দিনভর উৎকণ্ঠা রাতে বিক্ষোভ by শরিফুল হাসান
কাল রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কি হবে না—এ নিয়ে দিনভর উৎকণ্ঠায় ছিল নারায়ণগঞ্জবাসী। সন্ধ্যায় খবর ছড়িয়ে পড়ে, সেনাবাহিনী নামছে না। এর পরই শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। শহরের কেন্দ্রস্থল চাষাঢ়া, বালুর মাঠ, উকিলপাড়া, ২ নম্বর রেলগেটসহ বিভিন্ন স্থানে গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করে। প্রায় একই সময় শহরের পৌর শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজমুক্ত নারায়ণগঞ্জের’ দাবিতে ‘প্রতিবাদী আলোর মিছিল’ করেছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট।
সেনা মোতায়েন না হওয়ায় দুই মেয়র পদপ্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমুর আলম খন্দকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে অপর মেয়র পদপ্রার্থী শামীম ওসমানের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাস। রাতে শহরের হীরা মহলে তাঁর বাড়ির সামনে মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা গেছে। সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বারবার সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছিলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ দুই কমিশনার সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেননি। হয়তো গভীর কোনো ষড়যন্ত্র হয়েছে। যারা কালোটাকা ছড়িয়ে ভোট কিনতে চায়, যারা কারচুপি করতে চায়, তাদের এখন এসব অপকর্ম করতে সুবিধা হলো।’
শামীম ওসমানের ষড়যন্ত্রের কারণে সেনাবাহিনী নামানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে ডা. আইভী বলেন, ‘আমার প্রশ্ন, শামীম ওসমান আর্মিকে কেন ভয় পান? তিনি জনতাকে এত ভয় পান কেন?’ তিনি বলেন, ‘জনতার ওপর আমার আস্থা আছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ জানাব, আপনারা কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন।’
বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, সরকার-সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করার নীলনকশা চলছে। এটি তারই অংশ। এই নির্বাচন কমিশন নতজানু নির্বাচন কমিশন। তারা সরকারের তাঁবেদার। তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এখন থেকে যা কিছু হবে, তার দায় এই সরকারকে নিতে হবে।’
অপর দুই মেয়র পদপ্রার্থীর সেনা মোতায়েনের দাবি সম্পর্কে শামীম ওসমান আগে থেকেই বলে আসছিলেন, তাঁর কোনো দাবি নেই। জাতিসংঘ বাহিনী এলেও তাঁর কিছু যায়-আসে না।
গতকাল প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শামীম ওসমান সাংবাদিকদের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কিসের কারণে সেনাবাহিনী প্রয়োজন? কেন দুজন ওসিকে বদলি করা হলো? নারায়ণগঞ্জে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, কেন দুজন ওসি বদলি হলো?’
নারায়ণগঞ্জ সম্মিলিত নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব রফিউর রাব্বি রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সেনা মোতায়েন নিয়ে যা ঘটল, নারায়ণগঞ্জবাসী তাতে চরম ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, ‘৩০ তারিখ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারির বিরুদ্ধে নীতিনৈতিকতা ও মানবতার জয় হবে।’
দিনভর উৎকণ্ঠা: গতকাল ভোর ছয়টা থেকেই নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েনের কথা ছিল। কিন্তু সকাল ১০টা পর্যন্ত সেনাবাহিনী না আসায় নগরবাসীর মধ্যে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে।
বিষয়টি জানতে বেলা ১১টার দিকে শহরের ডাকবাংলোতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমানের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সকালের মধ্যে সেনাবাহিনী এসে আমার কাছে রিপোর্ট করার কথা। কিন্তু এখনো করেনি।’
দুপুর সাড়ে ১২টায় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তাঁর উদ্বেগের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও বাকি দুজন নির্বাচন কমিশনার ২৮ অক্টোবর সকাল ছয়টা থেকে সেনা মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের কোথাও এখন পর্যন্ত সেনা মোতায়েন হচ্ছে না কেন?’ জবাবে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, দুপুরে ঢাকায় এ নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বেরিয়ে তৈমুর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেনা মোতায়েন নিয়ে বারবার টালবাহানা হচ্ছে। আপনারা জানেন নারায়ণগঞ্জ একটি সন্ত্রাসের জনপদ। সেনা মোতায়েন না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’
