আত্মজীবনী থেকে কিছু কথা কিছু স্মৃতি by সৈয়দ আবদাল আহমদ
আমি রাজনীতি বুঝতাম না। রাষ্ট্রপতি জিয়াই আমাকে রাজনীতিতে এনেছেন। মানুষকে ও দেশকে ভালোবাসার পথ দেখিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির একটি বিষয় আমাকে পীড়া দেয়। সেটা হলো সততা ও নৈতিকতার অভাব। রাজনীতিতে এ দুটি গুণের প্রয়োজনীয়তা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে বলে মনে হয়। বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাড়া এখন রাজনীতি করা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নির্বাচন করতে গেলে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন।
সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মতো রাজনীতিতে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে-এ কথা স্বীকার করে নেয়া ভালো। যে কোনোভাবেই হোক, সম্পদ আহরণের মোহ অনেককে গ্রাস করেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য এম সাইফুর রহমান তাঁর লেখা 'কিছু কথা কিছু স্মৃতি' শীর্ষক আত্মজীবনীতে এ ধরনের রাজনীতির বিষয়সহ অনেক কিছুই তুলে ধরেছেন। গত একুশের বইমেলায় (২০০৯) হাক্কানী পাবলিশার্স থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। রাজনীতির প্রসঙ্গে তিনি লিখেন, নৈতিকতার অভাব কতটা গভীর হলে একজন রাজনীতিক তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী যে-ই হন, ট্যাক্স-ফ্রি গাড়ি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিতে পারেন? সততা ও নৈতিকতাকে অনেকে দুর্বলতা মনে করলেও একজন সৎ রাজনীতিকের যে নৈতিক দৃঢ়তা থাকে, তা অনেকের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায় না। আইন করে দুর্নীতি রোধ করা যায়, এ কথা আমি মনে করি না। তবে আমাদের দেশেও এমন অনেক সৎ রাজনীতিক আছেন, যাদের দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আমি আশাবাদী, দেশে সৎ ও দৃঢ়চেতা রাজনীতিকের সংখ্যা বাড়বে। আত্মজীবনীতে সাইফুর রহমান তার কর্মময় জীবনের নানা বিষয় ছাড়াও জানা-অজানা ঘটনা, বিশেষ করে রাজনৈতিক জীবনের অনেক কথাই অকপটে বলেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি একজন বড় মাপের নেতা ও মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে তিনি একজন সৎ, বিচক্ষণ, দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকে পে-কমিশনের সদস্য হিসেবে আমি জিয়াউর রহমানের সংসপর্শে আসি। তিনিও ওই কমিশনের একজন সদস্য ছিলেন। সাইফুর রহমান লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁকে খুব বিশ্বাস করেন। তবে বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ভুলগুলোও তিনি তুলে ধরেছেন। শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনা এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করে দেন। আসলে শেখ হাসিনা সবসময় এরশাদকে সমর্থন করেন। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য : ড. ইউনূস তার গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণাকে বিশ্বের অনেক দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়ে ড. ইউনূস শুধু নিজেই সম্মানিত হননি, বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছেন। কাজ করলে পুরস্কার পাওয়া যায়-ড. ইউনূস তার স্বাক্ষর রেখেছেন। সাইফুর রহমান লিখেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন করার চ্যালেঞ্জ তিনিই প্রথম গ্রহণ করেছেন। তিনিই প্রথম দেশে ভ্যাটপ্রথা চালু করেন। তিনি মনে করেন, যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁকে সরকারের উচ্চতর পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হয়নি। সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষিতে দেশ সম্পর্কে তিনি লিখেন, 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক হানাহানি না থাকলে, ঐক্য ও সমঝোতার রাজনীতি চালু থাকলে এ দেশটি এখন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা ভিয়েতনামের মতো দেশে পরিণত হতো। এখনও আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করছি। দেশের স্বার্থে এটা বন্ধ করা উচিত।' সাইফুর রহমান তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেছেন, মাত্র ৬ বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান। চাচা মোহাম্মদ সফি আমাকে পুত্রের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তার অপার স্নেহেই আমি বেড়ে উঠি। ছোটবেলায় আমাকে মাদ্রাসায় পড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু মায়ের অনিচ্ছায় আর মাদ্রাসায় পড়তে হয়নি। ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই করাচির মেট্রোপলিটন হোটেলে দুররে সামাদ বেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়। আমাদের পরিবারটি ছিল যৌথ প্রথার। ১০০ বছর ধরে এ প্রথা চলে আসছে। সাইফুর রহমানের ডাকনাম বস্তু মিয়া। বাল্যকালে গাছে ওঠার ব্যাপারে তাঁর বেশ সুনাম ছিল। তিনি লিখেন, 'বটগাছের নিচে বন্ধুদের সঙ্গে মার্বেল খেলার কথা এখনও মনে পড়ে। বাল্যকালে গাছে ওঠার ব্যাপারে আমার বেশ সুনাম ছিল। এক গাছ থেকে অন্য গাছে দোল খেয়ে যাওয়া আমার জন্য কোনো বিষয় ছিল না। গাছে উঠতাম ফল খাওয়ার জন্য। লাল পিঁপড়ার কামড়ে হাত-পা ফুলে যেত। গাছে ওঠা নিয়ে মায়ের কত বকুনি খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।' ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে করে তিনি লন্ডনে যান ব্যারিষ্টারি পড়ার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট হন। জাহাজে করে বিলেতে যাওয়ার সময় এডেন বন্দরে প্রথম কোকাকোলার স্বাদ গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে গুলশানে ৭০ হাজার টাকা বিঘায় জমি কেনেন এবং বার্মিজ আর্কিটেক্টের নকশা অনুযায়ী গুলশানে তাঁর বাড়িটি নির্মিত হয়। 