ভেঙে ধরে, তো আর ডাক্তার-টাক্তার লাগে না।
মুহূর্তেই ব্যাঙ-লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। কখনো এদিক-সেদিক দু-তিনটা লাফঝাঁপও
দিয়ে দেয়!
ছোট্টমোট্ট চক্কর খাওয়া পিপ্পি নামের এই পিঁপড়েটা বড্ড একরোখা। যা মন চাইবে তার, তা-ই করবে। পিপ্পির কোথাও যেতে ইচ্ছে হলে হাজার বায়না দেখিয়েও আটকানো যায় না। সে যাবেই যাবে। তো একরোখা এই পুঁচকে পিঁপড়েটা পথেঘাটে চলতে গিয়ে কখনোসখনো যদি মরিচ দেখে; তো ফের তার মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ ঝিমিয়েটিমিয়ে কুরকুর করে বেয়ে উঠে যায় মরিচের পিঠে। তারপর শুরু করে কুচকুচ, কখনো কুচুরকুচ! একেবারে কেঁচিকাটা যাকে বলে আরকি! তার এমন কাণ্ডে লজ্জা পায় পিঁপড়াসমাজ। বড়রা হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নেয়। পিচ্চি-কাচ্চিরা অপলক এই কাণ্ড দেখে, আর কী যেন ভাবে! ভাবতে গিয়ে বড় মানুষের মতো তারাও ভাবুক হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দু-একটা সাহসী পিচ্চি চুপিসারে দল বাঁধে মরিচখেকো পিপ্পির সঙ্গে। পিপ্পি বেগম তাদের হাতে-কলমে দেখায়, কেমন করে মরিচে কামড় বসাতে হয়। কেমন করে কুচকুচ-কুচুরকুচ কাটতে হয়। কিন্তু পুঁচকেগুলো মরিচে কামড় বসিয়েই ‘মা-গো, বা-বা-গো’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দুধ-চিনির বাটিতে গিয়ে পড়ে। একটু চিনি খায় আর চোখ-মুখ লাল করে ঝালের ধকল সামলাতে ওহ্-ওহ্-ওহ্ করতে থাকে।
সেদিন হলো কি, রানি পিঁপড়ার প্রধান সেনাপতি বীর বাহাদুর পিকতু তাঁর মেয়েকে মরিচে কামড় দেওয়াতে গেলেন।
আসলে মনে মনে তিনিও চেয়েছেন যে তাঁর মেয়েটাও পিপ্পি বেগমের মতো মরিচখেকো হয়ে উঠুক। তাই সেনাপতি তাঁর ছোট্ট মেয়ে মিপরাকে নানাভাবে মরিচে কামড় বসাতে বলেন। কিন্তু মেয়ে মরিচ ছোঁবেই না। শেষমেশ বাবার চোখ রাঙানি খেয়ে মরিচে যেই কামড় বসাল, অমনি ঘটে গেল আশ্চর্য কাণ্ডটা! মরিচে কামড় দিয়েই মিপরা ছাগলের মতো ম্যা-ম্যা করে চেঁচিয়ে পিঁপড়ারাজ্য মাথায় তুলল! তার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসে পিঁপড়াসমাজ। প্রধান দেহরক্ষীকে নিয়ে লাফিয়ে আসেন পিঁপড়া-রানি পিল পিল পিলুনিয়াও।
তিনি এসেই রাগ দেখিয়ে মাথার মুকুটটা খুলে ফেললেন। তারপর কাপড় গুটিয়ে নেমে পড়লেন রাস্তায়। নেমেই ঝালে উলুঝুলু করতে থাকা পিচ্চি মিপরাকে কোলে নিয়ে হাঁ করিয়ে মুখের ভেতর তিনটা ফুঁ দিয়ে দিলেন। চারদিকে সুনসান নীরবতা নেমে আসে। রানিও কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকলেন। একটু পর কোমরে হাত দিয়ে ফটোগ্রাফারের সামনে ‘পোজ’ দেওয়ার মতো দাঁড়িয়ে বলেন—
‘ছ্যাঁ-ছ্যাঁ-ছ্যাঁ, কী বিচ্ছিরি, কী বিচ্ছিরি! পিপ্পি নামের দুষ্টুটার পাল্লায় পড়ে বাচ্চা পিঁপড়েগুলো তো দিন দিন বখে যাচ্ছে! না-না, এ আর হতে দেওয়া যায় না। কই, এই দুষ্টুটার মা-বাবা কোথায়?’
পিপ্পির মা ভয়ে ভয়ে এসে মাথা নিচু করে রানিমার সামনে দাঁড়ান। রানি চোখ রাঙিয়ে পিপ্পি বেগমের মাকে বলেন, ‘মেয়েকে সময় থাকতে ঠিক করো। না হয় পিঁপড়ারাজ্যছাড়া করব। দিন দিন এভাবে চলতে থাকলে পিঁপড়াসমাজের মানসম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। ভেবে দেখেছ?’
রানিমা বকাঝকা করে যেতে না যেতেই পিপ্পি বেগমকে ঘরে ডেকে আনেন তার মা। রাগ-ক্ষোভ চেপে বলেন, ‘অ্যাই পিপ্পি, তুই কি ইঁদুর-বাঁদর নাকি? চোখের সামনে যা পাস তাতেই মুখ বসাস! চিনি, বাদাম রেখে মরিচ খাওয়া ধরেছিস কেন? বুঝিস না, এতে যে পিঁপড়াসমাজে কেলেঙ্কারি ঘটে যাচ্ছে!’
পিপ্পি কানে নেয় না মায়ের কথা। নিশ্চিন্ত একটা ভাব নিয়ে গরু-ছাগলের মতো তখনো মরিচের একটা অংশ মুখে নিয়ে জাবর কাটতে থাকে। মায়ের কথা যেন তার এক কান দিয়ে ঢোকে, আরেক কান দিয়ে সুড় সুড় করে বেরিয়ে যায়।
একটু পর, পিপ্পি মায়ের দিকে তাকিয়ে বাঁ কানটা চুলকাতে চুলকাতে বলে, ‘তুমি জানো না মা, মানুষেরা এখন চিনি-মধুর বোতলের ঢাকনা শক্ত করে লাগিয়ে রাখে। বোতলে ঢুকতে পারি না আমি। কী করে খাব চিনি। কী করে খাব মধু। কী করে খাব বিস্কুটের গুঁ-ড়ো-ও...।’ এই বলতে বলতে সে কোথায় যেন চলে যেতে থাকে!
No comments