গতকাল বিকেলে শহরে গণসংযোগকালে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘সেনাবাহিনী না এলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানাচ্ছি। তবে সেনাবাহিনী না এলেও নির্বাচনের মাঠ ছাড়ব না, শামীম ওসমানকে কোনো ছাড় দেব না।’
সেনা মোতায়েন না করায় আইভী ও তৈমুর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও শামীম ওসমান ছিলেন নিরুদ্বেগ। বিকেলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেনা মোতায়েন আমার কোনো দাবি নয়। তারা থাকা বা না থাকাতে আমার কিছু যায়-আসে না।’
সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের উদ্বেগ: বিকেল চারটায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ সাংবাদিকদের সঙ্গে জরুরি মতবিনিময় করে। পরিষদের সদস্য ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ সন্ত্রাসী, মাস্তানদের খপ্পর থেকে বাঁচতে চায়। সে কারণেই আমরা নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছি। নির্বাচন কমিশন সে দাবি মেনেও নিয়েছিল। আশা করব, নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।’
পরিষদের সদস্যসচিব রফিউর রাব্বি বলেন, ‘আমরা জানি সেনাবাহিনীর ১৯ ব্যাটালিয়ন নারায়ণগঞ্জে আসার জন্য প্রস্তুত ছিল। কী কারণে, কার নির্দেশে তারা আসছে না, আমরা বুঝতে পারছি না। একজন মেয়র পদপ্রার্থীর সাংসদ ভাই প্রকাশ্যে বলেছেন, ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবে। শামীম ওসমান জিতবে। সাধারণ মানুষ আজকের ঘটনার সঙ্গে ওই বক্তব্যের যোগসূত্র খুঁজছে।’
মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শেখ হায়দার আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শহিদুল্লাহ, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক হিমাংশু সাহা, জেলা ন্যাপের সভাপতি এ বি সিদ্দিক, শহর ন্যাপের সভাপতি আওলাদ হাসান, গণফোরাম নেতা মাহতাব আলী, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনউদ্দিন আহমেদ, সাম্যবাদী দলের হানিফুল কবির প্রমুখ।
শহরজুড়ে বিক্ষোভ: সেনা মোতায়েন হচ্ছে না বলে সন্ধ্যায় নিশ্চিত খবর বের হওয়ার পর শহরের চাষাঢ়া, উকিলপাড়া, ২ নম্বর রেলগেট, ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে জনতা। তারা সেনাবাহিনীর দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে।
সন্ধ্যা সাতটায় কয়েক শ মানুষ প্রেসক্লাবের সামনে এসে বিক্ষোভ করে ও স্লোগান দিতে থাকে। রাত নয়টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ চলে।
নির্বাচন কমিশনের চিঠি: সেনা মোতায়েন না করা প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে গতকাল নারায়ণগঞ্জে একটি ফ্যাক্সবার্তা পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, ‘শুক্রবার সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা থাকলেও তারা আসেনি। কমিশন মনে করছে, সেনাবাহিনী হয়তো আর আসবে না। এমতাবস্থায় কমিশন নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনা যাতে হতাশায় পরিণত না হয়, সে বিবেচনায় আমরা নির্বাচন করব। ইতিমধ্যে অতিরিক্ত র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা নারায়ণগঞ্জের ভোটারদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য কমিশন সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘ইতিমধ্যে একজন প্রার্থী জঙ্গি-নাশকতা সম্পর্কে লিখিত অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কমিশনের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। এ ধরনের প্রচারণার উদ্দেশ্য হলো ভোটারদের ভয় দেখানো। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হলে ওই প্রার্থীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শামীমের জিডি: নারায়ণগঞ্জে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করে বৃহস্পতিবার রাতে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন মেয়র পদপ্রার্থী শামীম ওসমান। জিডিতে বলা হয়েছে, নাশকতা করতে নারায়ণগঞ্জে ইতিমধ্যে জঙ্গিরা প্রবেশ করেছে। তারা শহরের আনাচ-কানাচে ঘোরাফেরা করছে।
সাংস্কৃতিক জোটের মিছিল: নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করায় ঘটনায় যখন নারায়ণগঞ্জজুড়ে বিক্ষোভ চলছিল, প্রায় একই সময় শহরের পৌর শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজমুক্ত নারায়ণগঞ্জের’ দাবিতে ‘প্রতিবাদী আলোর মিছিল’ করেছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট। এতে জোটের অধীন জেলার ২৮টি সংগঠনের সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষও অংশ নেন। মিছিলটি শহীদ মিনার থেকে প্রেসক্লাবের সামনে আসে।
