রাজধানীতে যানজট, পুরনো গাড়ি ইত্যাদি by মুহম্মদ নূরুল হুদা
অস্বীকার করার উপায় নেই, দিনে দিনে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে আমাদের এই প্রিয় রাজধানী ঢাকা নগরী। এবারে রোজার শুরুতেই দেখা দিয়েছে মানবসৃষ্ট যানজট ও প্রকৃতিপ্রেরিত দুর্যোগ সোয়াইন ফ্লু। এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায় উদ্ভাবন এবং বাস্তবায়ন জরুরি। আজ যানজট সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
এমনিতেই রাজধানীর রাজপথ আর অলিগলিগুলো যানজটের মারপ্যাঁচে চলাচলের অনুপযোগী, তার ওপর লক্কড়ঝক্কড় ও মেয়াদোত্তীর্ণ পুরনো গাড়ি বাতিলকরণের সরকারি সদ্ধান্ত কার্য়করী করার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রযুক্ত না হওয়ায় পরিস্থিতি উন্নততর হওয়ার বদলে বরং জটিলতর হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি নির্দেশ জারির পর প্রথম দিকে কিছু কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের চলাচল বন্ধ থাকতে দেখা গেলেও পরবর্তীকালে সরকারি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে দেখে মালিকরা আবার নতুন উদ্যমে ও টেকনিকে এসব যানবাহন রাস্তায় ছেড়েছেন। একটি চিরাচরিত টেকনিক হচ্ছে, যেসব রাস্তায় মোবাইল কোর্ট আর চেকিং ব্যবস্থা জোরদার, সন্তর্পণে সেসব রাস্তা এড়িয়ে যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ, প্রেসক্লাব থেকে শাহবাগ যাওয়ার পথে দিনের অধিকাংশ সময়ে মৎস্যভবনের মোড় থেকে শিশুপার্ক পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিলে সুপ্রিমকোর্টের মোড় থেকেই কিছু কিছু গাড়ি রুট পরিবর্তন করে হাইকোর্ট, বাংলা একাডেমী ও টিএসসি হয়ে নীলক্ষেত চলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রাফিক চেকিং অপেক্ষাকৃত কম থাকায় বাসগুলো এই অনির্ধারিত পথ দিয়ে চলাচল করেও পার পেয়ে যায়। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়লেও বাসের ড্রাইভার আর হেলপাররা গা করে না। কেউ কেউ যাত্রীদের কষ্ট কমানোর কথা বলে শাহবাগের যাত্রীকে টিএসসির মোড়ে কিংবা এলিফ্যান্ট রোডের যাত্রীকে নীলক্ষেত মোড়ে নামিয়ে দিয়ে সংশ্লিট যাত্রীর কাছে মাফ চেয়ে ভদ্রতা দেখায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিশু ও মহিলা যাত্রীরা সাধারণত চরম দুর্ভোগের শিকার হন। টিএসসি, দোয়েল চত্বর ও নীলক্ষেত মোড়ে কার্যকর চেকপোসট থাকলে এই অনভিপ্রেত পরিস্থিতি সহজেই এড়ানো যায়। গুলিস্তান থেকে প্রেসক্লাব কিংবা মৎস্যভবন থেকে কাকরাইল যাওয়ার পথেও এরকম অনির্ধারিত রুটে বাস চলাচল চোখে পড়ে। ২ সেপ্টেম্বর আমরা কয়েকজন দুপুর ১২টার দিকে কাকরাইল মোড় থেকে রাজস্ব ভবন হয়ে প্রেসক্লাব যেতে গিয়ে শিল্পকলা একাডেমীর মোড়ে এসে এক অভাবনীয় যানজটের মধ্যে পড়ে যাই। মাত্র কয়েক গজের যানজটে আমরা ঘণ্টাখানেকেরও বেশি উদ্ধারবিহীন অবস্থায় আটকে থাকি। এই যানজটের মূল কারণ পশ্চিম ও উত্তরদিক থেকে অনির্ধারিত পথ দিয়ে ঢুকে-পড়া কিছু আরোহী-বোঝাই লক্কড়ঝক্কড় বাস। এগুলো এ পথে কী করে এলো বোঝা গেল না। হেলপাররা বলল, জট এড়ানোর জন্য নাকি ট্রাফিক পুলিশই গাড়িগুলোকে এপথে পাঠিয়েছে। অথচ আমরা আসার পথে হোটেল রাজমণি ঈশা খাঁর মোড়ে এমন কোনো ঘটনা দেখিনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যখন ট্রাফিক পুলিশ এলেন, তখন তাদের কাছে জানা গেল, তারাও ওই ধরনের কোনো নির্দেশ দেননি। কথাটা আমাদেরও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো। আগসট মাস থেকে যানজট নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কর্তৃপক্ষ যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা সময়োপযোগী বলেই মনে হচ্ছে। তা নাহলে আজ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াত কে জানে। মনে পড়ে আরেকটি ঘটনা। আগসেটর ১২ কিংবা ১৩ তারিখ সন্ধে ৭টার দিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিটিভিতে কবিতা পড়ার জন্য যাচ্ছিলাম। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার মোড় পার হতেই পুলিশ আমাদের গাড়ি থামানোর সঙ্কেত দিলেন। একজন অফিসার এসে কাগজপত্র চেক করে ফেরত দিতে দিতে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন, আমি কী করি, কোথায় যাচ্ছি। আমি আমার গন্তব্য ও পেশার কথা বললাম। কবিতার পাশাপাশি কলাম-টলামও লিখি শুনে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে তো আপনি সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িত। গাড়ির কাগজপত্র যেহেতু ঠিক আছে সেহেতু সামনে ছোট্ট একটি 'সাংবাদিক' সিটকার লাগিয়ে নিন। আমরা জনসাধারণকে অনাবশ্যক হয়রানি করতে চাই না। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম। নিরীহ ও আইনের অনুগত ব্যক্তিদের সাধ ও সাধ্যের কথা বিবেচনা করে তাদের প্রতি এ ধরনের সৌজন্যবোধের প্রতিফলন ঘটেছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তেও। আসলে আমাদের মতো দরিদ্র দেশে ব্যক্তিমালিকাধীন ও অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত গাড়ির ক্ষেত্রে বয়সের চেয়ে চলাচল উপযোগিতা, রুট পারমিট ও ফিটনেসই অধিক বিবেচ্য। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দশ বছরেই একটি গাড়ি অকেজো হয়ে যেতে পারে, আবার সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে তিরিশ বছরেও যে কোনো গাড়ি চলাচলের উপযোগী থাকতে পারে। ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও গাড়ি চলা না চলার প্রধান নিক্তি তার যান্ত্রিক ত্রুটিহীনতা ও ফিটনেস। আমাদের দেশে এই ক্রাইটেরিয়া আরও বেশি যুক্তিযুক্ত। আমাদের মতে, কর্তৃপক্ষ যদি বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের নির্ধারিত রুট ও প্রহর কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন, যানবাহনের রুট পারমিট ও ফিটনেস ব্যত্যয়বিহীনভাবে পরীক্ষা করে সঙ্গে সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাহলে অবৈধ যানবাহন চলাচল বৃহদংশে বন্ধ হবে এবং যানজট সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। সমরণ রাখা যেতে পারে, বর্ষাকালে ঢাকা শহরের যানজটের আরেকটি প্রধান কারণ অনতিক্রমনীয় জলাবদ্ধতা। ঢাকা শহরের সড়ক ও অলিগলিগুলোর পরিকল্পিত সংস্কার ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণের বাস্তব উদ্যোগ নেয়া হলে এই রাজধানী বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। অতীতে সব সরকারই এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা তবু পুরোপুরি নিরাশাবাদী নই।
No comments