মূলধারা বেগবান হয় শাখার ধারায় by আতাউস সামাদ
বরাক নদী সুরমা ও কুশিয়ারা এই দুই ধারায় ভাগ হয়ে দুটো নদী হলো। নদী দুটি আবার এক হয়ে মেঘনা নাম নিয়ে ছুটে চলল দক্ষিণ পানে। মেঘনার এই চলার পথে পদ্মা এসে মিশে গেল তার সঙ্গে। বিশাল মেঘনা বঙ্গোপসাগরে পড়ে ভারত মহাসাগরের জলরাশি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলল। এখন বাংলাদেশজুড়ে তর্ক চলছে ভারত যদি তার এক রাজ্য মনিপুরের টিপাইমুখে বাঁধ দেয় তাহলে ভাটিতে বরাক, সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনার কী যে হাল হবে কে জানে!
আর তার ফলে মিঠাপানির অভাবে বঙ্গোপসাগরের লোনাপানি কি আরও লবণাক্ত হয়ে বাংলাদেশের অনেক ভেতরে চলে আসবে? আমাদের অনেক জনপদ কি ধ্বংস হয়ে যাবে তার ফলে? অন্তত দুর্দশায় পড়বে একথা তো ঠিক। তবে আমি বরাক ও মেঘনা নদী এবং বঙ্গোপসাগরের প্রসঙ্গ টিপাইমুখ বাঁধ বিতর্কে আরও কিছু শব্ধ জুড়ে দেয়ার জন্য টানিনি। আমি নদ-নদী-সাগর প্রসঙ্গ এনেছি একটা রূপক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। বিশ্বের ইতিহাস এক মহাসমুদ্র। এ মহাসমুদ্রকে গভীর করে রাখে, মণি-মুক্তায় সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করে বিভিন্ন দেশ ও জাতির ইতিহাস। তাই এ ইতিহাসগুলো নদ-নদীতুল্য। আবার জাতীয় ইতিহাসের প্রবাহকে প্রবল করে নানান ঘটনাস্রোত। এ ঘটনাস্রোতগুলো বড় নদীর শাখা নদী। এসব শাখাকে নজরে না নিয়ে, আমল না দিয়ে এবং অগ্রাহ্য করে ইতিহাসের বৃহত্তর ধারাটিকে কেবল রুগ্নই করা যায়। আশা করি বাংলাদেশের মানুষ এ ভুলটি করবেন না, দেশের বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের অদূরদর্শী নেতারা যত বিভ্রান্তিকর মন্ত্রণাই তাদের দিন না কেন। তবে আশার কথা এই যে, নদী ও ইতিহাসের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। একটা নদী একবার শুকিয়ে গেলে সাধারণত সেটা ভরাট হয়ে যায়। অন্তত আমাদের অঞ্চলে। ওই মরা নদীর মূলধারা কালক্রমে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইতিহাসের বেলায় দেখা যায় যে, ভুলে যাওয়া বা ধামাচাপা দিয়ে রাখা বহু ঘটনাপ্রবাহ বিস্মৃতির ধূসর পর্দা ভেদ করে আবার আত্মপ্রকাশ করে। ইউরোপের নবজাগরণ বা রেনেসাঁ ঘটতে পেরেছিল বহুলাংশে এ জন্য যে, আরব তথা মুসলিম আরব পন্ডিতরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রাচীন গ্রিসের অর্জিত জ্ঞান ধারণ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। ব্রিটিশসহ অন্য ইউরোপীয়রা এ সত্যটি বহুকাল বাকি বিশ্বের কাছ থেকে গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, তারাই বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে বলছে যে, 'আরবদের মধ্যেও পন্ডিত লোক কিছু ছিল। ভারতেও ছিল। তারা বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারে বেশ মূল্যবান অবদান রেখেছেন।' তাদের ভাবখানা এমন যেন তারা না জানালে এসব খবর কেউ কোনো দিন জানতে পারত না। তবে আমরা জানি, সত্য প্রকাশিত হয়েছে মানব সভ্যতার বৈশিষ্ট্যের জন্য। সভ্য মানুষের একটা মহৎ গুণ হচ্ছে, কোনো প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর খোঁজা এবং প্রাপ্ত উত্তরটিকে যুক্তি ও তথ্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করা। যার দরুন অনুদ্ঘাটিত তথ্য ও সত্য উদ্ঘাটিত হতে থাকে; অনেক হারিয়ে যেতে বসা ঘটনা আবার সামনে এসে উপস্থিত হয় যথাযথ গুরুত্ব পাওয়ার দাবি নিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আমার রূপকের সাগর আর নদীর মতো। একাত্তরের মুুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় হলো সাগর। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণা থেকে ১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ একটা বিশাল নদী, যাতে রয়েছে প্রচন্ড স্রোত ও বড় বড় ঢেউ, কিন্তু ওই নদী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি বা এমনও নয় যে, এটি শুধু একজন বা দু'জন নেতার কর্মফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বরঞ্চ বেশকিছু শাখা নদীর স্রোত এসে পড়েছে মূলধারাতে এবং সেই ধারাকে বেগবান করেছে। