স্মরণ অধ্যাপক নোমান স্মরণে by অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা
নোমান সাহেব যখন রাজশাহী কলেজে ইংরেজির লেকচারার হিসেবে যোগ দিলেন তখন খুব সম্ভবত আমি এই কলেজে আইএসসি পড়ার পর্যায় (১৯৫১-৫৩) শেষ করছি অথবা বিএসসি শ্রেণীতে (১৯৫৩-৫৫) পড়ছি। 'খুব সম্ভবত' বলছি এই কারণে যে, আইএসসিতে ইংরেজি আমাদের পাঠ্য বিষয় ছিল এবং কলেজের ঐ বিষয়ের সকল অধ্যাপকের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে পরিচিত হয়েছিলাম। নোমান সাহেব তখন ঐ অধ্যাপকবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।
অর্থাৎ তিনি পরে ওখানে এসেছিলেন। সে জন্য তার সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশা ঘটেনি। কিন্তু আমাদের সময়ে রাজশাহী কলেজে একটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন সংস্কৃতি ছিল ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়ের মধ্যেই। কলেজের সকল শিক্ষক, তা তিনি যে বিষয়েরই হোন না কেন, আমাদের কাছে শিক্ষকেরই মর্যাদা পেতেন। অপরদিকে শিক্ষকরাও সকল ছাত্রকে সস্নেহ দৃষ্টিতে দেখতেন, সে কলা বা বিজ্ঞান কোন এলাকার তা বাছ-বিচার না করে। স্কুল থেকে কলেজের বৃহত্তর পরিবেশে এসে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলা থেকে আমাদের রক্ষা করতো ছাত্র-শিক্ষকের পারসপরিক এই টান। তাই আমরা তাদের দেখতাম, সালাম দিতাম, তাদের সম্পর্কে জানতে চাইতাম অনেক আগ্রহ নিয়ে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল আপনজনের মতোই। আমি যে সময়ে রাজশাহী কলেজের ছাত্র সে সময়ে বেশ কিছু তরুণ-শিক্ষক ঐ বিদ্যায়তনে এলেন, নোমান সাহেবও। একদিন বো-টাই পরা এক ব্যক্তিকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলাম, শুনলাম উনি ইংরেজির নতুন লেকচারার, মোহাম্মদ নোমান। কলেজের সব কিছুতেই যেন একটা বিরাটত্ব, একটা নতুনত্বের ছাপ দেখতে পেতাম। বো-টাই তেমনি। বো-টাই পরে নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করার একটা অহংবোধ তার মধ্যে ছিল কিনা জানি না, কিন্তু তার চেহারায় যা লক্ষণীয় ছিল তা তার শান্তসৌম্য-নিষ্কলঙ্ক একটা ছবি। নিতান্তই একজন শিক্ষকের মুখমন্ডল আর কি। পরবর্তীকালে যখন তাকে দেখেছি তখনও তার এ মূর্তির কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। তার সুদীর্ঘ চাকরি জীবনে দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে ঘুরে শেষে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অধ্যাপক নোমান অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তার সঙ্গে যোগাযোগ অনেকবারই, অনেক কারণে হয়েছে। মূলত আমি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলাম এ কারণে। ১৯৮৮ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। নতুন উপাচার্য নিয়োগের জন্য প্যানেল প্রস্তুতের উদ্দেশে আহূত সভা তিনি পরিচালনা করলেন সম্পূর্ণ নিরাসক্তভাবে। তিনি নিজেও ঐ পদের জন্য প্রার্থী হতে পারতেন, কিন্তু সে ব্যাপারে তার সামান্যতম আগ্রহও লক্ষ্য করা যায়নি। আমার মনে হয়েছে শিক্ষকতায় তিনি এসেছিলেন স্ব-ইচ্ছায়। তার সমসাময়িক সময়ে ইংরেজির ছাত্ররা অনেকেই শিক্ষকতায় না এসে বেশি লাভজনক পেশায় গিয়েছেন। তিনিও যেতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যাকে আমরা বড় পদ বলি সে পদের মোহ কোনো দিন তার ছিল বলে মনে হয়নি। সময় পরিক্রমায় কখনও কখনও প্রশাসনিক দায়িত্ব এসে পড়েছে, যে সব দায়িত্ব শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব দায়িত্বও তিনি পালন করে গেছেন সুচারুভাবে তো বটেই, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও। তাই যখন দেখি ১৯৭০ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে প্রেসিডেন্টের স্বর্ণপদক পাচ্ছেন বা ১৯৯৪ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২১শে পদক পাচ্ছেন তখন সেসব ঘটনা খুবই স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে। ১৯৯০-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সিনেট অধিবেশন থেকে আমার নাম উপাচার্য প্যানেলভুক্ত হয় সে সিনেটের সদস্য হিসেবে তিনি ঐ বিশেষ সভায় উপস্থিত ছিলেন। আমার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন বলে তার ভাইয়ের কাছে শুনেছি। একটি কথা প্রচলিত আছে যে, পুত্রের উন্নতিতে পিতা এক অপার অনাবিল আনন্দ উপভোগ করেন, একইভাবে ছাত্রকেও একজন শিক্ষক কোনোদিন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন না। উগ্র আধুনিতা আর বর্তমানের প্রচন্ড প্রতিযোগিতার যুগে এ ধরনের মূল্যবোধ নাকি সেকেলে বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে আশার কথা, কিছু কিছু চিরাচরিত মূল্যবোধ এখনও টিকে আছে বলেই সমাজ এখনও বাসযোগ। তিনি ভীষণ অসুস্থ শুনে ধানমন্ডির রেনাল ক্লিনিকে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি বাকশক্তি-রহিত। বুঝলাম এই শেষ। দিন দুয়েক পরে পত্রিকায় তার পরলোকগমনের খবর পড়লাম। আজ তাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য এ কয়টি ছত্র যখন লিখছি তা কেবল একটি কথা মনে করেই। তা হলো এই যে, নোমান সাহেব ছিলেন একজন শিক্ষক, পুরোপুরি একজন শিক্ষক, যাকে বলি একজন আদর্শ শিক্ষক, যে শিক্ষক কেবল তার শ্রেষ্ঠ অর্জন তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ দান করেই যান, কোনো কিছুর প্রতিদান পাবার আশা না করে। যিনি কোনোদিন কারো অমঙ্গল চিন্তা করেন না, জীবন ও জগত সম্পর্কে যার দৃষ্টিভঙ্গি নির্মোহ, সমাজ-প্রগতিতে যার আস্থা অবিচল এবং সর্বোপরি সততা আর ভদ্রতা যার ভূষণ।
No comments