উইঘুরের মুসলমান এবং চীনা উপনিবেশ by ফাহমিদ উর রহমান
আমার এক পরিচিত উইঘুরের নাম হচ্ছে কুলসুম। তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। এতদিন হয়ে গেছে তাকে ভুলতে পারিনি। সন্ত্রাস, অরাজকতা, মৃত্যু আর ধ্বংসের মাঝে সে কি বেঁচে আছে? বেঁচে আছে তো? তার গর্বের, সৌন্দর্যের মাতৃভূমি পূর্ব তুর্কিস্তান আজ পদানত-নিরাপত্তাহীনতা, আতঙ্ক আর ক্রোধে ফুঁসছে এই দেশ। কুলসুম ছিল সিনকিয়াং ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপিকা।
সে মেলবোর্নের ভিকটোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে পোষ্ট ডক করতে এসেছিল। সে আমাকে নিজ হাতে উইঘুরদের প্রিয় খাবার গুইশনান আর লেহেরমান পাক করে খাইয়েছিল। সে কী তার স্বাদ, ভোলার নয় মোটেই। এই কুলসুমের মুখ থেকেই প্রথম শুনেছিলাম উইঘুরের আজাদি সংগ্রামের কথা, স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের কথা আর মজলুম উইঘুরদের ওপর চীনাদের জুলুমবাজির মর্মন্তুদ সব ঘটনা। কুলসুম হচ্ছে চীনের প্রধান সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী উইঘুরদের প্রতিনিধি। তুর্কি ভাষাভাষী এই এথনিক গোষ্ঠীর সবাই হচ্ছে মুসলমান। চীনের পশ্চিম সীমান্তে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া বরাবর বিরল বসতি পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ১২ মিলিয়ন উইঘুরদের বাস। এছাড়া কাজাখ ও কিরগিজসহ তুর্কি ভাষাভাষী অন্যান্য কয়েকটি এথনিক গোষ্ঠীও এখানে আছে। ধর্মে এরাও মুললমান। এই উইঘুররা চীন থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান গঠন করতে চান। এদের যুক্তি-ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা কোনো দিক থেকেই চীনাদের সঙ্গে তাদের মিল নেই। এই পৃথক হওয়ার চিন্তাটাই স্বাধীনতাকামী উইঘুরদের জন্য হয়েছে কাল। চীনা কর্তৃপক্ষ প্রাণপণে উইঘুরদের এই আন্দোলন শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করছে। স্বাধীনতাকামীদের ওপর প্রাণদন্ড থেকে কারাবাস, নানা রকমের পুলিশি হয়রানি, মধ্যরাতে দরজায় বিশেষ বাহিনীর আঘাত, তারপর লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার কাহিনী শোনা যাবে প্রাচীন সিল্ড রুটের লাগোয়া নানা গ্রাম থেকে শহরে। সে কাশগড়ই হোক বা হোটান, বিশাল সিনকিয়াং প্রদেশের জনপদগুলোতে বিশেষত সংখ্যাগুরু উইঘুরদের মহল্লায় মহল্লায় ভীতি আর অজানা অনিশ্চয়তা এখন কান পাতলেই শোনা যায়। উইঘুরদের দেশান্তরিত নেত্রী রাবেয়া কাদির সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, এক রাতেই ১০,০০০ উইঘুর নিখোঁজ হয়েছে। রাবেয়া নিজে জেল খেটেছেন। তার জেল জীবনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে লেখা 'ম্যান্ডারিন ফাইটার' এখন পশ্চিমা জগতে রীতিমত বেষ্ট সেলার। কুলসুমই আমাকে বলেছিল সিনকিয়াং-এর আজাদির লড়াই বহুদিন ধরে চলছে। সে 'হাজাত' শব্ধটি উচ্চারণ করেছিল নিষিদ্ধ বস্তু পাচার করার ভঙ্গিতে। তিুর্ক শব্ধটির অর্থ জিহাদ বলে স্থানীয় মানুষ। চীনা আধিপত্যের বিরুদ্ধে উইঘুররা প্রকৃতই এক দীর্ঘ হাজাতে জড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, দাঙ্গা চলছে প্রতিনিয়ত। মানুষ প্রাণ দিচ্ছে বেশুমার। ধরে ধরে স্বাধীনতাকামী উইঘুরদের নিয়ে বিচার ছাড়াই চীনা নিরাপত্তা বাহিনী গুলি করে মেরে ফেলে। সে সব খবর আমরা পাই না। চীন সরকার পারতপক্ষে কোনো সাংবাদিককে সিনকিয়াং-এ যেতে দেয় না। নিজেরাও সপষ্ট কিছু বলে না। উইঘুররা মুসলমান হওয়ায় চীনাদের এখন পোয়াবারো। 