যায় দিন ভালো যায় by আল মাহমুদ

শা-ভরসার মধ্য দিয়ে দিন কেটে যায়। সব সময় আশা করি, আজকের দিনটির চেয়ে আগামী দিনটি আমার জন্য ভালো যাবে। এরকম একটা বিবেচনা না থাকলে মানুষের জীবন চলতে পারে না। তবে আমি কোনো অবস্থাতেই হতাশ হই না। আমার বৃত্তি যেহেতু লিখে যাওয়া, সে কারণে লিখতে বসেই বিষয় নির্ধারণ করা আমার খানিকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কত কথাই মনে পড়ে। সব কথা তো আর লিখতে পারি না।


লিখতে গেলে কার্যধারণ ইত্যাকার যুক্তি এসে খানিকটা আবৃত করে রাখে। আমি অবশ্য যুক্তিবাদী লেখক নই; কিন্তু অযৌক্তিক বিষয় উত্থাপন করাও তো আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। অপরিতৃপ্ত লেখক বলে কথা আছে। আমি সম্ভবত সে দলেই পড়ি। একটা কথা কেউ জানবেন কিনা জানি না। লেখকের কোনো প্রকৃত সাহায্যকারী থাকে না। নিজের মনেই যুক্তি আসে। আবার অযৌক্তিকতাও এসে ভর করে। আমি মধ্যবর্তী মানুষ। মধ্যবর্তী লেখক। ভালো যেটা সেটা লিখতে লিখতে বিবেচনা করি এবং একই সঙ্গে ভালো নয় যেটা সেদিকে পা বাড়াই না। লিখতে গেলেই অনেক বন্ধু-বান্ধব এবং প্রিয়জনের মুখ এসে ভিড় করে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। কখন কাকে ঠকিয়েছি; কিন্তু আমার সঙ্গে নিঃশব্ধ সাক্ষাৎ ঘটলেও বুঝতে পারি আমার বিরুদ্ধে কিছু মানুষের অনুযোগ আছে। নালিশ আছে। এখন এসব নালিশ বা অভিযোগের যদিও কোনো জবাব সম্ভব নয়, তবু বুঝতে পারি আমি নিরপরাধ লেখক নই। অভিযোগ খন্ডন করা আমার সাধ্যে কুলোবে না ভেবে আমি চুপ করেই থাকি; কিন্তু নৈঃশব্ধ্য কোনো সমাধান নয়। কিছু বিষয় আছে যা যুক্তিতর্কে সমাধান হয় না। এ অবস্থায় কুযুক্তি এসে আমার মনকে ভারাক্রান্ত করে। আমি চেপে রাখি এবং কুযুক্তিতে জিতে যাওয়ার চেষ্টা করি না। কখনও মনে হয় যা যুক্তিসঙ্গত সেটা অবলম্বন করে হেরে যাওয়াও ভালো; কিন্তু আমি তো হারি না। দাঁড়িয়ে থাকি হারজিতের ময়দানে মধ্যবর্তী হয়ে। এটা আমার জন্য অস্বস্তিকর হলেও আমি অন্য কোনো পন্হা অবলম্বন করতে শিখিনি। এভাবে একটা আস্ত জীবন কাটিয়ে দেয়া সোজা নয়। যারা আমাকে একটি আত্মজীবনী লিখতে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন তারা কি অবস্থাটা উপলব্ধি করেন? না করলেও বক্তব্য তো তাদের জানিয়ে যাওয়া আমার জন্য উত্তম পন্হা। একদা আমি সব লড়াইয়েই জিততে চাইতাম; কিন্তু কিছুকাল ধরে বুঝতে পারছি কিছু বিষয় আছে যেখানে হেরে যাওয়াই মঙ্গল। হারতেও মনের জোর লাগে। যেখানে হেরে যেতে আমি একান্ত ইচ্ছুক, সেখানে চতুর্দিক থেকে হা হা রব তুলে কিছু প্রিয়জন আছে যারা আমার হারাটাকে মেনে নিতে চায় না। আমি অবশ্য এক বিব্রতকর অবস্থার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি। বোঝাতে চাই যে, আমার শক্তি-সামর্থ্য সবকিছু শুধু হারজিতের জন্য নয়। হারজিতের বাইরেও কবিদের একটা আশ্রয়স্থল আছে। সেটা হলো স্বপ্ন। আমি স্বপ্নে সত্য-মিথ্যায় জড়িত এক পরিস্থিতির মধ্যে নিঃশ্বাস টানতে পারি। পারি বটে! কিন্তু সেটা আমার জন্য অস্বস্তিকর। আমি হারতে চাই। হেরে যদি কাউকে বোঝানো যায়, আমি ন্যায়ের পক্ষে, স্বপ্নের পক্ষে তদুপরি আমি কবিত্বের পক্ষে তাহলে মনে হয় আমার দিকে অন্তত দু'একজন আত্মীয়-বান্ধব থমকে দাঁড়াবে। আমি সেটা চাই। আমি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে অনেকদিন বিচরণ করেছি। দেখেছি এটা হলো বিশুদ্ধ ভালোবাসার জগৎ। এখানে শঠতা এবং হীনম্মন্যতা মানুষকে বামন করে ফেলে। আমি এ অবস্থা থেকে সাহিত্যের জগৎকে স্বপ্নের জগতে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছি। আমাকে এর জন্য প্রশংসা পেতে হবে না। কারণ আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমার ভিত্তিভূমি এর মধ্যেই ভালোবাসার উপাদানে গঠিত হয়ে গেছে। যারা সৃজনশীল জগতের জন্য হা-হুতাশ করেন তারা ইচ্ছা করলে আমার ভালোবাসার এই ভিত্তিভূমিটি বাজিয়ে দেখতে পারেন। এখানে কোনো মিথ্যা নেই। হিংসা-বিদ্বেষ কিছু নেই। আছে পরসপরের মঙ্গল কামনা। আমিও যেহেতু একজন স্বপ্নচারী কবি, সে জন্য মানুষের মঙ্গল কামনাই আমার একান্ত গন্তব্য। আমি এ পর্যন্ত সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেক পরিশ্রম সাধ্য কাজ করেছি। এসবের স্বীকৃতি অজান্তেই এসে আমার গৃহে প্রবেশ করেছে-মেডেল হিসেবে, পদক হিসেবে। আমি বিব্রতবোধ করলেও এসব আমার প্রাপ্য বিবেচনা করেছি। সাজিয়ে রেখেছি তাকে। আমি পরিশ্রম করেছি; কিন্তু হাত বাড়িয়ে পারিশ্রমিক চাইনি। কেউ যদি এখন হাত টেনে নিয়ে আমার হাতে কোনো সোনার মেডেল দিয়ে বলে নিন, এটা অনেক আগেই আপনাকে দেয়া উচিত ছিল তখন আমি লজ্জিত হয়ে মাথা নুইয়ে শুধু কি দাঁড়িয়ে থাকব? প্রাপ্যটা নেব না? অবশ্যই আমার ন্যায়সঙ্গত স্বপ্নের পুরস্কার আমি আমার ডান হাতে আকর্ষণ করব। লেখক : কবি

No comments

Powered by Blogger.