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন তার আগে কয়েক বছর ধরে তদানীন্তন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার জন্য স্বীকৃতি আদায়ের প্রায় বিরতিহীন চেষ্টার ফল। আবার ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে অবাঙালি নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ পরিষ্কার করে তুলছিল যে, ওরা আর আমরা এক নই এবং এক হতে পারব না। কারণ তারা প্রভু হতে চায় এবং আমাদের ভৃত্য করে রাখতে চায়। ষাটের দশকের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ও সশসত্র বাহিনীতে নগণ্য সংখ্যক বাঙালির চাকরি হওয়ার বহু প্রামাণিক তথ্য ও পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, পূর্ব পাকিস্তান শুধু বঞ্চিত হচ্ছে তাই নয়, শোষিতও হচ্ছে। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যে ১৯৫৭ সালেই পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানের বিদায়ী সালাম জানিয়েছিলেন- পরবর্তী ঘটনাবলী বাঙালিদের তার যথার্থতার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। অতঃপর ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ৯ দিনের যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় নিঃসঙ্গতার কথা সব পাকিস্তানি তথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন শেখ মুজিবুর রহমান অসীম সাহসিকতার সঙ্গে এবং ১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে 'পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি সনদ' ছয় দফা দাবি ঘোষণা করেন। পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাঙালিরা আওয়ামী লীগের এই ছয় দফা দাবিকে সঙ্গে সঙ্গেই সর্বতোভাবে সমর্থন জানালে বৈষম্য দূর করার আন্দোলন অনিবার্যভাবে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। এরই মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বারংবার পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে নামায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে পাকিস্তানি মিলিটারির ভয় কমে আসতে থাকে। স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা বা উদ্ভব তার পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোর মধ্যে নিহিত। ওই সময় পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মানুষ কিন্তু অহিংস আন্দোলনের কথাই ভাবতো। কিন্তু ওই সময় পাকিস্তানের সশসত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের মধ্যে গোপনে সশসত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতির কাজ চলছিল। যারা এই অসম সাহসী ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করছিলেন তারা কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এই গোপন আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি নাবিকরা তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য করাচিতে একটি সমিতি গঠন করার মাধ্যমে। এই কল্যাণ সমিতির কাজ চলতে চলতে এর সদস্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে এজন্য একটি গোপন বিপ্লবী সংস্থা গড়ে ওঠে। এদের সঙ্গে সেনা ও বিমান বাহিনীর কিছু অফিসার ও সৈনিকের যোগাযোগ হলে সংগঠনটি আরও বড় হয়। এরা 'বিপ্লবের' একটি পরিকল্পনাও তৈরি করেন। এদের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে করাচিতে একটি গোপন বৈঠক হয়। ওই আলোচনায় তিনি বিপ্লবের জন্য অর্থ সাহায্য ও অন্যান্য সহযোগিতা দিতে সম্মত হন। গোপন আন্দোলনের সংগঠকরা পরে বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। কিন্তু এক সময় পরিকল্পনার কথা পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বহু বাঙালিকে গ্রেফতার করে এবং জেরার নামে নির্যাতন করে। অবশেষে ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর এক বিশেষ আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর ও লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে দুই নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য' নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার শুনানি শুরু করে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কারসাজিতে পত্র-পত্রিকায় মামলাটি 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' বলে বর্ণিত হতে থাকে। মামলার অভিযোগপত্রে ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান ওই বিদ্রোহের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন আদায়ের জন্য ওই দেশের ত্রিপুরা প্রদেশের রাজধানী আগরতলা গিয়েছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের লক্ষ্য ছিল যে, এই মামলার ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ছয় দফাভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সমমনাদের 'বিশ্বাসঘাতক' রূপে দেশের জনগণের মধ্যে ঘৃণার সৃষ্টি করা। আর তাকে এবং বাঙালির স্বাধীনতার জন্য গোপন বিপ্লবী সংগঠকদের ফাঁসিতে ঝোলানো। কিন্তু বাস্তবে ঘটে ঠিক তার বিপরীত। