মাদার তেরেসার সেবার আদর্শই বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম by আল্ ওয়াহিদ
যারা বলেন সমাজসেবা তথা মানবসেবা করতে হলে অনেক ধন-সম্পদ থাকা প্রয়োজন, তাদের কাছে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত মাদার তেরেসা। মাত্র পাঁচটি টাকা হাতে নিয়ে এবং মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সেবাময়ী নারী হিসেবে সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভে সক্ষম হয়েছেন। পৃথিবীর সব ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী তার কাছে একাকার হয়ে গেছে। 'ঈশ্বরের সেবা মানেই মানব সেবা' এই দীক্ষা যার অন্তরে দৃঢ়মূল আবদ্ধ হয়েছিল তিনি মানুষকে সত্যিকার অর্থে ভালোবেসে সেবা করেই পেয়েছিলেন মাদার তেরেসা উপাধি।
বিশ্বজননী বলে সারা বিশ্বের মানুষ তাকে মর্যাদা ও সম্মানে ভূষিত করেছেন। বিংশ শতাব্ধীর গোড়ার দিকেই মাদার তেরেসার জন্ম। বিশ্ব তখনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির করতলে বন্দি। একদা অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত আলবেনিয়ার স্কপজে (ঝশড়ঢ়লব) (বর্তমান মেসিডোনিয়ার রাজধানী) শহরে ১৯১০ সালের ২৬ আগষ্ট এক মধ্যবিত্ত পরিবারে মাদার তেরেসার (মূল নাম অ্যাগনিস গোনাস্কা বোজাঝিউ) জন্ম। তখন রাজধানী তিরানা থেকে দক্ষিণে গ্রিসের সীমান্তবর্তী শহরটির জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ হাজারের মতো। সেখানে তার শৈশব, কৈশোর ও প্রথম যৌবনের কিছুকাল অতিবাহিত হয়। মাত্র ৭ বছর বয়সেই পিতৃহারা মাদার তেরেসার পিতার নাম নিকোলাস বোজাঝিউ, তিনি ছিলেন স্কপজে শহরের বাড়ি নির্মাণের ঠিকাদার। দরিদ্রের প্রতি সদয়, সংস্কৃতিমনা ও উদার প্রকৃতির মানুষ। মা ড্রানাফিল বার্নাই ছিলেন ভেনিসের মেয়ে। অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা ও আদর্শ মাতার গুণাবলীতে সমৃদ্ধ ছিলেন তিনি। দুই বোন এক ভাইয়ের সংসারে তেরেসাই বড় ছিলেন। অসহায় দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সেবার মহৎ ইচ্ছা কিশোরী বয়স থেকে অন্তরে লালন করে ১৭ বছর বয়সে নিজ মহাদেশের স্বদেশ ভূমি ছেড়ে অন্য মহাদেশের ভারতভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তিনি। মানব সেবার নামে নির্লজ্জ শোষণ তথা সর্বোচ্চ সুদের ব্যবসা করে নয়, এমনকি সাম্রাজ্যবাদের প্রশংসা পেতে জঘন্য পদলেহনকারী দালাল হয়ে নয়, স্রেফ ঈশ্বরকে খুশি করতে তার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সেবায় আত্মোৎসর্গ করেই তিনি বিশ্বশান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তখন নোবেল কমিটি তার সেবার পন্হা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে বলেছিল-'নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করে তিনি এই পুরস্কারকেই ধন্য করেছেন।' আর মাদার তেরেসা বলেছিলেন-'আমি অসহায় দরিদ্র মানুষের নামেই এ পুরস্কার গ্রহণ করলাম।' শুধু তাই নয় নোবেল পুরস্কারের অর্থসহ সারা জীবনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পুরস্কারগুলোর সমুদয় অর্থই তিনি ব্যয় করেছেন ভারতসহ পৃথিবীর অসহায় পীড়িত ও দরিদ্র মানুষের সেবায়। কুষ্ঠরোগী, যক্ষ্মারোগী ও ক্যান্সারে আক্রান্ত মৃত্যু পথযাত্রীদের পরম মাতৃস্নেহে কোলে তুলে নিয়ে মায়ের মমতায় সেবা করেছেন, মুখে আহার ও ওষুধ তুলে দিয়েছেন। অসহায় মানুষের সেবার জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেছেন অমানুষিক পরিশ্রম ও কষ্ট সহ্য করে। অসহায় কুমারী মাতা ও অবাঞ্ছিত পথশিশুদের লালন-পালনের ভার আপন কাঁধে তুলে নিয়েছেন অবলীলায়। পৃথিবীর যেখানে যখন মানবতার বিপর্যয় ঘটেছে, তিনি সেখানেই ছুটে গিয়েছেন। প্রাকৃতিক তান্ডব ও যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদে মৃত্যু পথযাত্রীদের উদ্ধার করে তাদের সেবায় তার সহযোগীদের নিয়ে আত্মনিয়োগ করেছেন তিনি। ইরাক-মার্কিন যুদ্ধের বিরুদ্ধে দুই দেশের রাষ্ট্র প্রধানকে শান্তির আহ্বান জানিয়ে এবং যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে বার বার সংঘাতের পথ পরিহারের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কোনও প্রশংসা, লোভ বা কোনও বাধা তাকে তার মহান ব্রত থেকে কখনও বিচ্যুত করতে পারেনি। আজ পৃথিবীজুড়ে তারই প্রতিষ্ঠিত 'মিশন অব চ্যারিটি'তে প্রতিদিন লাখ লাখ অসহায়, পীড়িত ও দরিদ্র মানুষের অন্ন, বসত্র ও চিকিৎসার সংস্থান এবং শিশুদের উন্নত শিক্ষা-দীক্ষা লাভের সুযোগ হয়েছে। ১৯৪৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ট্রেনে দার্জিলিংয়ের পথে ঘুমের ঘোরে যিশুর স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত হয়ে তিনি এন্টালির সেন্ট মেরিজ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রায় শূন্য হাতেই নেমে আসেন চরম দরিদ্র-অসহায় রোগগ্রস্ত মানুষের সেবায়। শুধু হৃদয়ে মানব প্রেমের মহান প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে তিনি মমতাময়ী মাতৃরূপে ভারতের কলকাতা, বারাসাত, আসানসোলের অলিতে-গলিতে, বস্তিতে, ফুটপাতে কুড়িয়ে বেড়িয়েছেন অসহায় মানব সন্তানদের। নিজহাতে পরম স্নেহে সেবা করেছেন তাদের, যেন যিশুর সেবা করছেন সেই মনোভাব নিয়ে। বাংলাদেশেও এসেছেন একাধিকবার। অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বাংলার জনপদে ছুটে এসেছেন অসহায় বিপর্যস্ত মানুষের সেবায়। সারা জীবন বাঙালি নারীর আদর্শ পোশাক নীল পেড়ে সাদা সুতির শাড়ি পরেই বাঙালির বেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। মনে-প্রাণেই তিনি বাংলাকে ভালোবেসেছিলেন। বাংলা ভাষায়ও চমৎকারভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন মাদার তেরেসা। শুধু ভারত নয়, মানবতার সেবায় ছুটে গিয়েছেন অনাহারী দারিদ্র্যপীড়িত ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তানসহ বিপন্ন বহু জনপদে, যেন তার সন্তানদের সেবা করতে মায়ের মমতা নিয়ে তিনি আবির্ভূত। পৃথিবীতে মানব সেবার ইতিহাসে মাদার তেরেসার ত্যাগ শুধু বিরলই নয়, পরম মহিমান্বিত-প্রকৃত বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যা সর্বকালের, সর্ব ধর্মের মানুষের জন্য অনুসরণীয়। মাদার তেরেসা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিদিন পৃথিবীর একশ' কোটি লোক তাদের বিলাসী জীবনযাপনে যে পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের অপচয় করে থাকে তা দিয়েই পৃথিবীর দু'শ' কোটি অসহায় পীড়িত দরিদ্র মানুষের ভরণ-পোষণ, শিক্ষা ও চিকিৎসা সম্ভব। কাজের মূল্যায়নস্বরূপ তিনি ভারতের 'পদ্মশ্রী' পুরস্কার (জন্মসূত্রে প্রথম অভারতীয় হিসেবে এই পুরস্কারপ্রাপ্ত), ফিলিপিনস-এর রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কার, আন্তর্জাতিক পোপ ত্রয়োবিংশ পল পুরস্কার, জোসেফ কেনেডি (জুনিয়র) ফাউন্ডেশন পুরস্কার, নেহরু অ্যাওয়ার্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারষ্ট্যান্ডিং, টেম্পলটন পুরস্কার, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডক্টর অব ডিভিনিটি' উপাধি, ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান 'ভারতরত্ম' (জন্মসূত্রে প্রথম অভারতীয় হিসেবে প্রাপ্ত), ব্রিটেনের রানীর দেয়া সর্বোচ্চ সম্মান 'অর্ডার অব মেরিট', আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান কর্তৃক সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার 'মেডেল অব ফ্রিডম', বিশ্বশান্তিতে আন্তর্জাতিক নোবেল পুরস্কার, ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। পৃথিবীর কোনও পুরস্কার দিয়ে তো তার সঠিক মূল্যায়ন হয় না, যিনি মানুষের চরম দুর্দিনে যেমন চুয়াত্তরের মন্বন্তরে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে, মহামারিকবলিত জনপদে, কারফিউতে, যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর-নগরে, পঙ্গু-আহত ও ক্ষুধার্ত মানুষের কাতারে কাতারে ছুটে বেড়িয়েছেন সাধ্যমত সাহায্য নিয়ে। এত পুরস্কারের এত অর্থ অর্জন করেও তার ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে ছিল মাত্র তিনটি নীল পেড়ে সুতির শাড়ি, যার একটি তার সব সময় পরিহিত থাকত আর দুটি প্রয়োজনের জন্য সংরক্ষিত থাকত। নারী হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ পোশাক তার চেয়ে পৃথিবীতে আর কে পরতে পেরেছে-যা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নিজের অজান্তেই মাথা নত হয়ে আসে এই মানব দরদী মহাপ্রাণ মানুষটির প্রতি। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এ মহান জ্যোতির্ময় মানবী পরলোক গমন করেন। মাদার তেরেসার যে মহান বাণীটি তিনি বেশি বেশি করে মানুষের মাঝে প্রচার করেছেন তা হলো- 'নীরবতার ফল প্রার্থনা প্রার্থনার ফল বিশ্বাস বিশ্বাসের ফল ভালবাসা ভালবাসার ফল সেবা সেবার ফল শান্তি।' লেখক : চেয়ারম্যান, সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড হিউম্যান রাইটস অব বাংলাদেশ
No comments