রাজশাহী ধর্মসভার সেকাল-একাল by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
অনেক স্মৃতির ভারে ভবনগুলো এখন যেন ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ভবনের ভেতরে রয়েছে একটি মুদ্রণযন্ত্র। না, এটাকে যন্ত্র বললে কিছুটা ভুল হবে; বলতে হবে যন্ত্রের কঙ্কাল। সচল থাকার সময় এর নাম ছিল ‘তমোঘ্ন যন্ত্রালয়’, অর্থাৎ অন্ধকারের বিঘ্ন সরিয়ে আলোক প্রদানকারী। এই আলো ছড়ানো যন্ত্রের কঙ্কালটি ৬১ বছর ধরে বদ্ধ ঘরের অন্ধকারে পড়ে রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম রাজশাহী ধর্মসভা। শুরুতে নাম ছিল সদাশ্রম। সেটি ১৮৫৪ সালের কথা।
হেরিটেজ রাজশাহী এর সব তথ্য সংরক্ষণ করেছে। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকীর ভাষায়, সে সময় পথশ্রান্ত দরিদ্র মানুষ রাজশাহী শহরের ভেতর দিয়ে অন্য কোনো স্থানে যেতে রাত যাপন করলে তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সদাশ্রমে—এটাই ছিল সদাশ্রম প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। এই মহতী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাহেরপুরের জমিদার চন্দ্র শেখরেশ্বর রায়। এ জন্য তিনি বার্ষিক এই সদাশ্রমে ১২০ পাউন্ড করে দান করতেন। এখান থেকে গরিব মানুষকে নগদ টাকা, খাদ্য ও বস্ত্রের সাহায্য দেওয়া হতো।
১৮৫৯ সালে রাজশাহীতে যখন কলকাতাভিত্তিক ব্রাহ্মসমাজের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন এর বিপরীতে সনাতন হিন্দুত্ববাদী চেতনা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সদাশ্রম প্রকাশনার প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং সদাশ্রম বোয়ালিয়া ধর্মসভা এবং আরও পরে রাজশাহী ধর্মসভায় পরিণত হয়। তারা ১৮৬৬ সালে ঢাকা সুলভযন্ত্র থেকে তাদের ধর্মসভার একটি মাসিক মুখপত্র হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকা প্রকাশ করে। দীনেন্দ্র কুমার রায় তাঁর সেকালের স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন: ‘ভাঙা হরফে অতি অপ্রকৃষ্ট কাগজে হিন্দুরঞ্জিকা প্রকাশিত হইত। ধর্মসংক্রান্ত দুই-একটি মামুলি প্রবন্ধ ও নিলামী ইস্তেহার ছাড়া তাহাতে বিশেষ কিছু প্রকাশ হইত না।’
তবে ১৮৭২ সালে দুবলহাটির জমিদার হরনাথ রায়চৌধুরী রাজা উপাধি লাভ করেন। এরপর তিনি রাজশাহী ধর্মসভার অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে একটি মুদ্রণযন্ত্র কেনার জন্য এক হাজার টাকা দান করেন। সেই সঙ্গে তিনি ছাপাখানা নির্মাণের ব্যয়ভারও বহন করেন। তাঁর প্রদত্ত অর্থে রাজশাহী ধর্মসভাসংলগ্ন একটি বাড়িতে এটি স্থাপন করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘তমোঘ্ন যন্ত্রালয়’। মূলত তখন থেকেই হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকা রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হতো। কালের পরিক্রমায় হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকার পরিবর্তন ঘটেছিল। ক্রমেই গোঁড়ামি ভেঙে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। এর বিশেষ সংখ্যার বিষয়সূচিতে ‘প্রবাসী ভারতবাসীর কথা’, ‘কৃষিকর্মে অবজ্ঞার ভাব কেন’, ‘কাগজ’, ‘বেকার সমস্যা’, ‘গভর্নমেন্ট বনাম প্রাথমিক শিক্ষা’ প্রবন্ধগুলো জাতীয় স্বার্থের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে লেখা হয়েছিল।