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা উপলব্ধি করেন যে, মামলাটি করা হয়েছে তাদের জাতি হিসেবে বেঈমান দেখানোর জন্য, বৈষম্য-বিরোধী ও স্বাধিকার আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য এবং ছয় দফার প্রণেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য। ওই সময় এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তানবাসী সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আবারও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়তে সচেষ্ট ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১১ দফার আন্দোলন শুরু করে। তাদের প্রধান দাবি ছিল ওই ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে হবে। দ্বিতীয় প্রধান দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিতেই হবে। ফলে অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে ধিক্কার শুরু হলো এবং দাবি উঠতে লাগল যে, পাকিস্তানের শাসক স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ও পূর্ব পাকিস্তানে তার মনোনীত গভর্নর মোনেম খানকে বিদায় নিতে হবে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে টালমাটাল অবস্থা দেখে সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুববিরোধী রাজনৈতিক নেতারা মাঠে নেবে পড়ল। সারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকল। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা গভীরভাবে রেখাপাত করে, যার ফলে তখন থেকে সশসত্র আন্দোলন ও স্বাধীন বাংলাদেশের কথা জনগণের মধ্যে প্রকাশ্যেই উঠতে থাকে। স্বাধীনতার জন্য ছাত্রদের মধ্যে গোপন বিপ্লবী সংস্থার সৃষ্টি হয়। স্বাধীন দেশের নাম ও মানচিত্র নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিলাভ করলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি পরিণত হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ও কিংবদন্তির চরিত্রে। অর্থাৎ পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং পাকিস্তান ছয় দফা দাবি না মানলে তার অনিবার্য পরিণতি সশসত্র বিপ্লবের ক্ষেত্র তখনই তৈরি হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গণঅভ্যুত্থানকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে মওলানা ভাসানী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি ভূমিকা রেখেছিলেন। আর আগরতলা মামলার অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহিরুল হক ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে আত্মাহুতি দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিসফুলিঙ্গটি জ্বালিয়ে দিয়ে যান। একই সঙ্গে লক্ষ্য করা যায়, ওই সময় পাকিস্তান সরকারের জেল-জুলুম নিরন্তর চলতে থাকায় আইনজীবী, সাংবাদিক ও পেশাজীবীরা পর্যন্ত গোপন আন্দোলনকারীদের মতো কাজ করতে বাধ্য হন। এসবই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে কাজে লেগেছিল। তাই 'আগরতলা মামলা' ও তাকে কেন্দ্র করে যেসব বিরাট ঘটনা ঘটে সেগুলো একত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অন্যতম স্রোতধারা। দুঃখের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের পথে 'আগরতলা মামলা'র মতো যত ঘটনা ও ঘটনাবলী বিশেষ অবদান রেখেছে সেগুলো আজকাল আমাদের মন থেকে যেন উধাও হতে চলেছে। তার কারণ, বর্তমান দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের কলহ এবং এর আগে সামরিক ও আধা-সামরিক শাসনের উপদ্রব। তবে যেহেতু ইতিহাস তাকে ভুলতে দেয় না সে জন্য অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও কথা কারও না কারও মনকে দোলা দেয় এবং কেউ না কেউ এসব সম্পর্কে কাজ করেন, কথা বলেন, মনে রাখার দাবি তোলেন। তবে আমাদের উচিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সবক'টি ধারাকে বারবার মনে করা ও সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়া। আর