ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের এবারও ভোগান্তির আশঙ্কাঃ এ নৈরাজ্য আর কতদিন
ঈদ এলে মানুষের পকেট নিংড়ে সব টাকা শুষে নেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে উন্মত্ত প্রতিযোগিতা শুরু হয়, পরিবহন খাতও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদে বাড়ি ফেরার সময় আসার আগেই ঘরমুখো যাত্রীদের সম্ভাব্য দুর্ভোগের আগাম বাদ্য বেজে উঠেছে। আমার দেশ-এর গতকালের খবর, ঈদে বাড়ি ফেরার আগাম টিকিট যেন সোনার হরিণের মতোই দুর্লভ হয়ে উঠেছে। তুলনামূলক কম ঝুট-ঝামেলায় যারা ঈদের আগে বাড়ি যেতে চান তারা বাস-লঞ্চের টিকিট সংগ্রহের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বিভিন্ন টার্মিনালে।
কিন্তু টিকিট হাওয়া হয়ে গেছে। আগাম বিক্রি শুরু হওয়ার আগেই ট্রেন ও বিআরটিসি বাসের বহু টিকিট 'বিশেষ ব্যবস্থায়' বুকিং হয়ে গেছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। এসব 'বুকিং' যে ভালো অংকের বাড়তি টাকার বিনিময়ে ঘটেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে মাত্র গতকাল এবং বিআরটিসির শুরু হবে ১৫ সেপ্টেম্বর। আবার কোনোরকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলগামী সব লঞ্চের কেবিনের আগাম টিকিট নাকি সব বিক্রি হয়ে গেছে। কাউন্টারে বাস ও লঞ্চের টিকিট না থাকলেও কালোবাজারে টিকিটের অভাব নেই। সদয় কালোবাজারিরা কোথাও কোথাও 'মাত্র' দ্বিগুণ দামে টিকিট বিক্রি করছে। এটা হচ্ছে পরিবহন খাতের মৌসুমী নৈরাজ্যের খন্ডচিত্র। যতই লেখালেখি এবং গলাবাজি হোক, একই চিত্র যে কোরবানির ঈদের সময়ও দেখা যাবে সে কথা এখনই বলে দেয়া যায়। অপরদিকে রাজধানী ঢাকার পরিবহন খাতে যে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে তা মৌসুমী কোনো ব্যাপার নয়। এ দুর্ভোগ প্রতিদিনের। গতকালের আমার দেশ-এ প্রকাশিত অপর এক খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার বাস, ট্যাক্সিক্যাব, রিকশা, রোগী পরিবহনের অ্যাম্বুলেন্স ও যাত্রী পরিবহনের অন্য যানবাহনে ভাড়া নিয়ে চলছে চরম নৈরাজ্য। যাত্রীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ছলেবলে কৌশলে নেয়া হচ্ছে গলাকাটা ভাড়া। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় সরকার তিন দফায় সিএনজি ও ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া কমালেও মালিক-চালকরা তা মানছেন না। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার কোনো তোয়াক্কা না করে তারা ইচ্ছামাফিক ভাড়া আদায় করছে যাত্রীদের কাছ থেকে। বিশেষ করে, সকালে অফিস শুরুর সময় এবং বিকেলে ও সন্ধ্যায় ইফতারের আগে কন্ডাক্টররা বাড়তি ভাড়া আদায়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে এসব ঝগড়ার পরিণতি হচ্ছে যাত্রীদের অসহায় আত্মসমর্পণ। এর সঙ্গে চলছে 'বাম পা আগে' ফেলার উপদেশ দিয়ে চলন্ত বাস-মিনিবাস থেকে যাত্রীদের প্রায় ঘাড় ধরে নামিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি। আমাদের সমাজ এখনও গ্রামকেন্দ্রিক। গরিষ্ঠসংখ্যক শহরবাসীর 'স্থায়ী নিবাস' হচ্ছে গ্রাম। শহরে বসবাসরত মানুষের এ সমাজ পুরোপুরি শহুরে হয়ে উঠতে কমপক্ষে আরও ৫০ বছর সময় লাগবে। তাই প্রতিবছর বিভিন্ন উৎসবে পার্বণে এবং কোন কারণে কয়েকদিন সরকারি ছুটি হলে গ্রামমুখী মানুষের ভিড় হবে, এটাই স্বাভাবিক। এই বাড়তি ভিড় সামাল দেয়ার মতো পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক এখনও আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সবাই যদি আইন ও শৃঙ্খলা মেনে চলে, বাস্তবতা বোধের পরিচয় দেয় এবং যাত্রীদের পকেট কাটার মোহ ত্যাগ করে তবে সঙ্কট অনেক সহনীয় হয়। ব্যাপারটা আপনা-আপনি ঘটে যাওয়ার নয়। এর জন্য দরকার সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ। সরকার যদি চাঁদাবাজির ভাগ সংগ্রহের পরিবর্তে কঠোরভাবে পরিবহন খাতের সবরকম অবৈধ ও অনৈতিক তৎপরতা রোধ করে তবে যাত্রীদের দীর্ঘশ্বাস অবশ্যই কমবে।
No comments