রাজশাহী ধর্মসভার এই প্রকাশনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ‘হিন্দুরঞ্জিকা পূর্বাপেক্ষা অনেক পরিমাণ সংকীর্ণতার সীমা অতিক্রম করিয়া এক্ষণে উন্নতির পথে পদার্পণ করিবার যোগ্য হইয়া উঠেছে।’ পত্রিকাটি পরে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। অনেক দিন পর্যন্ত চলেছে। ১৯৫০ সালে কালীপূজার সংখ্যায় পত্রিকার সর্বশেষ সম্পাদক শক্তিভূতি চৌধুরী কালীপূজার সঙ্গে অমাবস্যার সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একপর্যায়ে লেখেন, ‘এখন যে দুঃসময় চলছে তা চিরদিন থাকবে না, এ আঁধার কেটে যাবে।’ উল্লেখ্য, ওই বছর পূর্ব পাকিস্তানের কোনো স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। সম্ভব এই কারণে, পত্রিকাটির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করার অভিযোগ ওঠে। সরকার পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করে। দীর্ঘ ৮৫ বছর পর রাজশাহী ধর্মসভার এই মুখপত্রের অপমৃত্যু ঘটে।
এর অনেক দিন পর সনাতন ধর্মসংঘ নামের একটি সংগঠন ধর্মসভায় দীর্ঘদিন তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। ১৯৯৬ সালের দিকে তারা এখান থেকে চলে যায়। এরই মধ্যে সেখানে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাজশাহী ধর্মসভার বর্তমান সভাপতি মহাদেব কর্মকারের কথায়, ধর্মসভা আসলে পূজা করার কোনো জায়গা নয়। এখানে ধর্মীয় আলাপ-আলোচনা, কীর্তন ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার কথা। কিন্তু কালক্রমে মনে হয়েছে, এখানে একটি মন্দির হলে ভালোই হয়। সেই থেকেই মন্দির চালু হয়েছে। গত ১৫ বছর ধরে এর ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। আর ব্যবহার করা যায় না। এর পরিত্যক্ত আঙিনাটি বিভিন্ন পূজার সময় প্রতিমা তৈরির জন্য খুব অল্প টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়।
রাজশাহী নগরের মিঞাপাড়া এলাকায় ধর্মসভার পূর্ব পাশের একটি ঘরে এখনো লেখা রয়েছে তমোঘ্ন যন্ত্রালয়ের নাম। ঘরটিও রয়েছে অবিকল। ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেখানে ব্যবসা করছেন নগরের একজন ডেকোরেটর ব্যবসায়ী। সদাশ্রমের পরিত্যক্ত ভবনের পেছনে অনেকখানি জায়গা পড়ে রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম কোনায় রয়েছে একটি ইঁদারা। ১০০ বছরেরও বেশি আগে এর গায়ে লেখা হয়েছিল ‘ঈশ্বর প্রীতয়ে লোকহীতার্থায়’। লেখাটি অবিকল রয়েছে। শুধু আবর্জনায় ভেতরটা ভরে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান এখানে একটি ধর্মসভা কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য আড়াই কোটি টাকার একটি বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন সবার প্রত্যাশা, সুষ্ঠুভাবে এর নির্মাণকাজ শেষ হোক। প্রতিষ্ঠানটি আবার মানুষের হিতার্থে জেগে উঠুক।
১৮৫৯ সালে রাজশাহীতে যখন কলকাতাভিত্তিক ব্রাহ্মসমাজের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন এর বিপরীতে সনাতন হিন্দুত্ববাদী চেতনা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সদাশ্রম প্রকাশনার প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং সদাশ্রম বোয়ালিয়া ধর্মসভা এবং আরও পরে রাজশাহী ধর্মসভায় পরিণত হয়। তারা ১৮৬৬ সালে ঢাকা সুলভযন্ত্র থেকে তাদের ধর্মসভার একটি মাসিক মুখপত্র হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকা প্রকাশ করে। দীনেন্দ্র কুমার রায় তাঁর সেকালের স্মৃতিগ্রন্থে লিখেছেন: ‘ভাঙা হরফে অতি অপ্রকৃষ্ট কাগজে হিন্দুরঞ্জিকা প্রকাশিত হইত। ধর্মসংক্রান্ত দুই-একটি মামুলি প্রবন্ধ ও নিলামী ইস্তেহার ছাড়া তাহাতে বিশেষ কিছু প্রকাশ হইত না।’