'মৌলবাদী' ও 'প্রতিক্রিয়াশীল' বলে তাদের নিশ্চিহ্ন করা সহজ হয়ে উঠেছে। যেখানেই মুসলমানরা আজ স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে সেখানেই 'মৌলবাদী' ফ্যাক্টর খুঁজে বের করার চেষ্টা হচ্ছে। যে লড়াই একটা এথনিক মাইনরিটির আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াই, যেটি কিনা একটা মজলুম জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই সেটিকে কিনা ধর্মীয় মৌলবাদ বলে চালানো হচ্ছে। ৯/১১-র ঘটনার পর থেকে বিশ্ব ব্যবস্থায় যে মৌল পরিবর্তন হয়েছে তার চরিত্র হচ্ছে ইসলামবিরোধী এবং নির্বিচারে যাবতীয় সমস্যার জন্য ইসলামকে কষে গাল দেয়া। উইঘুরদের সমস্যা ৯/১১-র ঘটনার চেয়ে বহু পুরনো। যেমন মিন্দানাওয়ের মরো মুসলিম। দক্ষিণ থাইল্যান্ডের কারেন মুসলিম, মিয়ানমারের আরাকান মুসলিম এবং ভারতের কাশ্মীরের মুসলিমদের সমস্যার সঙ্গে ৯/১১-র ঘটনার কোনো মিল নেই। এসব সমস্যা তৈরি হয়েছে জাতিগত সখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীর আধিপত্যের কারণে। 'মৌলবাদী', 'প্রতিক্রিয়াশীল' ইত্যাদি আকথা-কুকথা বলে মজলুম মানুষের স্বাধীনতার আন্দোলনকে নির্মূল করার চেষ্টা হচ্ছে আর কি; যাতে উইঘুররা, কারেনরা, মরোরা আর কখনও স্বাধীনতার আওয়াজ না দিতে পারে। সিনকিয়াং-এ উইঘুররা ক্রমশ সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছেন। সিনকিয়াং-এ মূল চীনের হান জনগোষ্ঠীর মানুষ হু হু করে ঢুকে পড়ছে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য-ধর্ম-সংস্কৃতি আজ হানদের দাপটে বিপন্ন হয়ে উঠেছে। এটা অনেকটা মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ান শ্লাভ জনগোষ্ঠীর মস্কো প্রণোদিত অভিবাসন ও রুশীকরণের মতো। সিনকিয়াং-এ চলছে এক ধরনের চীনাকরণ। যাবতীয় কলকাঠি নাড়া হচ্ছে সুদূর বেইজিং থেকে। মাও সেতুঙের শতফুল সিনকিয়াং-এ ফাটেনি। ঔপনিবেশিক জাতিদ্বেষী রাষ্ট্রের মতো সংখ্যালঘু উইঘুরদের ওপর চলছে দমন-পীড়ন। ফায়ারিং স্কোয়াড দিয়ে সেখানে সমাজতন্ত্র রক্ষা করা হচ্ছে। কুলসুম আমাকে বলেছিল, তালেবান জামানার আফগানিস্তান কিংবা আফ্রিকার গৃহযুদ্ধপীড়িত দেশগুলোর কথা শুনে আমরা অাঁতকে উঠি। কিন্তু এরকম দৃশ্য সিনকিয়াং-এ অহরহ। সিনকিয়াং আজ চীনের কাশ্মীর, বধ্যভূমি। সাম্রাজ্যবাদ বলতে আমরা শুধু পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকেই বুঝি। কিন্তু উইঘুরদের জন্য চীন আর কাশ্মীরের জন্য ভারতই গলার কাঁটা-বড় সাম্রাজ্যবাদ। ২. সিনকিয়াং হচ্ছে চীনের বৃহত্তম প্রদেশ। দেশের মোট এলাকার এক-ষষ্ঠাংশ জুড়ে রয়েছে এটি। এর মাটির নিচে কয়লা, খনিজ তেলসহ বিপুল সম্পদ। প্রাচীন সিল্ড রুট বা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সিনকিয়াং বা পূর্ব তুর্কিস্তানের এথনিক, ভাষিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক আত্মীয়তা বহুদিনের। ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণেই এটা হয়েছে। বিভিন্ন উপজাতীয় খানরা বিভিন্ন সময় এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করতেন। অষ্টাদশ শতাব্ধীর মধ্যভাগে মাঞ্চু রাজারা পূর্ব তুর্কিস্তান বা সিনকিয়াং দখল করেন। মধ্য উনিশ শতকে জেনারেল তাশো চীনা কর্তৃত্ব কার্যকর করতে ব্যবস্থা নেন। তিনি নাম দেন সিনকিয়াং বা নতুন অঞ্চল। আমরা যাকে বলি মহাচীন তা হলো মাঞ্চু রাজত্বের ফল। মাঞ্চু রাজারা বর্তমান চীনের সীমানা গড়েছেন। সিনকিয়াং ছাড়াও তারা জয় করেছিলেন তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া। মাঞ্চুদের উদ্ভব হচ্ছে চীনের মাঞ্চুরিয়া এলাকা থেকে। এদের এক রাজা খাস চীন দখল করেন সপ্তদশ শতাব্ধীতে এবং মাঞ্চু রাজারা মহাচীন শাসন করে ১৯১২ সাল পর্যন্ত। মাঞ্চু আর হান চীনারা এখন প্রায় এক হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। চীনের অধিকাংশ অধিবাসী হচ্ছে 'হান', চীনের ইতিহাস ও সভ্যতা বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি তা প্রধানত এই হান চীনাদেরই সৃষ্টি। এদের ভাষা হচ্ছে ম্যান্ডারিন। কিন্তু হান চীনাদের সঙ্গে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সদ্ভাব সম্ভব হয়নি। যেমন তিব্বতিরা এখন দাবি করছে চীন থেকে পৃথক হওয়ার। যা হোক, মাঞ্চু রাজত্বের সময় সিনকিয়াং-এর মুসলিমরা স্বাধীনতার জন্য ৪২ বার বিদ্রোহ করেন। ১৮৬৩ সালে একবার মাঞ্চুদের হটিয়ে দিতেও সক্ষম হন তারা। ১৯৭৬ সালে চীনা বাহিনী ফের আক্রমণ করে এবং ১৮৮৪ সালে সিনকিয়াং পুনর্দখল করে। ঐতিহাসিকদের হিসাবে তিুর্ক ভাষাভাষী উইঘুর জনগোষ্ঠী ছাড়াও খাস চীনের হুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামের প্রসার ঘটে। হুই মুসলমানদের পূর্বপুরুষরা পারস্য, সিরিয়া, ইরাক, আনাতোলিয়া প্রভৃতি জায়গা থেকে চীনে এসেছিল নানা পেশাগত কারণে। চীনে এরা বিয়ে করে হান কন্যা। কিন্তু হানদের সঙ্গে এরা এক হয়ে যায়নি। এরা হানদের মতো ম্যান্ডারিন বা চীনা ভাষায় কথা বললেও সামাজিক- সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। হুইরা প্রধানত বাস করে চীনের কানসু প্রদেশে। এছাড়াও চীনে ছোট-বড় আরও দশটি প্রধান এথনিক গোষ্ঠী আছে যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ৬৫০ খ্রিষ্টাব্ধে তাঙ বংশের রাজত্বকালে চীনে ইসলামের বিকাশ ঘটে এবং চাঙ এলাকায় প্রথম মসজিদ তৈরি হয়। রাসুলের সাহাবি সাদ বিন আবি ওক্কাস চীনে যান। সেখানে তার কবর আছে। তারপর দলে দলে ইসলাম প্রচারকরা যান রাসুলের সেই বিখ্যাত হাদিস অনুসরণ করে : জ্ঞান সাধনার জন্য প্রয়োজনে চীনেও যাও। ইতিহাসের একটা সময়ে চীনা শাসকদের সঙ্গে মুসলিম শাসকদের ভালো রকমের সদ্ভাব ও বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। ৭৫১-৭৫৪ সালে চীন সম্রাট শুয়ান-সুঙের বিরুদ্ধে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের এক সামন্ত প্রভু বিদ্রোহ করেন। তাকে সামলাতে চীন সম্রাট বাগদাদে খলিফা আল মনসুরের কাছে সৈন্য চেয়ে পাঠান। খলিফা মঙ্গোলিয়া থেকে ৪০০০ উইঘুর যোদ্ধা এবং মধ্য এশিয়া থেকে আরব যোদ্ধাদের একটি বাহিনী পাঠান। চীন সম্রাট গদি রক্ষায় কৃতজ্ঞ হয়ে মুসলিমদের চীনা মহিলা