মসজিদের শহর বারোবাজার by নূর ইসলাম
মসজিদের শহর বারোবাজার। যশোর শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কে বারোবাজারের অবস্থান।
অনেকে
স্থানীয়ভাবে এ শহরকে বারো আউলিয়ার শহর বলেও জানেন। এখানে রয়েছে গাজী কালু
আর চম্পাবতির মাজার। শহরের যে দিকে তাকাবেন সেদিকে চোখে পড়বে সারি সারি
মসজিদ। মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন এসব মসজিদ এখন দেশের
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত হচ্ছে। নিপুণ
কারুকার্যে নির্মিত এসব মসজিদ বর্তমানে দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
প্রতিদিন দেশী-বিদেশী হাজারো পর্যটক এসব মসজিদ দেখতে বারোবাজারে ভিড় করছেন।
আসছে তাবলিগ জামাতসহ ধর্মীয় বিভিন্ন বর্ণ ও গোষ্ঠীর লোকজন। বারোবাজারের
কয়েক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব মসজিদ এবং এর আশপাশের
বিশাল বিশাল পুকুর আর জলরাশি পর্যটকদের কাছে দিন দিন আকর্ষণীয় স্থান হয়ে
উঠছে। মসজিদকে ঘিরে বারোবাজারে গড়ে উঠেছে এক নান্দনিক পর্যটন শিল্প এলাকা।
আয়ের ব্যবস্থা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের। বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড, ধর্মীয়
বিভিন্ন উপকরণের বিকিকিনি, দোয়া-খায়ের করা, ধর্মীয় গান-বাজনার মাধ্যমে
অনেকেই এখানে খুঁজে পেয়েছেন জীবন-জীবিকার সন্ধান। অনেকে বাসা-বাড়ি ভাড়া
দিয়েও বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন। মসজিদকে ঘিরে গড়ে ওঠা এসব জলাশয়ে সারা
বছর হচ্ছে মাছের চাষ। সব মিলে বারোবাজার এখন একটি অর্থনৈতিক ও পর্যটন জোন
হিসেবে সারা দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে।
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম বারোবাজার। অন্য ১০টি ইউনিয়নের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। বারোবাজার স্থানীয়ভাবে এই অঞ্চলের বড় তরকারির পাইকারি মোকাম হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি এখানে প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার বসে পশুর হাট। এছাড়া এ অঞ্চলের মাছের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট এই বারোবাজার। রেল বিভাগ ও সড়ক বিভাগের জায়গায় বৈধ-অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শতাধিক মাছের আড়তে গড়ে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়। তবে এতো কিছুর পরও বারোবাজারের খ্যাতি অন্যভাবে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশে। আর তা হচ্ছে মসজিদের শহর হিসেবে। ইসলামী ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, বারোবাজার ও এর আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে রয়েছে কয়েকশ’ বছরের পুরনো শতাধিক মসজিদ। নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ এসব মসজিদ কারা কবে কিভাবে নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হিসাব মতে, এসব মসজিদ ইসলামের প্রাগৈতিহাসিক যুগের। বিশেষ করে মোগল আমলে যখন সব পাক ভারত উপমহাদেশের শাসনকর্তারা ছিলেন মুসলমান সেই সময়ে এ দেশীয় শাসকরা ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে পাড়া মহল্লায় এসব মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হিসাব মতে, বারোবাজারের এসব মসজিদের নির্মাণকাল ১৩শ’ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৩০০ সালের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর পশ্চিমা বিশ্বের ধর্মযাজকরা দলে দলে বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এদের মধ্যে বাগেরহাটের খানজাহান আলী, সিলেটের হযরত শাহ জালাল, চট্টগ্রামের শাহ পরাণ, হযরত গরীবুল্লাহ শাহ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের একাংশ খানজাহান আলীর নেতৃত্বে গৌড় ও সমতট এলাকায় পৌঁছান। গঙ্গার তীরঘেঁষে এসব ধর্মযাজক ঘাঁটি গাড়েন বারোবাজারে। পূর্বে এই শহরের নাম কি ছিল সে সম্পর্কে ইতিহাসে তেমন কোন তথ্য পাওয়া নো গেলেও গঙ্গার অববাহিকায় অবস্থিত এই জনপদ বহু আগেই সম্পদ আর সাংস্কৃতিতে ছিল সমৃদ্ধ। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে খান জাহান আলী তার কয়েকজন শিষ্যকে এ শহরে রেখে যান। অনেকে বলেন, এই দলে ছিলেন ১২ জন সুফি সাধক। যাদের নামে এই শহরের নাম পাল্টে বারোবাজার নাম করা হয়। আবার অনেকের মতে, বারোটি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে বারোবাজার শহরটির গোড়াপত্তন হয় বলে এর নামকরণ করা হয় বারোবাজার। আবার ভিন্নমতের একদল লোকের মত হলো, খুলনার বাগেরহাট থেকে গঙ্গার তীর পর্যন্ত এই বিশাল জনপদের মধ্যে যেসব জনবসতি বা স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা হাটবাজার ছিল তার মধ্যে বারো নম্বরটি হচ্ছে এই বারোবাজার। এই কারণে এখানকার নাম রাখা হয় বারোবাজার। তবে যে কারণেই হোক বারোবাজার নামের সঙ্গে যে ধর্ম প্রচারকদের সম্পর্ক ছিল তার বড় প্রমাণ হচ্ছে এই জনপদের মসজিদগুলো। প্রায় এক হাজার বছর আগে নির্মিত এসব কারুকাজখচিত মসজিদ আজও মাথা উঁচু করে মানুষকে তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সরজমিন বারোবাজার ও এর আশপাশের গ্রাম বেলাট. দৌলতপুর, মিঠাপুকুর, সাতগাছিয়া, বাদুরগাছা, বেদেডিহি, মাঠপাড়া, কলেজপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বাহারি কারুকাজ করা মসজিদগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কোনটি গ্রামের মধ্যখানে, কোনটি হাটের মাঝখানে, কোনটি দূরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের আবর্তে এসব মসজিদ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহায়তায় ঠিকঠাক করে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা নামাজ আদায় করছেন। তবে এসব বাহারি সব মসজিদের নামও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। কোনটি জোড় বাংলা মসজিদ, কোনটি গলাকাটা
মসজিদ, কোনটি ডাকবাংলো মসজিদ, কোনটি চোরকাটা মসজিদ, কোনটি হাজী মসজিদ, কোনটি আবার হিল্লা মসজিদ নামে পরিচিত। তবে ধারণা করা হয়, এসব নাম পরবর্তী প্রজন্মের দেয়া। এদিকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এসব মসজিদ প্রথমদিকে এ অঞ্চলের মানুষের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য যে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করতো তার প্রমাণ বড় বড় পুকুর, দিঘিগুলো। দর্শনীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি মসজিদের সামনে বা পেছনে রয়েছে একটি করে বিশালাকার
পুকুর। ধারণা করা হয়, যে সময় এসব মসজিদ তৈরি করা হয়েছিলো সে সময় এসব পুকুর থেকে মাটি কেটে ইট তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এগুলোকে পুকুরে রূপান্তরিত করে স্থানীয়দের পানীয় জলের সমস্যা সমাধান করা হয়। অনেকের মতে, বারোবাজার একটি ব্যবসা কেন্দ্র ছিল। ভৈরব আর কুমার নদের মিলিত ব-দ্বীপের অবস্থিত এই জনপদ বহু বছর আগেই ব্যবসার দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে বণিকদের কাছে বারোবাজার ছিল সুপরিচিত। সতীশচন্দ্র মিত্রের লেখা যশোর খুলনার ইতিহাস নামক গ্রন্থে এ তথ্যের সত্যতা মেলে। ফলে বারোবাজারে বহুকাল পূর্ব থেকেই লোকবসতি গড়ে ওঠে। ফলে এসব লোকের পানীয় জলের অভাব দূর করতে মুসলমান ধর্মযাজকরা প্রতিটি মসজিদের পাশে গড়ে তোলেন এক একটি বিরাট আকারের পুকুর। বিংশ শতাব্দীর আগে এসব মসজিদ ছিল স্থানীয়দের কাছে অপরিচিত। অনেকে জানতো না এসব স্থানে কোন মসজিদ আছে। তাহলে এসব মসজিদের সন্ধান কিভাবে পেলো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রকৌশলীরা? এমন প্রশ্নের জবাবে জোড়বাংলো মসজিদের ইমাম হাজী দরবেশ আলী জানালেন, ২০-২৫ বছর আগেও এসব জায়গায় উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি ছিল। ঢিবিগুলো গাছপালায় ভরা ছিল। সন্ধ্যার পর এসব ঢিবির দিকে কেউ আসতো না। অনেকের কাছে এসব ঢিবি ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে। ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে হঠাৎ করে বারো বাজারের পশ্চিম প্রান্তে একটি বিরাট উঁচু ঢিবির মাটি সরে গেলে ছোট ছোট ইটের টুকরো বের হয়ে আসে। আস্তে আস্তে মাটি সরিয়ে এলাকাবাসী একটি মসজিদের মিম্বরের সন্ধান পান। বারোবাজারে মসজিদ উঠেছে এমন খবর চাউর হয়ে পড়লে হাজার হাজার নারী-পুরুষ দলে দলে মসজিদ দেখতে ভিড় জমান। সে সময় এসব খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। ২-৩ বছর পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা বারোবাজারে আসেন। তারা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় বারোবাজার ও এর আশপাশের সব উঁচু উঁচু মাটির ঢিবিগুলো অধিগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত করেন। তারপর এগুলোতে শুরু হয় খনন কার্য। দীর্ঘ প্রায় ৮-১০ বছরএসব মাটির ঢিবি খুঁড়ে বের করা হয় নান্দনিক সব মসজিদ। ধারণা করা হয়, এই অঞ্চলে মুসলমানীয় শাসন ব্যবস্থার পতনের পর পাল রাজার শাসনামলে হিন্দু রাজারা এসব এলাকার শাসন ভার গ্রহণ করেন। হিন্দু জমিদারি আমলে মুসলমান শাসন ব্যবস্থার নিদর্শন মুছে ফেলার মানসে এসব মসজিদ উঁচু করে মাটির ঢিবিতে ঢেকে ফেলা হয়। পর্যায়ক্রমে এসব উঁচু মাটির ঢিবির ওপর লাগিয়ে দেয়া হয় গাছপালা। কালের আবর্তে মাটির ঢিবিগুলো জঙ্গলে পরিণত হয়। শত শত বছর এভাবে মসজিদগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকার কারণে এর নির্মাণশৈলীতে চিড় ধরে। অনেক মসজিদের ছাদ ধসে পড়ে। কোন কোন মসজিদের উপরি অংশ ভেঙে এর কাঠামো বদলে যায়। তবে অধিকাংশ মসজিদের দেয়াল ও কাঠামো এখনও অবিকল অবস্থায় রয়েছে। এদিকে মসজিদগুলো ফের আগের অবস্থায় ফিরে আসায় এই অঞ্চলের মুসলমান শাসকদের প্রভাব প্রতিপত্তির চিহ্ন আবারও মানসপটে ভেসে উঠতে শুরু করেছে।
প্রতিদিন এসব দর্শনীয় মসজিদ দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন হাজারো মানুষ। এসব মসজিদের পাশাপাশি ইতিহাসখ্যাত গাজী কালু চম্পাবতির মাজার রয়েছে এই বারোবাজারের পূর্বপাশে অবস্থিত বাদুরগাছায়। প্রতিদিন সুফি সাধক গাজী কালুর মাজারে বসে গানের মজমা। বিভিন্ন রোগ-শোকে মানুষ এই মাজারে মানত করে। সারা বছর এ মাজারকে ঘিরে চলে জমজমাট ব্যবসা। এছাড়া বারোবাজারের সব মসজিদকে ঘিরে এভাবে বহু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। চলছে পর্যটন শিল্পকে ঘিরে নানামুখী কর্মকাণ্ড। সব কিছু মিলে মসজিদের শহর বারোবাজার এখন এ অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম বারোবাজার। অন্য ১০টি ইউনিয়নের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। বারোবাজার স্থানীয়ভাবে এই অঞ্চলের বড় তরকারির পাইকারি মোকাম হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি এখানে প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার বসে পশুর হাট। এছাড়া এ অঞ্চলের মাছের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট এই বারোবাজার। রেল বিভাগ ও সড়ক বিভাগের জায়গায় বৈধ-অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শতাধিক মাছের আড়তে গড়ে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়। তবে এতো কিছুর পরও বারোবাজারের খ্যাতি অন্যভাবে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশে। আর তা হচ্ছে মসজিদের শহর হিসেবে। ইসলামী ফাউন্ডেশনের হিসাব মতে, বারোবাজার ও এর আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামজুড়ে রয়েছে কয়েকশ’ বছরের পুরনো শতাধিক