চলমান দুঃসময়ের মধ্যেও কেউ যদি নির্মোহ ও নির্দলীয়ভাবে এসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলী একটু সহজ-সরল করে লেখেন যাতে পরে তা স্কুল ও কলেজে পাঠ্য করার জন্য বিশেষ সংস্করণে রূপান্তরিত করা যায়, তাহলে জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। কাজটি সোজা নয়, তবে যিনি তবুও কর্তব্যটি পালন করবেন তিনি নিশ্চয়ই বীরের সম্মানে সম্মানিত হবেন। এতক্ষণ যা লিখলাম তার প্রায় সবই মনে আসছিল গত ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার নবগঠিত 'ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা মূল্যায়ন পরিষদ'-এর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সময়। ১৯৬৮-'৬৯ আগরতলা মামলার শুনানিতে হাজির থেকে তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার জন্য রিপোর্ট করার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। অবজারভার পত্রিকা থেকে আবদুর রহিম, প্রয়াত মতিউর রহমান ও আমাকে নিয়ে ওই মামলার রিপোর্ট করার জন্য টিম তৈরি করে দেয়া হয়। আমি তখন পাকিস্তান অবজারভারের চিফ রিপোর্টার। ওই সময় অন্যান্য পত্রিকার সহকর্মীদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ ও রকিব সিদ্দিকীর কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। অবজারভারের তৎকালীন বার্তা সম্পাদক এবিএম মূসা আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, প্রতিদিন দুপুরের মধ্যে শুনানির বা আদালত কক্ষের এমন কোনো বিশেষ আকর্ষণীয় তথ্য তাকে জানাতে হবে যাতে সিনেমা হলে স্লাইড মারফত বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠকদের পরদিন তা পত্রিকায় পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো যায়। ওই মামলার এক পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি অনুরোধ নিয়ে যাওয়ার কঠিন কাজটি আমাকে করতে হয়েছিল। শেখ সাহেবের অনুরোধ ছিল যে, তার ও ওই মামলার সব অভিযুক্তের মুক্তির জন্য মওলানা ভাসানী যেন অবিলম্বে আন্দোলন শুরু করেন। মওলানা ভাসানীর কাছে পৌঁছানোর জন্য আমি সাংবাদিক ও শ্রমিক নেতা সিরাজুল হোসেন খানের শরণাপন্ন হই। তিনি আমাকে শহীদ সাঈদুল হাসান সাহেবের ইস্কাটনের বাসায় মওলানার কাছে নিয়ে যান। মওলানা ভাসানী শেখ সাহেবের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। আসলে আমি তখন অসুস্থতার দরুন ছুটিতে ছিলাম; কিন্তু সহকর্মী আবদুর রহিম হঠাৎ করে ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন বিধায় আমাকে জরুরি তাগিদ দিয়ে ট্রাইব্যুনালে যেতে ও শেখ সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়েই মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেন। এই সাক্ষাৎকার আয়োজনে আবদুর রহিম বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে আগরতলা মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় পুরনো দিনের কথাগুলো বিশেষ করে মনে পড়ছিল। 'ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা মূল্যায়ন পরিষদ'-এর মূল দাবি হচ্ছে সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে 'মহাবীর' ও মামলার অন্যান্য অভিযুক্ত এবং বৈরী সাক্ষীদের 'জাতীয় বীরের' মর্যাদা প্রদান করা, তাদের নামে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা, সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হকের ওপর যেখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা ও পাঠ্যপুস্তকে আগরতলা মামলার কাহিনী সন্নিবেশ করা। উল্লেখ্য, ওই মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে জীবিত আছেন মাত্র ১১ জন। এদের মধ্যে কর্নেল শওকত আলী বর্তমান জাতীয় সংসদের ডেপুটি সিপকার। প্রয়াতদের মধ্যে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে পাকবাহিনী একাত্তরে হামলা শুরু করার পরপরই তার বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সেনা বিদ্রোহীদের হাতে। ওই মামলার চারজন বেসামরিক অভিযুক্তের মধ্যে একমাত্র খান শামসুর রহমান এখনও জীবিত আছেন। একাত্তরে তিনি গ্রামে আত্মগোপন করে পাকিস্তানি মিলিটারির হাত থেকে জীবন রক্ষা করেন। অভিযুক্তদের বেশিরভাগই '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। জীবিত অভিযুক্তরা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে গেল
No comments