আলো-হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী' by মাহবুব তালুকদার
গুরুদেব অন্ধকারে যোগাসনে বসিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি ধ্যানমগ্ন নহেন। একটু আগে লোডশেডিং হইয়াছে বলিয়া চক্ষু মুদিয়া ধ্যানস্থ হওয়ার উপায় নাই। লোডশেডিংয়ে কিছু দেখা যায় না বলিয়া চোখ বন্ধ করার প্রয়োজন পড়ে না। অন্যদিকে চক্ষু না মুদিলে ধ্যানমগ্ন হওয়া সম্ভব নহে। এমতাবস্থায় গুরুদেব কি করিবেন, শিষ্য একদৃষ্টে তাহাই যেন অবলোকন করিতে সচেষ্ট হইল। তবে অন্ধকারে গুরুদেবের শরীরের ছায়াটিও সপষ্ট নহে।
ফলে এস্থলে অবলোকন শিষ্যের একপ্রকার ধারণামাত্র। গুরুদেব কহিলেন, রবীন্দ্রনাথ অতিশয় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি। তিনি তাহার দূরদৃষ্টি দিয়া আমাদের লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি সম্পর্কে পূর্বেই সম্যক ধারণা করিয়াছিলেন। কবিগুরুর আমলেও কি এইরূপ লোডশেডিং ছিল? শিষ্য জানিতে চাহিল। তৎকালে লোডশেডিং থাকুক বা না থাকুক, উহা নিতান্তই গৌণ। কবিগুরু আমাদের লোডশেডিং লইয়াই বেশি ভাবিত ছিলেন। রবীন্দ্রকাব্য পাঠ করিলে উহা হৃদয়ঙ্গম করা যায়। শিষ্য বিস্মিতকণ্ঠে বলিয়া ফেলিল, বলেন কী প্রভু! গুরুদেব শিষ্যের এহেন সন্দেহ ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করিলেন না। মৃদুস্বরে বলিলেন, কবিগুরু আমাদের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হককে লইয়াও একাধিক কবিতা রচনা করিয়াছেন। কিন্তু আমাদের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী তো কবিগুরুর মৃত্যুর বহু পরে- গুরুদেব শিষ্যের কথায় বাধা দিয়া ভর্ৎসনাপূর্বক কহিলেন, তোমাকে বহুবার মহাকবি বাল্মীকির কথা স্মরণ করাইয়াছি। রামের জন্মের বহু পূর্বে বাল্মীকির রামায়ণ লিখিত হইলে রবীন্দ্রনাথ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হককে লইয়া কবিতা লিখিতে দোষ কোথায়? কবিরা সবই পারেন। শিষ্য করজোড়ে নিবেদন করিল, মহাত্মন! আমার অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতা মার্জনা করিতে আজ্ঞা হয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে লইয়া কী কবিতা লিখিয়াছেন তাহা জানিলে কৃতার্থ হইব। গুরুদেব অন্ধকারে আবৃত্তি করিলেন : 'এ অন্ধকার ডুবাও তোমার অতল অন্ধকারে ওহে অন্ধকারের স্বামী। এসো নিবিড় এসো গভীর, এসো জীবন পারে আমার চিত্তে এসো নামি। এ দেহ মন মিলায়ে যাক, হইয়া যাক হারা ওহে অন্ধকারের স্বামী। বাসনা মোর বিকৃতি মোর আমার ইচ্ছাধারা ওই চরণে যাক থামি। নির্বাসনে বাঁধা আছি দুর্বাসনার ডোরে ওহে অন্ধকারের স্বামী সব বাঁধনে তোমার সাথে বন্দী করো মোরে ওহে আমি বাঁধন-কামী আমার প্রিয় আমার শ্রেয়, আমার হে পরম ওহে অন্ধকারের স্বামী, সকল ঝ'রে সকল ভ'রে আসুক সে চরম ওগো মরুক না এই আমি।' (টীকা : কবিতাটি কবিগুরু অন্ধকারে বসিয়া লিখিয়াছিলেন বলিয়া ধারণা হয়। তবে ইহা একটি জীবনবাদী আধ্যাত্মিক কবিতা। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রি. জে. (অব.) এনামুল হককে 'অন্ধকারের স্বামী' বলিয়া আখ্যায়িত করা যথার্থ হইয়াছে। কবিতায় বোঝা যায়, লোডশেডিংয়ের পরে ক্ষুব্ধ হইয়া কবি বলিয়াছেন, অন্ধকার নিবিড় গভীর হইয়া চিত্তে নামিয়া আসুক দেহ-মন উহার কারণে হারাইয়া যাক। অন্ধকারে কবির কি বাসনা, বিকৃতি বা ইচ্ছাধারা ছিল তাহা জানা যায় না। তবে ওইসব বাসনা অন্ধকারের স্বামীর চরণে যেন থামিয়া যায়। কবি আরও বলিতেছেন, অন্ধকার যেন তাহাকে দুর্বাসনার রজ্জুতে নির্বাসনে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। সব বাঁধনেই কবি মন্ত্রীর সহিত বাঁধা পড়িতে চাহেন, কারণ মন্ত্রীরও কিছু করিবার নাই, তাহারও হাত-পা বাঁধা। কবি সর্বশেষ বলিতেছেন, এহেন অন্ধকারের স্বামী বা বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীই তাহার প্রিয়, শ্রেয় ও পরম। সুতরাং লোডশেডিংয়ের পরে বিদ্যুৎ চিরতরে বন্ধ হইয়া চরম অবস্থার সৃষ্টি হউক এবং তাহাতে কবিরও মৃত্যু হউক। কবির এই শেষ উক্তি হইতে বোঝা যায়, মনে কত কষ্ট ও বেদনা লইয়া রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি রচনা করিয়াছিলেন।) গুরুদেবের ল্যাপটপে কবিতার টীকা পড়িয়া শিষ্য জিজ্ঞাসিল, মহাত্মন! কবিগুরু বাংলাদেশের লোডশেডিং লইয়া এত উদ্বিগ্ন ছিলেন কেন? প্রত্যুত্তরে গুরুদেব জানাইলেন, বাংলাদেশে বসিয়া কবিগুরু অনেক কাব্য রচনা করিয়াছেন। কিন্তু বাতি না থাকার কারণে তাহার অনেক কবিতা অাঁতুড়ঘরে প্রাণ হারাইয়াছে বা ভূমিষ্ঠ হইতে পারে নাই। সেই মর্মবেদনা লইয়া রবীন্দ্রনাথ লোডশেডিংয়ের কারণে বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান দুর্ভোগের কথা ভাবিয়া উদ্বিগ্ন হইতেন। বিদ্যুতের অভাবে এদেশের মানুষের দুর্ভোগের চিত্রটি তিনি দূরদৃষ্টিতে দেখিতে পাইতেন। হুজুর! আমার গোস্তাকি মাফ করিবেন, শিষ্য বলিল, ওই দুর্ভোগের চিত্রটি কিরূপ? গুরুদেব জানাইলেন, প্রথমত ঘড়ির কাঁটা একঘণ্টা আগাইয়া দিয়াও বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয় নাই। বরং লোডশেডিং আরও বাড়িয়াছে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুতের সাশ্রয় করিতে অফিসারদের স্যুট কোট পরিধান নিষিদ্ধ করা হইয়াছে। ভবিষ্যতে তাহাদিগকে গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় অফিস করিতে নির্দেশ দেওয়া হইলে বিস্ময়ের কারণ থাকিবে না। তৃতীয়ত, ইহাতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হইলে মোক্ষম অসত্র হিসাবে বিদ্যুতের দাম বাড়াইয়া উহা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নাগালের বাহিরে লইয়া যাওয়ার পরিকল্পনা থাকিতে পারে। মূল্যবৃদ্ধি করিয়া বিদ্যুৎ কেবল উচ্চবিত্তদের ব্যবহারের জন্য সীমিত রাখিলে লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন হইবে না। শিষ্য নির্বাক দৃষ্টিতে গুরুদেবের দিকে তাকাইয়া রহিল। যেন তাহার দৃষ্টির উপর অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে। গুরুদেব কহিলেন, এইবার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে লইয়া লেখা রবীন্দ্রনাথের আরেকটি কবিতা শুনাইতেছি। তিনি আবৃত্তি করিলেন : 'আর রেখ না অাঁধারে, আমায় দেখতে দাও। তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে দাও॥ কাঁদাও যদি কাঁদাও এবার, সুখের গ্লানি সয় না যে আর, নয়ন আমার যাক না ধুয়ে অশ্রুধারে- আমায় দেখতে দাও।' (টীকা : সমগ্র রবীন্দ্রকাব্য সম্ভারে ইহা সর্বাধিক করুণ কবিতা। রবীন্দ্রনাথ এতদিন বাঁচিয়া থাকিলে লোডশেডিংয়ের পর তাহার মনে যে অনুভূতি অনিবার্য হইত, কল্পনায় তাহা অনুভব করিয়া কবিগুরু কবিতাটি অগ্রিম রচনা করিয়া রাখিয়াছিলেন।) টীকা পাঠ করিয়া শিষ্য জিজ্ঞাসা করিল, স্যার! 