ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়ছেঃ নিবিড় প্রস্তুতি প্রয়োজন
বিশ্বব্যাপী ভূ-কম্পনের সংখ্যা বাড়ছে। মৃদু ভূমিকম্পের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মৃদু-মাঝারি ভূ-কম্পন রেকর্ড করা হয়েছে। এই সংখ্যা বাড়ায় আপাতত আতঙ্কের কিছু না থাকলেও ভূ-প্রাকৃতিক লক্ষণ অনুসারে, বড় ধরনের ভূ-কম্পনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। পূর্বাভাস দেয়ার মতো কোনো নিশ্চিত পদ্ধতি উদ্ভাবিত না হলেও ভূতত্ত্ববিদ, বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ও গবেষকদের আশঙ্কা, যে কোনো সময় দেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।
এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে এখন থেকেই সম্ভাব্য সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। গত শুক্রবার সারাদেশে একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ছয়। ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪২৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। এতে জানমালের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। গত জুন মাস থেকে আগষ্ট পর্যন্ত তিন মাসে ঢাকার আগারগাঁও ভূ-কম্পন কেন্দ্রে রেকর্ড করা হয়েছে ৫২টি ছোট-বড় ভূ-কম্পন। ঢাকা থেকে চারশ' কিলোমিটারের মধ্যে আটটি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ভূ-কম্পনের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাকে এ অঞ্চলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের প্রাকৃতিক নির্দেশনা বলে মনে করছেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ১৯১৮ সালে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল বাংলাদেশে। এরপর ১১১ বছর পার হয়ে গেছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেছে ভূমিকম্পের ঝুঁকি। গত আগষ্ট মাসে ঢাকায় 'বাংলাদেশে ভূমিকম্পের পূর্বপ্রস্তুতি' শীর্ষক কর্মশালার এক জরিপ রিপোর্ট অনুসারে, রিখটার স্কেলে সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে শুধু রাজধানী ঢাকায়ই সোয়া লাখ মানুষের প্রাণহানি হতে পারে, সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ৭২ হাজারেরও বেশি ভবন। ঢাকার মতো বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে 'ন্যাচার' জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ঢাকা, কলকাতা ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে। এছাড়া ২০০৩ সালে জাতিসংঘ প্রণীত 'ভূমিকম্প বিপর্যয়ের ঝুঁকি সূচক' (আর্থকোয়েক ডিজাষ্টার রিস্ক ইনডেক্স-ইডিআরআই) রিপোর্টে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকার স্থান ছিল এক নম্বরে। এর একমাত্র কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, এখানকার বাড়ি-ঘরের মান ভালো নয়। রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ কম্পন তরঙ্গই ঢাকার ৪০ শতাংশ বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত করার জন্য যথেষ্ট। জাতিসংঘের রিপোর্টের মতোই দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ভয়াবহ বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। কারণ, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঘিঞ্জি ঘর-বাড়ি এবং এলোমেলো লাগালাগি বহুতল ভবনের অবকাঠামোগত সামর্থ্য কম। বিশেষত পুরান ঢাকার অন্তত হাজারখানেক পুরনো দালানকোঠা রয়েছে যেগুলো বড় ভূমিকম্পে সহজেই ধসে পড়বে। সবচেয়ে বড় কথা, ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ বাড়ি নির্মিত হয়েছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। পরিকল্পিত নগরীর চেয়ে অনেক বেশি চাপা রাস্তাঘাট এবং অলিগলিতে পূর্ণ এ নগরীতে বিপর্যয়ের পর উদ্ধার কাজ চালানোও অত্যন্ত কঠিন হবে। এসব বিষয়কে সামনে রেখে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী এখন থেকেই যতটা সম্ভব ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেয়া এবং একইসঙ্গে ঢাকার জনসংখ্যার চাপ কমানোর বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। ভূমিকম্প একটি অনির্ধারিত দুর্যোগ। কাজেই এ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়ার সর্বশেষ প্রযুক্তিটিও আমাদের হাতে মজুত থাকা উচিত। দেশে আরও ভূ-কম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র চালু করতে হবে। এখন থেকে শহরাঞ্চলে যাতে ভূ-কম্পন সহনশীল ভবন তৈরি করা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখাও দরকার। এছাড়া পাহাড় কাটাসহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টকারী বিভিন্ন কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য এখন থেকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি রাখতে হবে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কেননা, ব্যাপক গণসচেতনতা এবং নিবিড় প্রস্তুতি থাকলে ভূমিকম্পের ঝুঁকিজনিত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেতে পারে। কিন্তু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার তুলনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতা সামান্য। এ ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে।
No comments