তবে ১৮৭২ সালে দুবলহাটির জমিদার হরনাথ রায়চৌধুরী রাজা উপাধি লাভ করেন। এরপর তিনি রাজশাহী ধর্মসভার অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে একটি মুদ্রণযন্ত্র কেনার জন্য এক হাজার টাকা দান করেন। সেই সঙ্গে তিনি ছাপাখানা নির্মাণের ব্যয়ভারও বহন করেন। তাঁর প্রদত্ত অর্থে রাজশাহী ধর্মসভাসংলগ্ন একটি বাড়িতে এটি স্থাপন করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘তমোঘ্ন যন্ত্রালয়’। মূলত তখন থেকেই হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকা রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হতো। কালের পরিক্রমায় হিন্দুরঞ্জিকা পত্রিকার পরিবর্তন ঘটেছিল। ক্রমেই গোঁড়ামি ভেঙে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। এর বিশেষ সংখ্যার বিষয়সূচিতে ‘প্রবাসী ভারতবাসীর কথা’, ‘কৃষিকর্মে অবজ্ঞার ভাব কেন’, ‘কাগজ’, ‘বেকার সমস্যা’, ‘গভর্নমেন্ট বনাম প্রাথমিক শিক্ষা’ প্রবন্ধগুলো জাতীয় স্বার্থের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে লেখা হয়েছিল।
রাজশাহী ধর্মসভার এই প্রকাশনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ‘হিন্দুরঞ্জিকা পূর্বাপেক্ষা অনেক পরিমাণ সংকীর্ণতার সীমা অতিক্রম করিয়া এক্ষণে উন্নতির পথে পদার্পণ করিবার যোগ্য হইয়া উঠেছে।’ পত্রিকাটি পরে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। অনেক দিন পর্যন্ত চলেছে। ১৯৫০ সালে কালীপূজার সংখ্যায় পত্রিকার সর্বশেষ সম্পাদক শক্তিভূতি চৌধুরী কালীপূজার সঙ্গে অমাবস্যার সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একপর্যায়ে লেখেন, ‘এখন যে দুঃসময় চলছে তা চিরদিন থাকবে না, এ আঁধার কেটে যাবে।’ উল্লেখ্য, ওই বছর পূর্ব পাকিস্তানের কোনো স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। সম্ভব এই কারণে, পত্রিকাটির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করার অভিযোগ ওঠে। সরকার পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করে। দীর্ঘ ৮৫ বছর পর রাজশাহী ধর্মসভার এই মুখপত্রের অপমৃত্যু ঘটে।
এর অনেক দিন পর সনাতন ধর্মসংঘ নামের একটি সংগঠন ধর্মসভায় দীর্ঘদিন তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। ১৯৯৬ সালের দিকে তারা এখান থেকে চলে যায়। এরই মধ্যে সেখানে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাজশাহী ধর্মসভার বর্তমান সভাপতি মহাদেব কর্মকারের কথায়, ধর্মসভা আসলে পূজা করার কোনো জায়গা নয়। এখানে ধর্মীয় আলাপ-আলোচনা, কীর্তন ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার কথা। কিন্তু কালক্রমে মনে হয়েছে, এখানে একটি মন্দির হলে ভালোই হয়। সেই থেকেই মন্দির চালু হয়েছে। গত ১৫ বছর ধরে এর ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। আর ব্যবহার করা যায় না। এর পরিত্যক্ত আঙিনাটি বিভিন্ন পূজার সময় প্রতিমা তৈরির জন্য খুব অল্প টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়।
রাজশাহী নগরের মিঞাপাড়া এলাকায় ধর্মসভার পূর্ব পাশের একটি ঘরে এখনো লেখা রয়েছে তমোঘ্ন যন্ত্রালয়ের নাম। ঘরটিও রয়েছে অবিকল। ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেখানে ব্যবসা করছেন নগরের একজন ডেকোরেটর ব্যবসায়ী। সদাশ্রমের পরিত্যক্ত ভবনের পেছনে অনেকখানি জায়গা পড়ে রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম কোনায় রয়েছে একটি ইঁদারা। ১০০ বছরেরও বেশি আগে এর গায়ে লেখা হয়েছিল ‘ঈশ্বর প্রীতয়ে লোকহীতার্থায়’। লেখাটি অবিকল রয়েছে। শুধু আবর্জনায় ভেতরটা ভরে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান এখানে একটি ধর্মসভা কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য আড়াই কোটি টাকার একটি বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন সবার প্রত্যাশা, সুষ্ঠুভাবে এর নির্মাণকাজ শেষ হোক। প্রতিষ্ঠানটি আবার মানুষের হিতার্থে জেগে উঠুক।
No comments