'কাঁদাও যদি কাঁদাও এবার, সুখের গ্লানি সয় না যে আর' কথাগুলি কবিগুরু কেন লিখিয়াছেন? গুরুদেব মৃদুহাস্যভরে জানাইলেন, লোডশেডিংয়ের পূর্বে বিদ্যুৎ ছিল বলিয়া সেই স্মৃতিকেই সুখের গ্লানি বলিয়া কবিগুরুর মনে হইয়াছে। সুখের গ্লানি কাহার না চোখে কান্না আনিয়া দেয়? শিষ্য কহিল, চমৎকার! গুরুদেব কহিলেন, বিদ্যুতের জন্য মনঃকষ্ট লইয়া কবিগুরু আরও কবিতা লিখিয়াছেন। ইহা রবীন্দ্রনাথের আরেকটি দুঃখের কবিতা। অতঃপর গুরুদেব আবৃত্তি করিলেন : 'কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো! বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো॥ রয়েছে দীপ না আছে শিখা, এই কি ভালে ছিল রে লিখা- ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো।' (টীকা : এই কবিতায় কবিগুরু বাংলাদেশের জনগণের মর্মবেদনার অভিব্যক্তি করুণভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। কবিতাটিতে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত আছে। সরকার কোটি কোটি সাশ্রয়ী বাল্ব বিনামূল্যে বিতরণের কথা ভাবিতেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকিলে ওইসকল বাল্ব জ্বলিবে কী প্রকারে? এই বক্তব্যটি 'রয়েছে দীপ না আছে শিখা' পঙক্তিটিতে সুসপষ্ট। অন্ধকারের চাইতে মরণকেই কবির নিকট শ্রেয় মনে হইয়াছে। কারণ মৃত্যুর পরে অন্ধকার বা লোডশেডিং কাহাকেও সপর্শ করিতে পারে না।) শিষ্য বলিল, অসাধারণ কবিতা। কবিগুরুর একটি নহে, একাধিক নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। গুরুদেব কহিলেন, এইবার তোমাকে একটি ঘটনা শোনাইব। শিষ্য জানাইল, মহাত্মন! আমি উহা শুনিতে উৎকীর্ণ হইয়া অপেক্ষা করিতেছি। গুরুদেব কহিলেন : একদিন রাত্রিবেলা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাহার বিখ্যাত কবিতা 'ছবি' রচনা করিতেছিলেন। কবিতাটি কবিগুরু সবেমাত্র লেখা শুরু করিয়া দিয়াছেন : 'তুমি কি কেবল ছবি, শুধু পটে লিখা? ওই-যে সুদূর নীহারিকা যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়, ওই যারা দিনরাত্রি'... -এই পর্যন্ত লেখা হইতেই হঠাৎ বাতি নিভিয়া গেল এবং অন্ধকার কবিগুরুর চারপাশে ছড়াইয়া পড়িল। ওই মুহূর্তে কবিগুরু দিব্যদৃষ্টিতে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ব্রি. জে (অব.) এনামুল হককে দেখিতে পাইলেন। ফলে কবিতার পরবর্তী চরণটিতে বিদ্যুৎ মন্ত্রীর কথা স্মরণ করিয়া তিনি লিখিলেন, 'ওই যারা দিন রাত্রি/আলো-হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী'। গুরুদেবের কথা শুনিয়া শিষ্য জিজ্ঞাসিল, আলো হাতে আঁধারের যাত্রী কিভাবে চলে? মন্ত্রীর হাতে আলো আসিল কিভাবে? গুরুদেব স্মিতহাস্যে কহিলেন, হাতে আলো থাকার কথা শুনিয়া বিস্মিত হওয়ার কারণ নাই। বিদ্যুৎ না থাকায় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর হাতে কেহ হারিকেন ধরাইয়া দিয়াছে। সেই জন্য কবিগুরু হাতে হারিকেনের বদলে 'আলো-হাতে' লিখিয়াছেন। শিষ্য জিজ্ঞাসা করিল, মহাত্মন! ঘটনাটি কি সত্যি? গুরুদেব উদ্ভাসিত মুখে আবৃত্তি করিলেন- 'সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নয়।' লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
No comments