সুষুম নির্বাচন ক্ষমতায়িত স্থানীয় সরকারের শর্ত by মোজাফ্ফর আহমদ
আগামীকালবহুলআলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ত্রিপক্ষীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ নির্বাচন জাতীয় গুরুত্ব অর্জন করেছে। পেশিশক্তি ও কালোটাকার বিপরীতে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করার বিষয়টি যথেষ্ট আলোচিত। এই প্রেক্ষাপটে নাগরিক সমাজের তিনজন প্রতিনিধির মতামত প্রকাশ করা হলো। এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) নির্বাচন, বিশেষ করে মেয়র নির্বাচন মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের কাছে একটি বহুল আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন এবং এখানে প্রথম রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য সমর্থন পরিলক্ষিত হয়েছে। আমাদের সংবিধানপ্রণেতাদের ইচ্ছা ছিল, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হবে। এবার এর প্রকাশ্য ব্যত্যয় ঘটেছে।
প্রথমত, নির্দলীয় নির্বাচন হলে মানুষ নিরপেক্ষভাবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার একটা সুযোগ পায়। দলীয়ভাবে হলে মার্কায় ভোট দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এর ফলে তৃণমূলে নেতৃত্ব বিকাশের যে চিন্তা সংবিধানপ্রণেতারা করেছিলেন, সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হয়। বর্তমানে নাসিক নির্বাচন উপলক্ষে যে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার আবহ দেখা দিল, সেটি এ দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি রচনায় বিঘ্ন ঘটাবে বলে আমার ধারণা।
দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনে অনেক প্রার্থীরই অতীতের কর্মকাণ্ড, মামলা-মোকদ্দমা ও সঞ্চিত সম্পদের যে চিত্র ধরা পড়েছে, সেটি সন্ত্রাসমুক্ত স্থানীয় সরকার গঠনে সহায়ক নয়। এ জন্য প্রার্থিতার বেলায় বিধিনিষেধের ব্যাপারে আরও চিন্তাভাবনা করা দরকার।
তৃতীয়ত, নারায়ণগঞ্জের এবং সফল, সৎ, যোগ্য প্রার্থী মেয়র হিসেবে নিজের প্রার্থিতা বিনম্রভাবে তুলে ধরেছেন। বিপরীতে আমরা নেতা-নেত্রীর নামোচ্চারণ ও ক্ষমতার আস্ফাালন দেখতে পেয়েছি। নারীর ক্ষমতায়নের যে প্রতিশ্রুতি আমাদের সব রাজনৈতিক দল করে থাকে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এটা তাদের মানসিকতার বিচার হয়ে গেল বলে আমাদের ধারণা। নির্বাচনে ভোটারদের ভোট প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের মুক্ত মানসিকতার বিচার ঘটবে বলে আমাদের মনে হয়।
চতুর্থত, এখানে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন। নির্বাচন কমিশন কিছু কিছু ব্যবস্থা ও পদক্ষেপও নিয়েছে। সেটা কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তারও এক পরীক্ষা এই নির্বাচন। ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে দক্ষ, যোগ্য, নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। না হলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এই সূত্র ধরেই নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা, কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং নাগরিক সমাজের মতামত গ্রহণ প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
পঞ্চমত, এখানে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ভোট প্রদানের বেলায় ঘটছে। এ নিয়ে নানা মত শোনা গেছে। এই ভোটের মাধ্যমে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারব—এটা আশা করা যায়।
ষষ্ঠত, এখানে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দরকার দেখা গেছে এবং বেশির ভাগ প্রার্থী এর পক্ষে জোরেশোরে কথা বলেছেন। কিন্তু শেষ খবর হচ্ছে, সেনা মোতায়েন হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংস্থা। প্রশাসনিক যেকোনো সংস্থা একে সহযোগিতা করতে বাধ্য। ভারতেও নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাসহায়তা নেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ। কাউন্সিলর পদেও বেশ কয়েকজন প্রার্থীদাঁড়িয়েছেন, যাঁদের সন্ত্রাসী অতীত রয়েছে। একজন মেয়র পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে এবংতাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। এই অবস্থা বিবেচনা করেই নির্বাচন কমিশন চার কোম্পানি সেনাসদস্যচেয়েছিলেন। এখানে সেনা-সহায়তার ব্যবস্থা না হওয়ার অর্থ স্থানীয়সরকার নির্বাচন আইনের লঙ্ঘন। এতে করে যদি ভোটবাক্স ছিনতাই-হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা হয়, তার দায়িত্ব ভোটাররা ও নির্বাচন কমিশনের নয়, কারণ তাঁরা তো আশঙ্কা জানিয়েছিলেনই। সার্বিক দায়দায়িত্ব তখন বর্তাবে সরকারের ওপর।
নারায়ণগঞ্জের নাগরিকেরা এই নির্বাচনে যেসব দাবি তুলেছেন, তা থেকে প্রতীয়মান হয়, স্থানীয় সরকারকে আরও ক্ষমতায়িত করা প্রয়োজন, তাঁদের বর্তমান কার্যপরিধি প্রয়োজনের তাগিদে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। আমরা বিকেন্দ্রীকৃত উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নের যেসব উচ্চারণ শুনেছি, সেগুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এবং স্থানীয় সরকারের জবাবদিহি কেবল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে নয়। জনসাধারণ ও নাগরিকদের কাছে এই জবাবদিহি কায়েম করা অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতেও মিডিয়া এবারের মতো সক্রিয়ভাবে তথ্য-উপাত্ত ও অনুসন্ধান চালু রাখবে।