'জালালাবাদ হাউস' নামে এটি পরিচিত। 'কিছু কথা কিছু স্মৃতি' বইয়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় সাইফুর রহমানের জবানিতে তুলে ধরা হলো। বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সম্পর্কে মূল্যায়ন : বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে একটি অস্বাভাবিক মিল আছে। নিজের মতের বাইরে কেউ কোনো কথা বললে তারা তা উপেক্ষা করে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যসহকারে। উভয় দলের মধ্যে অনেক বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি আছেন। কিন্তু কখনও অপমানিত হওয়ার আশঙ্কায় তারা বিশেষ কোনো কথা বলেন না। তাছাড়া দলীয় নেত্রীর কোপানলে পড়ে আবার কী পরিণতি হয়, এ আশঙ্কাও তাদের মধ্যে সবসময় ক্রিয়াশীল থাকে। ফলে দু'দলের মধ্যে সবসময় সুস্থ আলোচনা বা গভীরভাবে কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার পরিবেশ একেবারে নেই বললেই চলে। দু'নেত্রীর চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসা বক্তব্য বা কার্যধারা অনুসরণই হয়ে পড়েছে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রধান কাজ। দু'নেত্রীর পারসপরিক বিদ্বেষ ও শত্রুতার মনোভাব উভয় দলের নেতাকর্মীর মধ্যে এমনভাবে বিস্তারলাভ করেছে, যা থেকে বেরিয়ে আসা সত্যিই এক কঠিন কাজ। ফলে রাজনৈতিক পরিবেশ কলুষিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা? না, ওটা এখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আর নেই, অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ? ওটার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার ব্যবস্থা আমরা পাকাপোক্ত করে ফেলেছি। যোগ্যতা অনুযায়ী উচ্চতর মর্যাদায় দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাইনি : বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমিই দীর্ঘদিন কাজ করেছি, বারো বছরের বেশি। এটি বাংলাদেশে একটি রেকর্ড। এশিয়ার কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমনকি ইউরোপের কোনো দেশেও এমন রেকর্ড বিরল। এজন্য যে কেউ গর্ব করতে পারে। এটি আমার জন্য হতাশারও কারণ বটে। এ হতাশা দলীয় নেতৃত্বের জন্য। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী আমাকে সরকারের উচ্চতর মর্যাদায় দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেয়া হয়নি। তবে এ কথা ভেবে আমি স্বস্তি পাই যে, একদলীয় শাসন ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যোগ্যতার চেয়ে উত্তরাধিকার ও পারিবারিক প্রাধান্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রীর পদটা 'ফ্রন্ট বার্নিং ওভেন'-এর মতো। আমাদের মতো গরিব দেশে এ কাজটি 'নার্ভ শ্যাটারিং জব'-এর মতো। কারণে-অকারণে সরকারি ও বিরোধী দলের অনেকের কাছে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। আমি সৌভাগ্যবান যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার কোনো বড় রকমের মতপার্থক্য হয়নি। আমি উভয়ের কাছ থেকে মোটামুটি সমর্থন পেয়েছি। আমার সদিচ্ছা ও সততা নিয়ে তারা কখনও প্রশ্ন তোলেননি। আমি দীর্ঘ সময় অর্থমন্ত্রী ছিলাম। আমার সঙ্গে অনেকেই বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী রাজা-বাদশা হয়েছেন। এ বয়সে এসে আমার ভালোই লাগে বন্ধুদের দেখে। যেভাবে রাজনীতিতে পদার্পণ করলাম : পাকিস্তান আমলে পে-কমিশনের সদস্য হিসেবে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সংসপর্শে আসি। তিনি আমাকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তাব করেন। আমি সবিনয়ে অপারগতা প্রকাশ করি। বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকে পে-কমিশনের সদস্য হিসেবে আমি জেনারেল জিয়াউর রহমানের সংসপর্শে আসি। তিনিও ওই কমিশনের একজন সদস্য ছিলেন। এ পে-কমিশনের সদস্য হিসেবে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। আর্থিক বিষয়ে আমার তীক্ষ্ন দৃষ্টি ও সপষ্ট বক্তব্য জেনারেল জিয়া হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন। পরবর্তী পর্যায়ে জেনারেল জিয়া ও তার সত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার ও আমার সত্রীর একটি পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর আমাকে অনুরোধ করেন তাকে সহায়তা করার জন্য। তাকে আর্থিক বিষয়ে সহায়তা করতে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু সরকারে যোগদান করতে আমার আপত্তি ছিল। আমার আপত্তির মুখে তিনি দেশের কল্যাণের প্রশ্ন তুলে যুক্তি দেখালেন। সিএমএলএ থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় একদিন তিনি আমাকে বললেন, আমার সঙ্গে কাজ করতে রেডি থাকুন। কোনো 'না' শুনতে চাই না। এক সময় আমি তার সরকারে যোগ দিলাম এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার কঠোর দায়িত্বে নিয়োজিত হলাম। আর্থিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা আমাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে আনল। সাইফুর রহমান ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলসঙ্গীতের অনুরাগী। সময় পেলেই গান শুনতেন। বই পড়তেন। খেলাধুলা করতেন নাতি-নাতনিদের সঙ্গে। আত্মজীবনীতে তিনি আরও বলেছেন, 'ব্যক্তিগত ও সরকারি কাজে ছুটে বেড়িয়েছি বিরামহীনভাবে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। প্রায় সব আন্তর্জাতিক ফোরামে আমি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের অর্জিত সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছি।'
No comments