এখনই পরিকল্পিত পদক্ষেপ প্রয়োজন

দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের রেকর্ড গড়তে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি, সেই প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের দুঃখ আর বঞ্চনার যেন শেষ নেই। ভিটেমাটি বেচে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেও বিরূপ পরিস্থিতি আর নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের। অনেকে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরে আসেন। দুর্ভোগ আর দুর্ভাগ্য তাদের পিছু ছাড়ে না। গতকাল আমার দেশ-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে মালয়েশিয়া ফেরত বাংলাদেশী শ্রমিকদের দীর্ঘশ্বাসের কথাই জানা গেছে।


এখন নিয়মিতই মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশ বিমানসহ বিভিন্ন ফ্লাইটে সর্বস্ব হারানো শ্রমিকরা ফেরত আসছেন। ওয়ার্ক পারমিট অনুযায়ী চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সেখানে বিভিন্ন অজুহাতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করা হয়। এক পর্যায়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। পাসপোর্টসহ তাদের সব কাগজপত্র স্থানীয় মালিকের কাছে থাকায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও সক্ষম হন না তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হাইকমিশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে চিঠি চালাচালি করা হলেও ফল পাওয়া যায় না। মালয়েশিয়ান কোম্পানি বাংলাদেশী শ্রমিকদের পরিবর্তে অন্য দেশের শ্রমিকদের নিয়োগ দিচ্ছে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ৫ বছর বা এর বেশি সময় অবস্থানকারী বাংলাদেশী শ্রমিকদের রাখা হবে না। এ নিয়ম অবশ্য অন্য দেশের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। এ রকম অবস্থায় প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০০ বাংলাদেশী ট্যুরিষ্ট ভিসায় মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। সেখানে প্রথমেই তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হয় এবং খুব অল্প বেতনে কাজ দেয়া হয়। ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তাদের ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। সেখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশন এ ধরনের আটক বাংলাদেশীদের সংখ্যা ৫০০ বললেও প্রকৃত সংখ্যা এর প্রায় ১০ গুণ বলে ধারণা করা হয়। এ রকম অবস্থা শুধু মালয়েশিয়াতেই নয়, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে গমনকারী বাংলাদেশী শ্রমিকদেরও নানা ধরনের নির্যাতনের মুখে পড়তে হয় অহরহই। প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের দেখভালের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশনের দায়িত্বহীনতা ও অকর্মণ্যতা নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হলেও তাদের ঘুম ভাঙেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে কী করছে সেটা কেউ জানে না। তবে শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে সরকার খুবই আন্তরিক। সরকারের চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। আর বিদেশে শ্রমবাজার ধরে রাখতেও তারা সচেষ্ট। যদিও বাস্তব ক্ষেত্রে এ সবের সত্যতা মেলা ভার। ফলে প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্ভোগ আর নিঃস্ব অবস্থায় ফেরত আসার পাশাপাশি বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা দিন দিন কমছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগষ্টের শেষ পর্যন্ত আট মাসে মোট ৩ লাখ ২৭ হাজার ৩৫৯ জন বাংলাদেশী শ্রমিক বিদেশ গেছেন। গত বছর একই সময়-কালে এ সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৮ হাজার ৮০। অর্থাৎ বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের ফেরত আসার সংখ্যা বাড়ছে। গত বছরের প্রথম আট মাসে ফেরত এসেছিলেন ৩৭ হাজার ৫২২ জন আর এ বছর একই সময়ে ফিরে এসেছেন ৫৪ হাজার ৬৩২ জন। বছর শেষে এ সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিদেশ থেকে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ফেরত আসার ক্রমবর্ধমান সংখ্যার জন্য অনেকেই অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকেও দায়ী করছেন। আর দেশে বিক্রুটিং এজেন্ট বা আদম ব্যবসায়ীদের অসততা ও জালিয়াতির কথা বহু পুরনো। এ ক্ষেত্রে মুখে যাই বলা হোক না কেন শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কার্যকর তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে যা হয়েছে তাকে এক কথায় কলঙ্কজনক বলা যায়। সরকারের নাকের ডগায় হাজার হাজার নিরীহ বাংলাদেশী প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হলেও তাদের জন্য কিছুই করা হয়নি। প্রতারণাকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় তাদের সাহস বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এছাড়াও বিদেশি শ্রমবাজার ধরে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ হয়। এখানে তাদের রয়েছে চরম অবহেলা। তাই দক্ষ শ্রমশক্তি সৃষ্টিতে তারা ব্যর্থ। বিভিন্ন দেশে এখন দক্ষ শ্রমশক্তির চাহিদা বাড়ছে। অথচ এ ক্ষেত্রে সরকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। এক তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যে ৬২ লাখ ৬৫ হাজার ৯০৯ জন বাংলাদেশী শ্রমিক বিদেশে গেছেন, তার মধ্যে মাত্র ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯১০ জন দক্ষ আর সবাই অদক্ষ। এই অদক্ষ শ্রমিকরাই নানাভাবে প্রতারণা ও বঞ্চনার শিকার হয়। তাই জনশক্তি রফতানির ধস মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে এখনই পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, রিক্রুটিং এজেন্টদের কাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও বিদেশে শ্রমবাজার সৃষ্টিতে উদ্যোগী হওয়ার কোনো বিকল্প আছে বলে আমাদের জানা নেই। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার এখন যেভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তাতে সময়ক্ষেপণের বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এখনও উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুজে থাকলে রেমিট্যান্স প্রবাহে মহাবিপর্যয় এড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠবে।
 

No comments

Powered by Blogger.