দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বুনিয়াদ গড়ে তোলেন সাইফুর রহমান by সৈয়দ মিজানুর রহমান ও জসিম উদ্দিন সরকার

'গত ১৫ বছর ধরে দেশে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তার বুনিয়াদ গড়ে তোলেন সাইফুর রহমান। বিদেশি সাহায্য ছাড়া যে দেশের উন্নতি হতে পারে, সেই ধারণার উদগাতাও ছিলেন সাইফুর রহমান। দেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির ধাক্কা সামাল দিতে পারবে কিনা, এমন সন্দেহ আর সংশয় ছিল। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়েছে তার কারণে।


এসব চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাইফুর রহমান কারও কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন আবার কেউ তাকে সাহস জুগিয়েছেন পাশে থেকেই'-বর্তমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী, দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা এভাবেই মূল্যায়ন করেন সাইফুর রহমানকে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সাইফুর রহমান আমার কলেজ জীবন থেকে সহপাঠী। তার এমন অ্যাক্সিডেন্ট অনভিপ্রেত। এ মৃত্যু কারও জন্যই ভালো নয়। শুনেছি তিনি বাড়িতে গিয়ে মাছ মারিয়ে খেয়েছেন। এমন দুর্ঘটনায় পড়বেন কল্পনায়ও ছিল না কারও। রাজনীতির কারণে যত বিরোধিতাই করেছিলাম তার, এ কথা বলতে দ্বিধা নেই দেশের অর্থনীতির হাল তিনি ভালোই ধরেছিলেন। অর্থনীতি ভালো চালিয়েছেন। সাইফুর রহমানের মৃত্যুতে জাতি একজন দেশপ্রেমিক নেতাকে হারাল এবং এটি জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখায় জাতি তাকে সমরণ করবে। এছাড়াও সিলেট তার একজন গৌরবের সন্তান হারাল বলে ক্ষতির পাল্লা আরও ভারি হবে। সাইফুর রহমানকে নিজের অকৃত্রিম বন্ধু উল্লেখ করে মুহিত বলেন, তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। সবার সঙ্গে সহজেই মিশে যেতেন, কথা বলতেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১২ বার তিনি বাজেট পেশ করেছেন এটা ছোট কোনো বিষয় নয়। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যতই সমালোচনা করি না কেন, তিনি বাস্তবে দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করে গেছেন। একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেমন সবার আপন, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও তিনি দেশের আপন বনে গিয়েছিলেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে বিএনপির একজন ত্যাগী নেতা হিসেবে অভিহিত করে বর্তমান এই অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, দলের জন্য তিনি যেমন করে গেছেন, তেমনি দেশের জন্যও রয়েছে তার অনেক অবদান। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাইফুর রহমানের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি দেশের ১২টি বাজেট পেশ করেছেন। যে সময়টাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শুরু। তিনি অর্থনীতিতে বেশকিছু সংস্কার করেন। বিশেষ করে বিদেশি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার অর্থনৈতিক সংস্কার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। 'সাইফুর রহমানের অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের দায়িত্বে ছিলেন আপনি, তখন তার কাছ থেকে কি ধরনের সহায়তা পেতেন?' এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জ্জা আজিজ বলেন, 'তিনি (সাইফুর রহমান) কখনই খবরদারি করতেন না। সব কাজেই সহযোগিতা করতেন। আগে বিষয়টি নিয়ে ভালোভাবে জেনে তারপর সিদ্ধান্ত দিতেন। তবে সেটি হতো সবার সঙ্গে পরামর্শ করে।' রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের (আরআরসি) চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত অর্থনৈতিক সংস্কার হয়েছে, তার বেশিরভাগই সাইফুর রহমানের অবদান। মূল্য সংযোজন কর বা মূসক বসিয়ে সাইফুর রহমান একবার আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন। কিন্তু আজ এই মূসক অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি বাণিজ্য উদারীকরণের যে চ্যালেঞ্জ হাতে নেন, সেটাও সফল হয়েছে। অর্থ সচিব হিসেবে দীর্ঘদিন সাইফুর রহমানের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আকবর আলি খান আরও বলেন, বেসরকারিকরণের বড় সম্প্রসারণ হয় সাইফুর রহমানের হাত দিয়ে। এছাড়া দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বেশিরভাগ অবদানই তার। গত ১৫ বছর ধরে অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বুনিয়াদ গড়ে তোলেন সাইফুর রহমান। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, সাইফুর রহমান দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন। বিশেষ করে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে একটি অবস্থানে দাঁড় করাতে অর্থমন্ত্রীদের মধ্যে তার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অনেকের সমালোচনার মুখে পড়লেও তিনি দেশের স্বার্থে তা বাস্তবায়ন করতেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবর্তন করে সাইফুর রহমান ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। সব ব্যবসায়ী ভয়ে-আতঙ্কে পড়েন এই ভেবে, 'দেশের বুঝি বারোটা বাজবে। নিজেদের বিনিয়োগ বুঝি শেষ হবে। কিন্তু দেখা গেল না, অর্থনীতি বরং আরও মজবুত হলো, দেশের পণ্যের সঙ্গে বিদেশি পণ্যের ভালো-মন্দ সবাই জানল। সম্প্রসারিত হলো রফতানির বাজার।' সাইফুর রহমান যখন অর্থমন্ত্রী, তখন বসত্রখাতে বড় বিনিয়োগ আসে। একে একে সিপনিং মিল চালু হতে শুরু করে। যে কারণে আজ সুতার ৮০/৯০ ভাগ জোগানই দিচ্ছে দেশীয় মিলগুলো। দেশীয় মিল রক্ষায় সাইফুর রহমান একবার স্থলপথে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করেন। পরে দেখা গেছে, ভারতের সুতার বদলে দেশি সুতার ব্যবহার বেড়ে যায়, যা বসত্রখাতের জন্য বড় অবদান ছিল। সাইফুর রহমানকে স্মরণ করতে গিয়ে মীর নাসির আরও বলেন, 'অনেকের ধারণা ছিল সাইফুর রহমান কারও কথা শোনেন না। এ কারণে ব্যবসায়ী নেতারা তার কাছে যেতে সাহস করতেন না। তবে দেখা গেছে, কেউ সাহস করে তার কাছে কোনো প্রস্তাব নিয়ে গেলে তিনি সেটা খুব মনোযোগসহকারে শুনতেন। পরে কম সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতেন।' তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশের আত্মসম্মানকে প্রাধান্য দিতেই সাইফুর রহমান বিদেশি সাহায্যনির্ভরতা কমিয়ে আনার প্রথম উদ্যোগ নেন। বিদেশি সাহায্য ছাড়া দেশের যে উন্নতি সম্ভব, তার প্রমাণ রেখে গেছেন সাইফুর রহমান। এজন্য অনেক দাতা সংস্থাই তার সমালোচনা করত। এছাড়া দেশের সড়ক যোগাযোগ, বন্দর, রেলপথ, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামোর উন্নয়নের প্রায় পুরোটাই হয়েছে সাইফুর রহমানের হাত দিয়ে। মোশাররফ হোসেন জানান, তৈরি পোশাক রফতানিতে বন্দরে অনেক ঝামেলা হতো। বিষয়টি সাইফুর রহমানকে জানান ব্যবসায়ীরা। এটি ১৯৯২ সালের শেষদিকের কথা। বিষয়টি জেনে মাত্র ২ মাসের মাথায় বন্দরের কাষ্টমস জটিলতা দূর করার সব উদ্যোগ নেন তিনি। বন্ডেড ওয়্যার হাউস নিয়েও রফতানিকারকদের দুর্ভোগ পোহাতে হতো। বিষয়টি সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান হয়ে যায়। সাবেক সচিব ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক শাহ আবদুল হান্নান সাইফুর রহামনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, আমার মতে বাংলাদেশের যত অর্থমন্ত্রী হয়েছেন তাদের মধ্যে সার্বিক বিচারে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি সবসময় অর্থনীতিকে গতিশীল করার চেষ্টা করেছেন। সবসময় সততার পথে থেকে সত্যিকার দেশপ্রেমিক হিসেবে কাজ করেছেন। কোনো কিছু বলতে তিনি দ্বিধা করতেন না। ১৯৯১ সালের দিকে মূল্য সংযোজন কর চালুর বিষয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় একত্রে কাজ করতে হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের সংস্কারসহ উদার অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি একটি সুদৃঢ় অবস্থানে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। তিনি যখন প্রথম অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। কাষ্টমসে দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে এনবিআরের সদস্য এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থাকার সময় তার সঙ্গে কাজ করেছি। পরে সচিব হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শের জন্য যোগাযোগ হতো। ভ্যাট চালুর বিষয়ে তার সঙ্গে বিভিন্ন সময় অনেক আলোচনা হয়েছে। তখন তার নির্দেশনার কারণেই দেশের রাজস্ব খাত তথা অর্থনৈতিক সংস্কারের অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে ভ্যাট চালু করা সম্ভব হয়েছিল। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত্তিকে টেনে তুলেছেন তিনি। দেশের প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত স্থিতিশীল ছিল। একজন স্বাধীনচেতা, দেশপ্রেমিক, বাস্তববাদী, অভিজ্ঞ, দূরদর্শী ও গতিশীল মানুষ ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে আমরা একজন আপাদমস্তক জ্ঞানী মানুষকে হারালাম। মহান আল্লাহর কাছে তার আত্মার মাগফিরাত করছি। সাইফুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, 'তার মৃত্যু জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দেশে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করতে তার ভূমিকা অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। তিনি সবসময় মানুষের মতকে মূল্যায়ন করতেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে সবসময় শ্রদ্ধা করতাম। অনেক বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীনও তার সঙ্গে নানা ইস্যুতে মতবিনিময় হয়েছে। সব বিষয়ে মতৈক্য হয়নি; কিন্তু তিনি সেটা আন্তরিকভাবে দেখেছেন। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন দিক দিয়ে তার মতো একজন বিজ্ঞ, গুণী মানুষের এভাবে চলে যাওয়া আমাদের জন্য সত্যিই বেদনার।' খলীকুজ্জমান আরও বলেন, সাইফুর রহমান দেশ-বিদেশে আর্থিক খাতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার এই অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.