বিবাহের অনুমতি দেন। সেই প্রক্রিয়া চলে দীর্ঘদিন ধরে। এই সামাজিক মেলামেশার যুগে মুসলমান ও হানদের মধ্যে পোশাক, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতির সঙ্গে একটা দেয়া-নেয়ার ছবিও দেখা যায়। কয়েকজন মিঙ সম্রাট ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম অনুরক্ত হয়ে পড়েন বলে ঐতিহাসিকদের দাবি। সুঙ জামানায় চীনা আমদানি-রফতানি ব্যবসায় মুসলিমদের বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু মাঞ্চু জামানায় এই মিলনের ছবিটা বদলে যায়। রাজশক্তির সঙ্গে মুসলিমদের সংঘাত বাধে। মাঞ্চু শাসন ছিল আসলে হানদের শাসন। পরবর্তীকালে ১৯৪৮ সালে কমিউনিষ্ট বিপ্লবের পরও এই হান আধিপত্যের জোয়ালে আটকে আছে উইঘুররা। মাঝখানে ১৯৩৩ সালে সামান্য সময়ের জন্য সিনকিয়াং-এর কাশগড়ে স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক রিপাবলিক গঠিত হয়েছেল। কমিউনিষ্ট বিপ্লবের পর ১৯৫৪ সালেও হোটানে এমনই একটা অভ্যুত্থান ঘটে। মাঝে কুওমিনটাং জামানায় কুলঝা ও ওয়াইলিতে আধাস্বায়ত্তশাসনের সুযোগ পায় উইঘুররা। মাও সেতুঙ বলেছিলেন, চীনের কমিউনিষ্টরা বিশ্বাস করে প্রতিটি জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাস, চীনা কমিউনিষ্টরা যে নীতি ঘোষণা করেছিল তা কখনও মেনে চলেনি। চীনের মুসলিম সমস্যা সমাধান হওয়ার তুলনায় তার তীব্রতাই বেড়েছে। রুশ বিপ্লবের রূপকার লেনিনও মধ্য এশিয়ার মুসলিম জাতিসত্তাগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কমিউনিজমের নামে সেখানে চেপে বসেছিল গ্রেট রাশিয়ান শভিনিজম। মধ্য এশিয়ার মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের তৈরি জাদিদ আন্দোলন কিংবা বাচমচি বিদ্রোহ যেভাবে কমিউনিষ্টরা দমন করেছিল তা কিন্তু জারশাসিত রাশিয়ার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। সমাজতন্ত্র যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, জাতীয় রাষ্ট্রের শৃঙ্খল ভেঙে বিভিন্ন জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজ করেনি। মাওয়ের জীবদ্দশাতেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় অসংখ্য মসজিদ ও বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। সিনকিয়াং-এ এখন মসজিদ ও ধর্মীয় স্থানগুলোকে সরকারিভাবে নথিভুক্ত হতে হয়। কুলসুম বলেছিল, কেউ যদি নামাজ ও রোজা পালন করতে চায় তাহলেও তাকে সরকারিভাবে নথিভুক্ত হতে হয়। সরকার ইসলামিক পোশাক পরায় আপত্তি করে। মুসলিম সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে যারা ঐতিহ্যে বিশ্বাসী তাদের হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। সরকারবিরোধী ইমাম-মৌলভী-আলেমদের আটক করা হয়। সোভিয়েট মধ্য এশিয়ার মতোই ইসলামকে আটকাতে 'দেশপ্রেমী ইসলামের' এক তত্ত্ব খাড়া করেছে চীনা কমিউনিষ্টরা। ইসলামের মতো এক বিশ্বধর্মকে জাতীয় রাষ্ট্রের বা শাসকদলের প্রয়োজনে কাটাছাঁটার মতো মূর্খতা আর কী হতে পারে? আসলে বস্তুবাদী বা নাস্তিকতাবাদী চেতনা মুসলমান জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার ভ্রান্ত নীতি যে আখেরে সমাজতন্ত্রের জন্য কোনো শুভ ফল বয়ে আনেনি তাতো আমরা নিকট ইতিহাস থেকেই