বাংলাদেশের অর্থনীতির কিংবদন্তি সাইফুর রহমান by সাইফ ইসলাম দিলাল
এম সাইফুর রহমান বাংলাদেশের অর্থনীতির কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে ১২ বার বাজেট পেশ করে এ উপমহাদেশ তথা গোটা বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এ অনন্য গৌরবের অধিকারী হিসেবে নির্দ্বিধায় বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক বিষয়গুলোও ছিল তার নখদর্পণে। তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল অসামান্য।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সাফল্যের ইতিহাস খুঁজতে গেলে সাইফুর রহমানের নাম উচ্চারিত হবেই। বিএনপির হাত ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার অন্যতম রূপকার বা পুরোধা ছিলেন তিনি। দেশের অর্থনীতিতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংস্কার করেছিলেন সাইফুর রহমান। এসব সংস্কার করতে গিয়ে অন্যান্য দল তো বটেই, এমনকি নিজ দলের অনেকের অসন্তুষ্টি অর্জন করলেও তিনি তাতে কখনও পিছপা হননি। তিনি বাণিজ্য উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, ভাসমান মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা এবং ভ্যাটপ্রথা চালু করেন। আর এসব কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান প্রবৃদ্ধির অন্যতম স্থপতি ছিলেন সাইফুর রহমান। সুদীর্ঘকাল বাংলাদেশের অর্থনীতির কান্ডারি ছিলেন তিনি। আর এ সময়ে তাকে অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। সমালোচনার তীরও ছিল তার দিকে। কিন্তু এসব সমালোচনাকে সামাল দিয়ে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তিনি প্রমাণ করেছেন, সমালোচনার মুখেও কীভাবে একজন অর্থনীতিবিদকে কাজ করে যেতে হয়। আর এজন্য সমালোচনার পাশাপাশি প্রশংসা কুড়াতেও সক্ষম হন তিনি। তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ইমার্জিং টাইগার কিংবা বিশ্বের ১১টি দেশের মধ্যে অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশের বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসতে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। স্বাধীনতার পর মাত্র ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দেশ বাংলাদেশকে বর্তমানে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির দোরগোড়ায় নিয়ে যান তিনি। নানা চাপ ও অস্থিরতা সত্ত্বেও সামষ্টিক অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসেন তিনি। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের সর্বশেষ পিআরএসপি প্রণয়ন কিংবা তার আগের বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সাইফুর রহমানের কাজের ছাপ লক্ষণীয়। আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাইফুর রহমানের নাম। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট যেখানে ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার, সেখানে তিনি ২০০৬ সালে প্রায় ৬৯ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। তার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন এমন অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সাইফুর রহমান সবসময় সিদ্ধান্ত নিতেন দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে। এজন্য তাকে দলের মধ্যেও বিরাগভাজন হতে হয়েছিল; কিন্তু একজন দৃঢ়চেতা অর্থনৈতিক সংস্কারক হিসেবে তিনি ছিলেন তার সিদ্ধান্তে অটল। তিনি সত্য কথা বলতেন অকপটে। দেশ ও দেশের মানুষের অধিকারের কথা বলতেন অত্যন্ত জোরালোভাবে। সাইফুর রহমান প্রথমে জিয়াউর রহমান সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি প্রথম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বাজেট পেশ করেন। এরপর বিএনপি আরও দু'দফায় ক্ষমতায় আসে। তখনও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনি ১২ বার বাজেট পেশ করেন; তার মূল ভিত্তি ছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচির দিকনির্দেশনা এবং বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা অর্জন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১২তম বাজেট দিয়ে তিনি এক অনন্য রেকর্ড সৃষ্টি করেন। শ্রীলঙ্কার সাবেক অর্থমন্ত্রী বনি ডিমেলের ১১ বার বাজেট দেয়ার রেকর্ডর্ রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা তার বাজেট প্রণয়ন করার কৌশল দেখে তাকে বাজেট জাদুকর হিসেবে অভিহিত করেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা দু'দশকে দেয়া সাইফুর রহমানের ১২টি বাজেটের মূল্যায়ন করে বলেছেন, বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স বা ভ্যাটের জনক হলেন সাইফুর রহমান। অর্থমন্ত্রী থাকাকালে পঞ্চম সংসদে বাজেট ব্যবস্থায় ভ্যাট ব্যবস্থা চালু করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াও তারই চালু ভ্যাট পদ্ধতি বহাল রাখেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ নিয়ে কিছু সমালোচনা থাকলেও সার্বিকভাবে এটি ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ব্যক্তিজীবনে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউটেন্ট সাইফুর রহমান জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। অর্থ, পরিকল্পনা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন বিএনপি সরকারে প্রায় ১২ বছর। জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আবদুস সাত্তার ও দু'দফায় খালেদা জিয়া সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রায় ১৪ বছর সরকারে থাকা সাইফুর রহমানের নাম গত দু'দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমল থেকে শুরু করে নানা আলোচনা ও সমালোচনার মধ্যেও তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। সাইফুর রহমানের কর্মকান্ড মূল্যায়ন করে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির একজন পর্যবেক্ষক বলেন, সাইফুর রহমান যুগ পরিবর্তনের সাক্ষী বা ক্রান্তিকালের দ্বাররক্ষক। তিনি যখন বাজেট দেয়া শুরু করেন তখন আমাদের অর্থনীতি মূলত ছিল সরকারের পরিকল্পনাধীন (নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি)। সেখান থেকে সাইফুর রহমান অর্থনীতিকে মুক্তবাজারে উত্তরণ ঘটান। একই সঙ্গে তিনি দারিদ্র্য বিমোচন পদক্ষেপগুলো যাতে চলতে পারে সেটি নিশ্চিত করেন। তার সময় তিনি অর্থনীতিতে বিদেশিনির্ভরতা কমিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ বিদেশি অর্থ সাহায্যের নির্ভরশীলতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎসকে বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হয়। নিজস্ব সম্পদের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর নীতি প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। এক কথায় বলতে গেলে, সাইফুর রহমান পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলো দেখাশোনা করেছেন। অনেক বিরূপ পরিস্থিতি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তিনি। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরাট ধাক্কাও তিনি সামলেছেন। আর অর্থনীতির একজন দক্ষ মানুষ হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব গভর্নর্সের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘ এক দশকের স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের শাসন যুগ শেষ হওয়ার পর ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৮০ কোটি ডলার। আর ওই সময় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান সাইফুর রহমান। এর কয়েক বছরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৫০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। ১৯৯৬ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতা ছাড়ে তখন রিজার্ভ ছিল ২৫০ কোটি ডলার। ২০০১ সালে বিএনপি আবার যখন ক্ষমতায় আসে তখন রিজার্ভ ছিল ১০০ কোটি ডলার। ওই সময় জ্বালানি তেলসহ বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বাড়ার পরও তিনি রিজার্ভ ৩০০ কোটি ডলারে ধরে রাখতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা করার সৌভাগ্য হয়েছে মাত্র ১১ জন অর্থমন্ত্রীর। এর মধ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ৩ বার বাজেট ঘোষণা করেন। ১৯৭২-৭৩, '৭৩-৭৪ এবং '৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। এরপর আজিজুর রহমান মল্লিক চতুর্থ বাজেট অর্থাৎ ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ১৯৭৬-৭৭, '৭৭-৭৮, '৭৮-৭৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন জিয়াউর রহমান। এরপর ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরের অর্থাৎ অষ্টম বাজেট ঘোষণা করেন এম নূরুল হুদা। এম সাইফুর রহমান বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা করেছেন সবচেয়ে বেশি, ১২ বার। ১৯৮০-৮১ এবং ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন তিনি। এরপর এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮২-৮৩ এবং ১৯৮৩-৮৪ সালের বাজেট ঘোষণা করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। এরপরের টানা চার বছর অর্থাৎ ১৯৮৪-৮৫, '৮৫-৮৬, '৮৬-৮৭ ও '৮৭-৮৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন এম সাইদুজ্জামান। এরপরের বছরের বাজেট ঘোষণা করেন মেজর জেনারেল (অব.) এমএ মুনিম। ১৯৮৯-৯০ সালের বাজেট ঘোষণার জন্য কানাডা থেকে আনা হয় ড. ওয়াহিদুল হককে। এরপর এরশাদ সরকারের শেষ বাজেট অর্থাৎ ১৯তম বাজেট ঘোষণা করেন মেজর জেনারেল (অব.) এমএ মুনিম। নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের পর বিএনপি সরকারের আমলে টানা ৫ বছর অর্থাৎ ১৯৯১-৯২ থেকে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট ঘোষণা করেন এম সাইফুর রহমান। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৬-৯৭ থেকে ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত টানা ৬ বছর বাজেট ঘোষণা করেন শাহ এএমএস কিবরিয়া। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর চারদলীয় জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে সাইফুর রহমান আবারও টানা পঞ্চমবারের মতো বাজেট ঘোষণা করেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও মহাজোট সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট ঘোষণা করেন।
No comments