উল্লেখ্য, এরই মাঝে কিছু পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে। সেগুলো মিডিয়ার প্রয়োজনীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। আমি নারায়ণগঞ্জের সুশৃঙ্খল নির্বাচন এবং সৎ, যোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তির বিজয় কামনা করি।
মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ; সভাপতি, সুজন।
প্রথমত, নির্দলীয় নির্বাচন হলে মানুষ নিরপেক্ষভাবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার একটা সুযোগ পায়। দলীয়ভাবে হলে মার্কায় ভোট দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এর ফলে তৃণমূলে নেতৃত্ব বিকাশের যে চিন্তা সংবিধানপ্রণেতারা করেছিলেন, সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হয়। বর্তমানে নাসিক নির্বাচন উপলক্ষে যে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করার আবহ দেখা দিল, সেটি এ দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি রচনায় বিঘ্ন ঘটাবে বলে আমার ধারণা।
দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনে অনেক প্রার্থীরই অতীতের কর্মকাণ্ড, মামলা-মোকদ্দমা ও সঞ্চিত সম্পদের যে চিত্র ধরা পড়েছে, সেটি সন্ত্রাসমুক্ত স্থানীয় সরকার গঠনে সহায়ক নয়। এ জন্য প্রার্থিতার বেলায় বিধিনিষেধের ব্যাপারে আরও চিন্তাভাবনা করা দরকার।
তৃতীয়ত, নারায়ণগঞ্জের এবং সফল, সৎ, যোগ্য প্রার্থী মেয়র হিসেবে নিজের প্রার্থিতা বিনম্রভাবে তুলে ধরেছেন। বিপরীতে আমরা নেতা-নেত্রীর নামোচ্চারণ ও ক্ষমতার আস্ফাালন দেখতে পেয়েছি। নারীর ক্ষমতায়নের যে প্রতিশ্রুতি আমাদের সব রাজনৈতিক দল করে থাকে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এটা তাদের মানসিকতার বিচার হয়ে গেল বলে আমাদের ধারণা। নির্বাচনে ভোটারদের ভোট প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের মুক্ত মানসিকতার বিচার ঘটবে বলে আমাদের মনে হয়।
চতুর্থত, এখানে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন। নির্বাচন কমিশন কিছু কিছু ব্যবস্থা ও পদক্ষেপও নিয়েছে। সেটা কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তারও এক পরীক্ষা এই নির্বাচন। ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে দক্ষ, যোগ্য, নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। না হলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এই সূত্র ধরেই নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা, কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং নাগরিক সমাজের মতামত গ্রহণ প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
পঞ্চমত, এখানে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ভোট প্রদানের বেলায় ঘটছে। এ নিয়ে নানা মত শোনা গেছে। এই ভোটের মাধ্যমে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারব—এটা আশা করা যায়।
ষষ্ঠত, এখানে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দরকার দেখা গেছে এবং বেশির ভাগ প্রার্থী এর পক্ষে জোরেশোরে কথা বলেছেন। কিন্তু শেষ খবর হচ্ছে, সেনা মোতায়েন হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংস্থা। প্রশাসনিক যেকোনো সংস্থা একে সহযোগিতা করতে বাধ্য। ভারতেও নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাসহায়তা নেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ। কাউন্সিলর পদেও বেশ কয়েকজন প্রার্থীদাঁড়িয়েছেন, যাঁদের সন্ত্রাসী অতীত রয়েছে। একজন মেয়র পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে এবংতাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। এই অবস্থা বিবেচনা করেই নির্বাচন কমিশন চার কোম্পানি সেনাসদস্যচেয়েছিলেন। এখানে সেনা-সহায়তার ব্যবস্থা না হওয়ার অর্থ স্থানীয়সরকার নির্বাচন আইনের লঙ্ঘন। এতে করে যদি ভোটবাক্স ছিনতাই-হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা হয়, তার দায়িত্ব ভোটাররা ও নির্বাচন কমিশনের নয়, কারণ তাঁরা তো আশঙ্কা জানিয়েছিলেনই। সার্বিক দায়দায়িত্ব তখন বর্তাবে সরকারের ওপর।
নারায়ণগঞ্জের নাগরিকেরা এই নির্বাচনে যেসব দাবি তুলেছেন, তা থেকে প্রতীয়মান হয়, স্থানীয় সরকারকে আরও ক্ষমতায়িত করা প্রয়োজন, তাঁদের বর্তমান কার্যপরিধি প্রয়োজনের তাগিদে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। আমরা বিকেন্দ্রীকৃত উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়নের যেসব উচ্চারণ শুনেছি, সেগুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এবং স্থানীয় সরকারের জবাবদিহি কেবল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে নয়। জনসাধারণ ও নাগরিকদের কাছে এই জবাবদিহি কায়েম করা অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতেও মিডিয়া এবারের মতো সক্রিয়ভাবে তথ্য-উপাত্ত ও অনুসন্ধান চালু রাখবে।
উল্লেখ্য, এরই মাঝে কিছু পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে। সেগুলো মিডিয়ার প্রয়োজনীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। আমি নারায়ণগঞ্জের সুশৃঙ্খল নির্বাচন এবং সৎ, যোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তির বিজয় কামনা করি।
মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ; সভাপতি, সুজন।
No comments