দেখছি। চীনের কমিউনিষ্ট নেতৃত্বের সমস্যা হলো একটা বহুজাতিক, বহুভাষিক সমাজকে জাতীয় মনোলিথিক রাষ্ট্রের আধারে পুরে ফেলার চেষ্টা করছেন তারা, যা মুসলমান সংখ্যালঘুরা মানতে রাজি নন। এখানে ধর্ম ছাড়াও বিচ্ছিন্নতাবাদের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উৎসগুলো চীনারা চেপে গিয়ে মার্কিন-ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মতো এটির একটা মৌলবাদী রং দিতে চায় তারা। এর একটাই উদ্দেশ্য-উইঘুরদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে পন্ড করে দেয়া এবং বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করা। সিনকিয়াং-এর রাজধানী উরুনচিতে হান চীনের সঙ্গে উইঘুরদের যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছে তার কারণ হচ্ছে এই। হানরা সিনকিয়াং দখল করে ফেলছে অর্থনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, তারাই পাচ্ছে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। হান চীনারা হয়ে উঠেছে সিনকিয়াং-এ উপনিবেশকারী। উইঘুররা হয়ে উঠেছে নিজভূমে পরবাসী। ৩. অনেকের মনে হতে পারে, উইঘুররা বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা থেকে অনেক দূরের। আর একদল ভাবতে পারেন, এসব বিষয় ইসলামী লোকজনের ব্যাপারে। কিন্তু নিপীড়িত জাতিসত্তার লড়াই হিসেবে উইঘুরদের অবশ্যই আমাদের বিবেচনা করতে হবে। কেউই প্রগতিশীল বা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দাবি করতে পারবে না, যদি না এই নিপীড়িত জাতিসত্তাগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের লড়াইয়ের সঙ্গে নিঃশর্ত একাত্মতা প্রকাশ করে। দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে চলা মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের লড়াইয়ের ব্যাপারে আমরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন নই। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী প্রচার-প্রপাগান্ডা যেভাবে ইসলামকে বর্বর ও জঙ্গি ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে, তার বিরুদ্ধে আমরা আমাদের কর্তব্য ঠিকমতো ধরতে পারি না। আবার উইঘুর, মরো, কারেন, আরাকান, কাশ্মীর, চেচেন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সবাই মুসলমান হওয়ায় এখানকার একটা সাধারণ ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসলাম। এ কারণে আজকের বিশ্বব্যবস্থায় ইসলাম বিরোধী মনোযোগ ও কর্মসূচির সঙ্গে এসব লড়াই-সংগ্রামকে যুক্ত করে দিয়ে আধিপত্যবাদীরা যেমন সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে তেমনি আমাদেরও একটা বিভ্রমের মধ্যে রেখে দিয়েছে। ফলে এসব স্বাধীনতা সংগ্রামকে আমাদের জনগণের লড়াই সংগ্রামের জায়গা থেকে হাজির করা সম্ভব হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা মুসলিম উম্মাহর বিশ্বজনীন চেহারাটাকে কীভাবে ঝাঝরা করে দিয়েছে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে। উম্মাহ মানে হচ্ছে জাতীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠা। এরকম কোনো স্বপ্ন, সম্ভাবনা আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট আছে কি?
No comments