রিটার্নিং কর্মকর্তার আশা: সেনা মোতায়েন না হলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান। রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সবাইকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, হয় সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, নয়তো নির্বাচন বন্ধ করা হবে।’
জেলা পুলিশ সুপার শেখ নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সিটি করপোরেশন এলাকার প্রবেশমুখে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের যা যা করার তা করব।’
শামীম ওসমানের ষড়যন্ত্রের কারণে সেনাবাহিনী নামানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে ডা. আইভী বলেন, ‘আমার প্রশ্ন, শামীম ওসমান আর্মিকে কেন ভয় পান? তিনি জনতাকে এত ভয় পান কেন?’ তিনি বলেন, ‘জনতার ওপর আমার আস্থা আছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ জানাব, আপনারা কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন।’
বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, সরকার-সমর্থিত প্রার্থীকে জয়ী করার নীলনকশা চলছে। এটি তারই অংশ। এই নির্বাচন কমিশন নতজানু নির্বাচন কমিশন। তারা সরকারের তাঁবেদার। তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এখন থেকে যা কিছু হবে, তার দায় এই সরকারকে নিতে হবে।’
অপর দুই মেয়র পদপ্রার্থীর সেনা মোতায়েনের দাবি সম্পর্কে শামীম ওসমান আগে থেকেই বলে আসছিলেন, তাঁর কোনো দাবি নেই। জাতিসংঘ বাহিনী এলেও তাঁর কিছু যায়-আসে না।
গতকাল প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শামীম ওসমান সাংবাদিকদের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কিসের কারণে সেনাবাহিনী প্রয়োজন? কেন দুজন ওসিকে বদলি করা হলো? নারায়ণগঞ্জে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, কেন দুজন ওসি বদলি হলো?’
নারায়ণগঞ্জ সম্মিলিত নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব রফিউর রাব্বি রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সেনা মোতায়েন নিয়ে যা ঘটল, নারায়ণগঞ্জবাসী তাতে চরম ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, ‘৩০ তারিখ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারির বিরুদ্ধে নীতিনৈতিকতা ও মানবতার জয় হবে।’
দিনভর উৎকণ্ঠা: গতকাল ভোর ছয়টা থেকেই নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েনের কথা ছিল। কিন্তু সকাল ১০টা পর্যন্ত সেনাবাহিনী না আসায় নগরবাসীর মধ্যে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে।
বিষয়টি জানতে বেলা ১১টার দিকে শহরের ডাকবাংলোতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমানের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সকালের মধ্যে সেনাবাহিনী এসে আমার কাছে রিপোর্ট করার কথা। কিন্তু এখনো করেনি।’
দুপুর সাড়ে ১২টায় বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তাঁর উদ্বেগের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও বাকি দুজন নির্বাচন কমিশনার ২৮ অক্টোবর সকাল ছয়টা থেকে সেনা মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের কোথাও এখন পর্যন্ত সেনা মোতায়েন হচ্ছে না কেন?’ জবাবে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, দুপুরে ঢাকায় এ নিয়ে বৈঠক হবে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বেরিয়ে তৈমুর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেনা মোতায়েন নিয়ে বারবার টালবাহানা হচ্ছে। আপনারা জানেন নারায়ণগঞ্জ একটি সন্ত্রাসের জনপদ। সেনা মোতায়েন না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’
গতকাল বিকেলে শহরে গণসংযোগকালে সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘সেনাবাহিনী না এলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানাচ্ছি। তবে সেনাবাহিনী না এলেও নির্বাচনের মাঠ ছাড়ব না, শামীম ওসমানকে কোনো ছাড় দেব না।’
সেনা মোতায়েন না করায় আইভী ও তৈমুর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও শামীম ওসমান ছিলেন নিরুদ্বেগ। বিকেলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেনা মোতায়েন আমার কোনো দাবি নয়। তারা থাকা বা না থাকাতে আমার কিছু যায়-আসে না।’
সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের উদ্বেগ: বিকেল চারটায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ সাংবাদিকদের সঙ্গে জরুরি মতবিনিময় করে। পরিষদের সদস্য ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ সন্ত্রাসী, মাস্তানদের খপ্পর থেকে বাঁচতে চায়। সে কারণেই আমরা নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছি। নির্বাচন কমিশন সে দাবি মেনেও নিয়েছিল। আশা করব, নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।’
পরিষদের সদস্যসচিব রফিউর রাব্বি বলেন, ‘আমরা জানি সেনাবাহিনীর ১৯ ব্যাটালিয়ন নারায়ণগঞ্জে আসার জন্য প্রস্তুত ছিল। কী কারণে, কার নির্দেশে তারা আসছে না, আমরা বুঝতে পারছি না। একজন মেয়র পদপ্রার্থীর সাংসদ ভাই প্রকাশ্যে বলেছেন, ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবে। শামীম ওসমান জিতবে। সাধারণ মানুষ আজকের ঘটনার সঙ্গে ওই বক্তব্যের যোগসূত্র খুঁজছে।’
মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শেখ হায়দার আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শহিদুল্লাহ, ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক হিমাংশু সাহা, জেলা ন্যাপের সভাপতি এ বি সিদ্দিক, শহর ন্যাপের সভাপতি আওলাদ হাসান, গণফোরাম নেতা মাহতাব আলী, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনউদ্দিন আহমেদ, সাম্যবাদী দলের হানিফুল কবির প্রমুখ।
শহরজুড়ে বিক্ষোভ: সেনা মোতায়েন হচ্ছে না বলে সন্ধ্যায় নিশ্চিত খবর বের হওয়ার পর শহরের চাষাঢ়া, উকিলপাড়া, ২ নম্বর রেলগেট, ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে জনতা। তারা সেনাবাহিনীর দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে।
সন্ধ্যা সাতটায় কয়েক শ মানুষ প্রেসক্লাবের সামনে এসে বিক্ষোভ করে ও স্লোগান দিতে থাকে। রাত নয়টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ চলে।
নির্বাচন কমিশনের চিঠি: সেনা মোতায়েন না করা প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে গতকাল নারায়ণগঞ্জে একটি ফ্যাক্সবার্তা পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, ‘শুক্রবার সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা থাকলেও তারা আসেনি। কমিশন মনে করছে, সেনাবাহিনী হয়তো আর আসবে না। এমতাবস্থায় কমিশন নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনা যাতে হতাশায় পরিণত না হয়, সে বিবেচনায় আমরা নির্বাচন করব। ইতিমধ্যে অতিরিক্ত র্যাব সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা নারায়ণগঞ্জের ভোটারদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য কমিশন সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘ইতিমধ্যে একজন প্রার্থী জঙ্গি-নাশকতা সম্পর্কে লিখিত অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কমিশনের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। এ ধরনের প্রচারণার উদ্দেশ্য হলো ভোটারদের ভয় দেখানো। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হলে ওই প্রার্থীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শামীমের জিডি: নারায়ণগঞ্জে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করে বৃহস্পতিবার রাতে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন মেয়র পদপ্রার্থী শামীম ওসমান। জিডিতে বলা হয়েছে, নাশকতা করতে নারায়ণগঞ্জে ইতিমধ্যে জঙ্গিরা প্রবেশ করেছে। তারা শহরের আনাচ-কানাচে ঘোরাফেরা করছে।
সাংস্কৃতিক জোটের মিছিল: নির্বাচনে সেনা মোতায়েন না করায় ঘটনায় যখন নারায়ণগঞ্জজুড়ে বিক্ষোভ চলছিল, প্রায় একই সময় শহরের পৌর শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজমুক্ত নারায়ণগঞ্জের’ দাবিতে ‘প্রতিবাদী আলোর মিছিল’ করেছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট। এতে জোটের অধীন জেলার ২৮টি সংগঠনের সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষও অংশ নেন। মিছিলটি শহীদ মিনার থেকে প্রেসক্লাবের সামনে আসে।
রিটার্নিং কর্মকর্তার আশা: সেনা মোতায়েন না হলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান। রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সবাইকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই, হয় সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, নয়তো নির্বাচন বন্ধ করা হবে।’
জেলা পুলিশ সুপার শেখ নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সিটি করপোরেশন এলাকার প্রবেশমুখে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের যা যা করার তা করব।’
No comments