মসজিদ। নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ এসব মসজিদ কারা কবে কিভাবে নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হিসাব মতে, এসব মসজিদ ইসলামের প্রাগৈতিহাসিক যুগের। বিশেষ করে মোগল আমলে যখন সব পাক ভারত উপমহাদেশের শাসনকর্তারা ছিলেন মুসলমান সেই সময়ে এ দেশীয় শাসকরা ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে পাড়া মহল্লায় এসব মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হিসাব মতে, বারোবাজারের এসব মসজিদের নির্মাণকাল ১৩শ’ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৩০০ সালের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর পশ্চিমা বিশ্বের ধর্মযাজকরা দলে দলে বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এদের মধ্যে বাগেরহাটের খানজাহান আলী, সিলেটের হযরত শাহ জালাল, চট্টগ্রামের শাহ পরাণ, হযরত গরীবুল্লাহ শাহ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের একাংশ খানজাহান আলীর নেতৃত্বে গৌড় ও সমতট এলাকায় পৌঁছান। গঙ্গার তীরঘেঁষে এসব ধর্মযাজক ঘাঁটি গাড়েন বারোবাজারে। পূর্বে এই শহরের নাম কি ছিল সে সম্পর্কে ইতিহাসে তেমন কোন তথ্য পাওয়া নো গেলেও গঙ্গার অববাহিকায় অবস্থিত এই জনপদ বহু আগেই সম্পদ আর সাংস্কৃতিতে ছিল সমৃদ্ধ। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে খান জাহান আলী তার কয়েকজন শিষ্যকে এ শহরে রেখে যান। অনেকে বলেন, এই দলে ছিলেন ১২ জন সুফি সাধক। যাদের নামে এই শহরের নাম পাল্টে বারোবাজার নাম করা হয়। আবার অনেকের মতে, বারোটি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে বারোবাজার শহরটির গোড়াপত্তন হয় বলে এর নামকরণ করা হয় বারোবাজার। আবার ভিন্নমতের একদল লোকের মত হলো, খুলনার বাগেরহাট থেকে গঙ্গার তীর পর্যন্ত এই বিশাল জনপদের মধ্যে যেসব জনবসতি বা স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা হাটবাজার ছিল তার মধ্যে বারো নম্বরটি হচ্ছে এই বারোবাজার। এই কারণে এখানকার নাম রাখা হয় বারোবাজার। তবে যে কারণেই হোক বারোবাজার নামের সঙ্গে যে ধর্ম প্রচারকদের সম্পর্ক ছিল তার বড় প্রমাণ হচ্ছে এই জনপদের মসজিদগুলো। প্রায় এক হাজার বছর আগে নির্মিত এসব কারুকাজখচিত মসজিদ আজও মাথা উঁচু করে মানুষকে তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সরজমিন বারোবাজার ও এর আশপাশের গ্রাম বেলাট. দৌলতপুর, মিঠাপুকুর, সাতগাছিয়া, বাদুরগাছা, বেদেডিহি, মাঠপাড়া, কলেজপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বাহারি কারুকাজ করা মসজিদগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কোনটি গ্রামের মধ্যখানে, কোনটি হাটের মাঝখানে, কোনটি দূরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের আবর্তে এসব মসজিদ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহায়তায় ঠিকঠাক করে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা নামাজ আদায় করছেন। তবে এসব বাহারি সব মসজিদের নামও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। কোনটি জোড় বাংলা মসজিদ, কোনটি গলাকাটা
মসজিদ, কোনটি ডাকবাংলো মসজিদ, কোনটি চোরকাটা মসজিদ, কোনটি হাজী মসজিদ, কোনটি আবার হিল্লা মসজিদ নামে পরিচিত। তবে ধারণা করা হয়, এসব নাম পরবর্তী প্রজন্মের দেয়া। এদিকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এসব মসজিদ প্রথমদিকে এ অঞ্চলের মানুষের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য যে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করতো তার প্রমাণ বড় বড় পুকুর, দিঘিগুলো। দর্শনীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি মসজিদের সামনে বা পেছনে রয়েছে একটি করে বিশালাকার
