সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছেঃ এর কি কোনো প্রতিকার নেই?
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এমন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো দিন পত্রিকার পাতায় দুর্ঘটনার কোনো খবর না থাকলে অনেকের কাছে তা অস্বাভাবিক ঠেকে। শনিবার অপরাহ্নে সিলেট থেকে ঢাকা আসার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের অদূরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য এম সাইফুর রহমান। তাকে বহন করা মাইক্রোবাসটির চালক রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ এসে পড়া একটি গরুকে বাঁচাতে গিয়ে গাড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
গাড়িটি একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পাশের খাদে পড়ে পানিতে ডুবে যায়। ড্রাইভার এবং অন্য আরোহীরা ডুবে যাওয়া গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও ৭৭ বছর বয়সী সাইফুর রহমান পারেননি। ১০ মিনিট পর যখন তাকে উদ্ধার করা হয়, তখন তিনি অজ্ঞান না মৃত ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। পরে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একই দিনে রাজধানীত ট্রাক-ট্যাক্সিক্যাব সংঘর্ষে একই পরিবারের ৫ জন নিহত হয়েছেন। পল্লবী বেড়িবাঁধ এলাকায় আশুলিয়া থেকে ঢাকাগামী ট্যাক্সিক্যাবের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা ইটভর্তি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে নিহতরা সবাই ট্যাক্সিক্যাবের আরোহী ছিলেন। প্রায় প্রতিদিন এ ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকাকে কিছুতেই স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নেয়া যায় না। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সড়ক অবকাঠামো বেশ উন্নত ও বিস্তৃত বলে গণ্য করা হয়। বিদেশে বাংলাদেশী ড্রাইভারদেরও নাকি ভারি সুনাম। সড়ক অবকাঠামো ভালো, ড্রাইভারও ভালো, তারপরও কেন প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘিরে চলাচলের সময় প্রতিদিন দেখা যায়, রাস্তার পাশে বিভিন্ন স্থানে ২/৩টি ট্রাক উল্টে পড়ে আছে। ট্রাক যাত্রী বহন করে না বলে প্রাণহানি না ঘটলে এসব দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় আসে না। অন্যান্য মহাসড়কের চিত্রও এর চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয়। বিশ্বব্যাপী নিয়ম হচ্ছে, মহাসড়কে শুধু দ্রুতগামী যান্ত্রিক যান চলাচল করবে। মহাসড়কে গরু-ছাগলের আনাগোনা, ধান শুকানো, রিকশা ও ভ্যান চলাচল ২১ শতকে অকল্পনীয় হলেও আমাদের দেশে এগুলো সাধারণ বিষয়। মহাসড়কের পাশে হাট বসা, বাস-ট্রাকের অলস সমাবেশ, শিশুদের ছোটাছুটি এদেশে অতি পরিচিত দৃশ্য। হুট করে একটি গরু রাস্তার মাঝে এসে না পড়লে শনিবার সাইফুর রহমানকে এমন বেঘোরে প্রাণ হারাতে হতো না। দেশে উত্তরাঞ্চলের মহাসড়কগুলোতে পাশের রাস্তা থেকে হঠাৎ ভ্যান উঠে পড়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়। এছাড়া দূরপাল্লার বাসগুলোর মধ্যে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, যাত্রী ওঠানামায় বিশৃঙ্খলা, মালভর্তি ট্রাকগুলোর ইচ্ছাকৃত সাইড না দেয়া ইত্যাদি প্রায়ই বড় ধরনের অঘটনের জন্ম দেবে। এসব দেখার জন্য হাইওয়ে পুলিশ তৎপর থাকায় প্রয়োজনীয়তার কথা বহুবার বলা হলেও কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীনতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চলেছে। খোদ রাজধানীতেও ট্রাফিক শৃঙ্খলা যে মহাসড়কগুলোর চেয়ে খুব একটা ভালো, তা বলা যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর চৌরাস্তায় অত্যাধুনিক ট্রাফিক বাতি ঠিকই জ্বলে আর নিভে; কিন্তু কী গাড়িচালক, কী ট্রাফিক পুলিশ-কেউ এগুলোর সংকেতের দিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। ঢাকায় যেভাবে গাড়িগুলো চলে এবং যে গতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাতে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও অনেক বেশি হলেও অবাক হওয়ার কোনো কারণ থাকত না। মানুষের চলাচলের প্রয়োজন দিন দিন বাড়ছে। এই প্রয়োজন যাতে প্রাণহানির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করার জন্য ট্রাফিক শৃঙ্খলা জোরদার করা দরকার। অথচ বাস্তবে এই শৃঙ্খলার মান আগের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে পথেঘাটে অপঘাতে মৃত্যু হারও বাড়বে। এ অবস্থায় উদাসীনতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। রাস্তাঘাটগুলোকে মৃত্যুফাঁদে রূপান্তরিত হওয়ার পরিণতি থেকে রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই আদাজল খেয়ে লাগতে হবে। এটাই আমাদের দাবি।
No comments