গার্মেন্ট শিল্পে সঙ্কটঃ শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ
৩০ বছর আগে শুরু থেকেই গার্মেন্ট শিল্পে মুনাফা বা লাভ ছিল চোখে পড়ার মতো। এর চাক্ষুষ প্রমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে গার্মেন্ট মালিকদের জীবনযাত্রার উন্নতি। তাদের গাড়ি, বাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ স্বাভাবিক বিলাসিতাকে হার মানায়। রফতানিমুখী এ শিল্পখাতটির বিকাশও হয়েছে দ্রুত। এসব কিছুর পেছনের কারণগুলোর অন্যতম এদেশে সস্তা শ্রমের আধিক্য। অর্থাৎ কম মজুরিতে কাজ করা শ্রমিকরাই এ শিল্প বিকাশের অন্যতম শক্তি। তাদের আশা ছিল শিল্প বিকাশের সঙ্গে তাদের জীবনও বিকশিত হবে।
কিন্তু তা হয়নি, দুর্ভাগ্যজন হলেও এটাই সত্য। ফলে গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমঅসন্তোষ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখন রোজার মাঝামাঝি সময়ে এসে গার্মেন্ট মালিকরা বলছেন ৪০ ভাগ কারখানায় ঈদ বোনাস দেয়া যাবে না। প্রায় ২০ ভাগ কারখানায় বেতন নিয়েও অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছেন তারা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র জরুরি সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়েছে। সেখানে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের জন্য সরকারের কাছে আগামী ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকা সাবসিডি চাওয়া হয়েছে। অন্যথায় শ্রমিক অসন্তোষ সামাল দেয়া সম্ভব হবে না বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। বিজিএমইএ নেতারা মন্দা মোকাবিলায় চলতি বাজেটে রাখা ৫ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ থেকেই সাবসিডি চেয়েছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, মন্দা মোকাবিলায় ঢাকঢোল পিটিয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের কোনো কার্যকারিতাই নেই। এর বৈঠকও ডাকা হচ্ছে না। গত ৬ মাস ধরে যেসব অভিযোগের কথা সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়েছে তার কোনো সমাধান হয়নি। মন্দা মোকাবিলায় ঘোষিত থোক বরাদ্দ সম্পর্কেও সপষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। অথচ ইতোমধ্যে মন্দার কারণে ১০৭টি গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক। গত ৩ মাসেই ৯৯টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৩টি কারখানায় তালা লাগছে। জানুয়ারি থেকে গার্মেন্ট রফতানি কমতে কমতে জুনে এসে প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়ে গেছে। অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে মালিকদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববাজারে মূল্য পতন এবং দেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট এভাবে চলতে থাকলে বেশিরভাগ গার্মেন্ট কারখানাই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আগামীতে বিদেশি বাজার ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী চীন, ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম মন্দা মোকাবিলায় তাদের বসত্র ও পোশাক শিল্পের জন্য বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিলেও বাংলাদেশ সরকার এখনও তেমন কিছু করেছে বলে জানা যায়নি। এ অবস্থায় ঈদের আগে সরকারি সহায়তা পাওয়া না গেলে গার্মেন্ট শিল্পখাতে বিসেফারণোন্মুখ পরিস্থিতির আশঙ্কা বিপদের কারণ হতে পারে কথাটি উড়িয়ে দেবার নয়। দেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানিমুখী খাত হিসেবে গার্মেন্ট শিল্প কোনোভাবেই অবহেলার নয়। অথচ এ খাতে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কোনো সপষ্ট দিকনির্দেশনা ও পদক্ষেপ নেই। এ শিল্পে বিরাজমান সমস্যা, অব্যবস্থা দূর করা জরুরি হলেও সরকার যেন গা করছে না। গত জানুয়ারি থেকে আগষ্টের শেষ পর্যন্ত ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রায় ২শ'টির মতো কারখানায় শ্রমঅসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব নিয়ে মুখে অনেক কথা বলা হলেও সরকার কার্যকর কিছুই করেনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রোজা ও ঈদ উপলক্ষে শ্রমিকদের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করা না হলে তারা বসে থাকবে না। এজন্য অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তৎপর হতে হবে। তবে এ প্রসঙ্গে আমরা গার্মেন্ট মালিকদের দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ২০০৬ সালে পোশাক শিল্পে সর্বনিম্ন মজুরি ১৬৬২.৫০ টাকা ঘোষণা করা হলেও অনেক কারখানায় তা কার্যকর করা হয়নি। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ ও আইনসম্মত সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রেও সব কারখানা মালিক সচেষ্ট বলা যাবে না। ফলে শ্রমঘন এ শিল্পে একটি কারখানার অসন্তোষ সহজেই ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের অন্যান্য কারখানায়। আইনসম্মতভাবে শ্রমঅসন্তোষ মীমাংসার ব্যবস্থাও নেই বেশিরভাগ কারখানায়। ফলে দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অহরহই নানান অভিযোগ তুলেন অথচ কেন শ্রমআইন অনুযায়ী নির্বাচিত শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়া হয় না তার জবাব নেই তাদের কাছে। শ্রমিকদের বঞ্চিত করাই কি তাদের উদ্দেশ্য? বর্তমানে জীবনযাত্রার সঙ্কটের কথা নতুন করে বলার আপেক্ষা রাখে না। ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরিও এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেক কমে গেছে। এক হিসেবে ২০০৬ সালের ১৬৬২ টাকার বর্তমান মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০৫২ টাকা। এ টাকা দিয়ে শ্রমিকদের পক্ষে সংসার চালানো কতটা সম্ভব সেটা কারও বিবেচনায় আছে মনে হয় না। তার ওপর যদি ঈদের আগে বেতন-বোনাস অনিশ্চিত হয় তবে পরিস্থিতি কী হবে বলাই বাহুল্য। আমরা আশা করব, সময় থাকতেই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ও গার্মেন্ট মালিকরা যথাযথ উদ্যোগ নেবেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ৩০ বছরের পুরনো এ শিল্পে কখনই শ্রমিকরা স্বাভাবিকভাবে ঈদ করতে পেরেছেন এমন উদাহরণ খুব কম। অতএব, বর্তমান অবস্থায় শিল্পরক্ষার পাশাপাশি শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দাবি করে।
No comments