পুকুর। ধারণা করা হয়, যে সময় এসব মসজিদ তৈরি করা হয়েছিলো সে সময় এসব পুকুর থেকে মাটি কেটে ইট তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এগুলোকে পুকুরে রূপান্তরিত করে স্থানীয়দের পানীয় জলের সমস্যা সমাধান করা হয়। অনেকের মতে, বারোবাজার একটি ব্যবসা কেন্দ্র ছিল। ভৈরব আর কুমার নদের মিলিত ব-দ্বীপের অবস্থিত এই জনপদ বহু বছর আগেই ব্যবসার দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে বণিকদের কাছে বারোবাজার ছিল সুপরিচিত। সতীশচন্দ্র মিত্রের লেখা যশোর খুলনার ইতিহাস নামক গ্রন্থে এ তথ্যের সত্যতা মেলে। ফলে বারোবাজারে বহুকাল পূর্ব থেকেই লোকবসতি গড়ে ওঠে। ফলে এসব লোকের পানীয় জলের অভাব দূর করতে মুসলমান ধর্মযাজকরা প্রতিটি মসজিদের পাশে গড়ে তোলেন এক একটি বিরাট আকারের পুকুর। বিংশ শতাব্দীর আগে এসব মসজিদ ছিল স্থানীয়দের কাছে অপরিচিত। অনেকে জানতো না এসব স্থানে কোন মসজিদ আছে। তাহলে এসব মসজিদের সন্ধান কিভাবে পেলো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রকৌশলীরা? এমন প্রশ্নের জবাবে জোড়বাংলো মসজিদের ইমাম হাজী দরবেশ আলী জানালেন, ২০-২৫ বছর আগেও এসব জায়গায় উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি ছিল। ঢিবিগুলো গাছপালায় ভরা ছিল। সন্ধ্যার পর এসব ঢিবির দিকে কেউ আসতো না। অনেকের কাছে এসব ঢিবি ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে। ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে হঠাৎ করে বারো বাজারের পশ্চিম প্রান্তে একটি বিরাট উঁচু ঢিবির মাটি সরে গেলে ছোট ছোট ইটের টুকরো বের হয়ে আসে। আস্তে আস্তে মাটি সরিয়ে এলাকাবাসী একটি মসজিদের মিম্বরের সন্ধান পান। বারোবাজারে মসজিদ উঠেছে এমন খবর চাউর হয়ে পড়লে হাজার হাজার নারী-পুরুষ দলে দলে মসজিদ দেখতে ভিড় জমান। সে সময় এসব খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। ২-৩ বছর পরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা বারোবাজারে আসেন। তারা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় বারোবাজার ও এর আশপাশের সব উঁচু উঁচু মাটির ঢিবিগুলো অধিগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত করেন। তারপর এগুলোতে শুরু হয় খনন কার্য। দীর্ঘ প্রায় ৮-১০ বছরএসব মাটির ঢিবি খুঁড়ে বের করা হয় নান্দনিক সব মসজিদ। ধারণা করা হয়, এই অঞ্চলে মুসলমানীয় শাসন ব্যবস্থার পতনের পর পাল রাজার শাসনামলে হিন্দু রাজারা এসব এলাকার শাসন ভার গ্রহণ করেন। হিন্দু জমিদারি আমলে মুসলমান শাসন ব্যবস্থার নিদর্শন মুছে ফেলার মানসে এসব মসজিদ উঁচু করে মাটির ঢিবিতে ঢেকে ফেলা হয়। পর্যায়ক্রমে এসব উঁচু মাটির ঢিবির ওপর লাগিয়ে দেয়া হয় গাছপালা। কালের আবর্তে মাটির ঢিবিগুলো জঙ্গলে পরিণত হয়। শত শত বছর এভাবে মসজিদগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকার কারণে এর নির্মাণশৈলীতে চিড় ধরে। অনেক মসজিদের ছাদ ধসে পড়ে। কোন কোন মসজিদের উপরি অংশ ভেঙে এর কাঠামো বদলে যায়। তবে অধিকাংশ মসজিদের দেয়াল ও কাঠামো এখনও অবিকল অবস্থায় রয়েছে। এদিকে মসজিদগুলো ফের আগের অবস্থায় ফিরে আসায় এই অঞ্চলের মুসলমান শাসকদের প্রভাব প্রতিপত্তির চিহ্ন আবারও মানসপটে ভেসে উঠতে শুরু করেছে।
প্রতিদিন এসব দর্শনীয় মসজিদ দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন হাজারো মানুষ। এসব মসজিদের পাশাপাশি ইতিহাসখ্যাত গাজী কালু চম্পাবতির মাজার রয়েছে এই বারোবাজারের পূর্বপাশে অবস্থিত বাদুরগাছায়। প্রতিদিন সুফি সাধক গাজী কালুর মাজারে বসে গানের মজমা। বিভিন্ন রোগ-শোকে মানুষ এই মাজারে মানত করে। সারা বছর এ মাজারকে ঘিরে চলে জমজমাট ব্যবসা। এছাড়া বারোবাজারের সব মসজিদকে ঘিরে এভাবে বহু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। চলছে পর্যটন শিল্পকে ঘিরে নানামুখী কর্মকাণ্ড। সব কিছু মিলে মসজিদের শহর বারোবাজার এখন এ অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
No comments